ছবি - ft.com
পশ্চিমা নানা হুমকি-ধামকি-অনুরোধ উপেক্ষা করে ও সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে এবং ইউক্রেনকে নিরস্র ও আমেরিকা-ইউরোপের প্রভাবমুক্ত করার আশা নিয়ে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোর থেকে মিসাইল ছুড়ে ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের শুরু করেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। পূর্ব ইউক্রেনের দোনবাস অঞ্চলে রুশপন্থী বিদ্রোহীদের সহায়তার অজুহাতে এবং ইউক্রেনকে বেসামরিকীকরণ ও নাৎসিকরণ থেকে মুক্ত করতে এই অভিযান করা হচ্ছে বলে জানিয়েছিলেন পুতিন। এর পর থেকে সোমবার (৭ ই মার্চ) পর্যন্ত টানা ১২ দিনের মতো চলছে ইউক্রেন-রাশিয়ার সংঘাত। ইউক্রেনে পুতিন আগ্রাসন চালাতে পারেন, এমন শঙ্কায় পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে গত বছরের শেষ দিক থেকে শুরু হয় দৌড়ঝাপ। এ নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের শীর্ষ নেতারা রাশিয়ার সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন, দিয়েছিলেন কঠোর হুঁশিয়ারি। শেষপর্যন্ত পশ্চিমাদের এতসব উদ্যোগের একটিও পুতিনকে থামিয়ে রাখতে পারেনি ইউক্রেন আক্রমণ থেকে। যুদ্ধ শুরুর আগে অনেক রাষ্ট্রপ্রধান ইউক্রেনে আগ্রাসন না চালাতে পুতিনকে ফোন করে অনুরোধ করেন। এর মধ্যে যেমন রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র তেমনি আছে ভারত, চীন, জার্মানি, ফ্রান্স ও তুরস্কের মতো দেশগুলো।
এদিকে ইউক্রেনে হামলার শুরু হওয়ার পর এখন পর্যন্ত পুতিনের সঙ্গে তিন বার ফোনালাপ করেছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ।এমনকি ফ্রান্সের এই নেতা ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন থামাতে যুদ্ধ শুরুর আগে রাশিয়ায় এসে পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎও করেছেন। তবে ম্যাক্রোঁর কোনো প্রচেষ্টাই পুতিনকে টলাতে পারেনি। ইউক্রেন নিয়ে শুক্রবার (৪ মার্চ) সর্বশেষ পুতিনের সঙ্গে ফোনে ঘণ্টাব্যাপী কথা বলেন জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলৎজ। তবে, এই ফোনালাপও কোনো ইতিবাচক ফল আনতে পারেনি। অন্যদিকে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এপর্যন্ত বেলারুশে রুশ প্রতিনিধি দল ও ইউক্রেনের কর্মকর্তাদের মধ্যে দুই দফায় বৈঠক হয়েছে। তাতেও কোন সমাধান মিলেনি অবশ্য সমাধান যে মিলবেনা তাও একরকম জানত পশ্চিমা বিশ্বের শীর্ষ নেতারা । কারন, রাশিয়ার মূল চাওয়া বা যে বিষয় নিয়ে তার আপত্তি (ইউক্রেনকে ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ না দেওয়া) তাতে পশ্চিমা বিশ্ব কোনভাবেই নজর দিতে বা ভেবে দেখতেও রাজি নয়।
পশ্চিমা বিধি-নিষেধ (অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ) বনাম বিশ্ববাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি -
ইউক্রেনে রুশপন্থী বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত দুই অঞ্চল লুহানেস্ক ও দোনেৎস্ককে স্বাধীনতার স্বীকৃতি ও ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরু করায় রাশিয়ার ওপর বৃষ্টির মত নিষেধাজ্ঞার বর্ষণ শুরু করে পশিমা দেশগুলো। এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন, জাপান, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশ রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। তবে, এ নিয়ে রাশিয়া খুব বেশী চিন্তিত বলে মনে হয়না উল্টো গত শুক্রবার (৪ ঠা মার্চ) হুঁশিয়ারি দিয়েছেন পুতিন। পশ্চিমাদের সতর্ক করে পুতিন বলেছেন, "তার দেশের ওপর আরও বিধিনিষেধ আরোপ করলে পরিস্থিতি বেশি খারাপ হতে পারে"।
পশ্চিমা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার প্রভাব শুধু রাশিয়ার উপরেই পড়বে বা শুধু রাশিয়া ও এর জনগণই ভূগবে এমন নয় বরং এর প্রভাবে ভুগবে পুরো বিশ্ব যা অলরেডি শুরু হয়ে গেছে।ধনী-গরীব সব দেশেই এর প্রভাব পরিলক্ষিত হচচে। আর এই নিষেধাজ্ঞা-যুদ্ধের প্রভাব শুধু একটি পণ্য বা বিষয়ের মাঝে সীমাবদ্ধ নয় বরং তা প্রভাব ফেলছে মানুষের সব রকম নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহ ও বিপননে যা করোনায় বিপর্যস্ত মানুষের নিকট মড়ার উপর খাড়ার ঘা হিসাবে পরিলক্ষিত হচছে ।
ছবি - indiamart.com
১। জ্বালানি পণ্য / তেল-গ্যাস -
রাশিয়ার ওপর পশ্চিমাদের দেওয়া নানা অবরোধের কারণে ইতোমধ্যে এশিয়া-ইউরোপ-আফ্রিকা থেকে আমেরিকা সবখানেই এর প্রভাব পড়া শুরু হয়েছে বিশেষ করে জ্বালানি তেলের দাম ও মূল্যস্ফীতি বাড়ার মধ্যে দিয়ে। অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ১২০ ডলারে উঠেছে। ইউক্রেনে হামলা শুরুর পর অন্তত ২০ শতাংশ বেড়েছে অপরিশোধিত তেলের দাম। প্রায় প্রতিদিনই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে এর দাম। অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক বাজার আদর্শ ব্রেন্টের দাম ব্যারেল প্রতি ১২০ ডলার স্পর্শ করেছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ১২০ ডলারে উঠেছে। ২০১২ সালের পর বিশ্ববাজারে তেলের এই দাম সর্বোচ্চ। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন ঠেকাতে যে দেশটি সবচেয়ে বেশি মাথা ঘামাচ্ছে খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই তেলের দাম ১৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে লক্ষ্য করা গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ব্যারেল প্রতি প্রায় ১১৭ ডলারে উঠেছে। আর তাইতো আমেরিকা শত্রু-মিত্রের ভেদাভেদ ভূলে তেলের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য ভেনেজুয়েলার কাছেও আবেদন করছে যুক্তরাষ্ট্র এবং ভেনিজুয়েলার ওপর থেকে মার্কিন তেল অবরোধ সরিয়ে নেয়ার বিষয়ে মার্কিন ও ভেনেজুয়েলিয়ান কর্মকর্তাদের মধ্যে আলোচনা চলছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস।।
এদিকে পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞার প্রভাব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছেন জ্বালানি ব্যবসায়ীরা। এ কারণে রাশিয়ার অপরিশোধিত জ্বালানি তেল রপ্তানি বড় রকমের প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়েছে। রাশিয়ার রপ্তানি ব্যাহত হওয়ায় জ্বালানি পণ্যটির সরবরাহ সংকট আরো তীব্র হয়ে ওঠার আশঙ্কা করা হচ্ছে। পশ্চিমারা যদিও এখনো রাশিয়ার তেল-গ্যাস রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি কারণ এ খাতে নিষেধাজ্ঞা দিলে বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারে অস্থিরতা আরো প্রকট আকার ধারণ করবে। রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও ঝুঁকি এড়াতে রুশ জ্বালানি পণ্য কেনা বন্ধ রেখেছেন অনেক ব্যবসায়ী আর এরই প্রভাব পড়ছে এর দামে।
পশ্চিমা দেশগুলোর বাকীসব নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে রাশিয়া কিছু না বললেও তেলের নিষেধাজ্ঞার ও এর প্রভাবের ব্যাপারে হুশিয়ারী প্রদান করে রাশিয়ার ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী আলেক্সান্ডার নোভাক বলেন , " রাশিয়ার তেল নিষিদ্ধ করলেই বিশ্ববাজারে তেলের দাম দ্বিগুণ বাড়বে, প্রতি ব্যারেলের জন্য গুণতে হতে পারে ৩০০ ডলার"। এসময় তিনি আরও বলেছেন,"তেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিলে জার্মানিতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেবে রাশিয়া"। নোভাকের দাবি," জার্মানির নর্ড স্ট্রিম-১ গ্যাস পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহে সামঞ্জস্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া, সাথে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার অধিকার রাশিয়ারও আছে"। ইউক্রেন অভিযানের শাস্তি হিসেবে রাশিয়ার তেল আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার প্রস্তাব দেয় যুক্তরাষ্ট্র।এতে অনেক মার্কিন মিত্র এতে সায় দিলেও জার্মানি ও নেদারল্যান্ডস বিষয়টি মেনে নেয়নি।
ছবি - tribuneindia.com
২। গম-ভুট্টা -
তেল ছাড়াও আমেরিকার শিকাগোর বাজারে গমের দাম গত ১৩ বছরের মধ্যে পৌছে গেছে সর্বোচ্চ অবস্থানে । যুদ্ধের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সব কৃষি ও ভোগ্যপণ্যের দাম। যুদ্ধ শুরুর আগেই আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম ছিল ঊর্ধ্বমুখী। এবার যুদ্ধের কারণে এ খাদ্যপণ্যটির দাম আরেক দফা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন আমদানিকারকরা। মানভেদে টনপ্রতি গমের দাম এরই মধ্যে ৪০০ ডলার থেকে বেড়ে ৫০০ ডলার অতিক্রম করেছে। কানাডা থেকে আমদানিকৃত গমের দাম টনপ্রতি ৫২০ ডলারে উঠেছে। ভারতীয় গমের বাজারও ঊর্ধ্বমুখী। সেইসঙ্গে বেড়ে চলেছে ভুট্টার দাম। বিশ্বের মোট গম রপ্তানির ৩০ শতাংশ রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে আসে। ভুট্টা আসে এক-পঞ্চমাংশ। ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এই দুশ দেশের গমের ওপর নির্ভরশীল। তুরস্ক ও মিশর রাশিয়ার গমের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। ইউক্রেনে পুতিনের আগ্রাসন চালানোর কারণে এসব দেশে ইতোমধ্যে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
ছবি - indiamart.com
৩। ভোজ্যতেল ও খাদ্যপণ্য -
গত পনেরো দিনে শুধু সয়াবিন ও পাম তেলের দাম টন প্রতি ৩০০ থেকে ৪০০ ডলার বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে পাম অয়েলের দাম। আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে প্রতি মেট্রিক টন সয়াবিন তেল বেড়ে ১ হাজার ৯৫০ ডলার ও পাম তেল প্রায় ২ হাজার ডলারে উঠেছে। তাছাড়া রাশিয়া ও ইউক্রেন এই দুই দেশ থেকে সূর্যমুখী তেলের বিশ্বের মোট চাহিদার ৮০ শতাংশ রপ্তানি হয় এবং হামলা শুরুর পর থেকে সারা দুনিয়ায় খাদ্যপন্য সহ ভোজ্যতেলের দাম বাড়ছে হু হু করে। সারা দুনিয়ার আমদানী-রপ্তানিকারকদের আশঙ্কা, ইউক্রেন ও রাশিয়ার সংঘাত দীর্ঘ হলে লিবিয়া, ইয়েমেন ও লেবাননের মত সংঘাত পীড়িত ও দরিদ্র দেশগুলোতে খাদ্যপণ্যের দাম আরও বাড়তে থাকবে এবং একই সঙ্গে এসব দেশে খাদ্য সংকট প্রকট আকার ধারন করবে।
ছবি - tribuneindia.com
৪। অর্থনীতি -
রুশ ব্যাংকের ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে বিভিন্ন দেশ আর্থিক কর্মকাণ্ড তথা আমদানী-রপ্তানি সঙ্কটে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আবার, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে কোন দেশ কার পক্ষ নিবে, কিংবা নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকবে এ নিয়ে অনেক রাষ্ট্রই সতর্কতার সঙ্গে পা ফেলছে। আর তাইতো, জাতিসংঘে রাশিয়া-বিরোধী প্রস্তাবে ৩৫টি দেশ ভোটদানে বিরত থেকেছে। ভোট না দেওয়া দেশগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ভারত ও চীন। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার বিষয়ে পুতিনের বিপক্ষে যায় এখন পর্যন্ত এমন কোনো মন্তব্য করেনি চীন। অন্যদিকে ভারতও প্রবল চাপ সত্ত্বেও রাশিয়ার বিরুদ্ধাচরণ ও পুরোপুরি ইউক্রেনের পাশে দাঁড়াবার নীতি নেয়নি ৷আবার ইউক্রেনে রাশিয়া হামলা নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো পরোক্ষ নীরবতা পালন করছে।আর এসব করছেন প্রতিটা দেশ তাদের নিজ নিজ দেশের অর্থনীতি ও স্বার্থের বিষয় মাথায় রেখে।
ছবি - depositphotos.com
৫। স্বর্ণ -
ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধকালীন সংকটের কারণে সারা পৃথিবীতে বেড়ে চলেছে স্বর্ণের দামও। এরই মধ্যে মূল্যবান ধাতুটির দাম বেড়ে এক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠে গেছে। আন্তর্জাতিক বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, যুদ্ধের কারণে বিভিন্ন দেশের মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা দেখা দেওয়ায় নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে মূল্যবান এ ধাতুটির চাহিদা বেড়েছে ফলে বাড়ছে দামও। মার্কেটস ইনসাইডারের তথ্য অনুযায়ী গত বৃহস্পতিবার সোনার দাম ১ দশমিক ৯৮ শতাংশ বেড়ে প্রতি আউন্স বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ৯৭৪ ডলার ৫০ সেন্টে। ব্লুমবার্গ বলছে, ওই দিন স্পট মার্কেটে সোনার দাম ১ দশমিক ১ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় প্রতি আউন্স ১ হাজার ৯৭০ ডলার ৭০ সেন্ট, যা গত এক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
ছবি - unsplash.com
আমাদের দেশের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের পরিস্থিতি -
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম সূত্র অনুযায়ী সূর্যমুখী তেল, ভুট্টা, গম ইত্যাদি খাদ্যপণ্যের বাইরে প্রাকৃতিক গ্যাসেরও বড় রপ্তানিকারক দেশ রাশিয়া। ফলে প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ারও আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদেরা। এর বড় প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপরও। বিশ্বে বিশেষ করে জ্বালানির দাম বাড়লে তার প্রভাব আমাদের দেশের সব ক্ষেত্রেই পড়বে। এমনিতেই জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ফলে খাদ্যপণ্য-যানবাহন, কৃষি-শিল্প - নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সহ সবকিছুর ওপরই এর প্রভাব পড়েছে কিছুদিন আগেই।
বিগত কয়েক মাস ধরেই আমাদের দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে কিছুটা অস্থিরতা চলছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যগুলোর দাম বেড়েছে দফায় দফায়। এর মধ্যে হঠাৎ করে সরকারের জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্তে বাজার পরিস্থিতি অনেকটাই বেসামাল হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের বেশ বড় একটা স্থান দখল করে নিচছে অসহনীয় পণ্যের বাজারের খবর। এ নিয়ে প্রতিদিনই বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যা থেকে সাধারণ মানুষের অসহায়ত্বের বিষয়টি অনুভব করা যায়। নিত্যপণ্যের দামের বর্তমান ঊর্ধ্বগতিতে সব স্তরের মানুষ ভোগান্তিতে পড়লেও সীমিত আয়ের মানুষের জন্য তা অসহনীয় পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। গরিব আছে সংকটে, আর মধ্যবিত্তরা দিশেহারা দ্রব্যমূল্যের চাপে। আর এর মাঝেই শুরু হয়েছে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ।
বাংলাদেশেও ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাবে জিনিষের দাম বাড়ছে হু হু করে। তা শুধু তেল-গ্যাস নয়। ডাল-চাল-তেল সব জিনিষই চলে যাচছে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার নাগালের বাইরে যদিও আন্তর্জাতিক নানা ঘটনাপ্রবাহের কারণে দ্রব্যমূল্য সারা দুনিয়াতেই কিছুটা বেশি। তবে আশার কথা হলো, দ্রব্যমূল্যের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ইতিমধ্যেই সরকার কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে । সোমবার (৭ ই মার্চ ) দুপুরে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির ভাষণে মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, "মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে বৈশ্বিক মন্দা ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে তার সরকার দেশের বাজারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য কিছু নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি মনিটরিং করছে বাজার মনিটরিং করছে"। তিনি আরো বেলন, " এটা একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা, রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করেছে। যার কুফলটা আমরা ভোগ করছি। আমাদের এখানে কিছু জিনিসের দাম বাড়ছে কারণ, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে গেলে স্বাভাবিকভাবে এখানেও তার প্রভাবটা পড়ে " ।
ছবি - unsplash.com
১। চাল -
বাংলাদেশের চালের যোগানের একটা বড় অংশ আসে আমন মৌসুমে । আর তাই আমন মৌসুম শেষে বাজারে নতুন চাল আসায় দাম কমার কথা, কিন্তু এবার তা কমেনি। যদিও মিলপর্যায় থেকে শুরু করে পাইকারি আড়ত ও খুচরা বাজারে চালের মজুত পর্যাপ্ত আছে এবং থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে বস্তা। তবুও কয়েক মাস ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সব ধরনের চালের দাম। সর্বশেষ এক মাসের ব্যবধানে মোটা চালের দাম কেজিতে তিন-পাঁচ টাকা বেড়ে ৫০-৫২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে যাতে করে দুর্ভোগে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ।
২। ভোজ্য তেল -
আমাদের দেশে সম্প্রতি তেল নিয়ে শুরু হয়েছে তেলেসমাতি কারবার । গত কয়েকদিনে ভোজ্য তেলের দাম বাড়ার পাশাপাশি বাজার থেকে উধাও হয়ে গেছে খোলা তেল। বাজার থেকে খোলা তেল উধাও হয়ে চরম দরিদ্র ও দরিদ্রদের কথা বাদ, মধ্যবিত্তেরও নাগালের বাইরে চলে যাচছে ভোজ্য তেল। হঠাত করেই রাজধানীর কোনো কোনো বাজার থেকে খোলা সয়াবিন তেল উধাও হয়ে গেছে। আবার বোতলজাত সয়াবিন তেল পাওয়া গেলেও তা সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে অনেক বেশিতে বিক্রি হচ্ছে। সরকারের বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশও (টিসিবি) তাদের নিত্যপণ্যের বাজারদরের প্রতিবেদনে বাজারে খোলা সয়াবিন তেল না পাওয়ার বিষয়টি জানিয়েছে। এছাড়া বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও স্বীকার করছে, চাহিদার তুলনায় দোকানে সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে না। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর বলছে, সয়াবিন মিলার, আমদানিকারক কোম্পানি এবং পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা মিলে তেল মজুদ করে রাখার কারণেই মূলত খুচরা পর্যায়ে তেলের কৃত্রিম সংকট দেখা দিয়েছে। আমাদের দেশে ভোজ্য তেলের বাজার প্রায় পুরোটাই আমদানি নির্ভর। তাই বিশ্ববাজারে সয়াবিন, পাম অয়েলের দাম বাড়ায় দেশের বাজারেও দাম বাড়বে এটাই স্বাভাবিক তবে বর্তমানে আমাদের দেশে তেল নিয়ে যা হচছে তাকে কোন মতেই স্বাভাবিক বলা যাবেনা।
ছবি - istockphoto.com
৩। গ্যাস -
চলতি বছরে দ্বিতীয়বারের মতো বাড়ানো হয়েছে এলপিজি গ্যাসের দাম। গত মাসের চেয়ে ১৫১ টাকা বাড়িয়ে চলতি মার্চ মাসের জন্য ১২ কেজির এক সিলিন্ডার গ্যাসের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১ হাজার ৩৯১ টাকা। দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে ইউক্রেন সংকটকে দায়ী করছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন। রান্নার জ্বালানি গ্যাস (এলপিজি) ২০১৯ সালে ১২ কেজির প্রতি সিলিন্ডারে ব্যয় হতো ৮৫০ টাকায়। এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসে তার দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ১ হাজার ২৪০ টাকা।
ছবি - gettyimages.ae
৪। পেয়াজ -
গত কিছুদিন যাবতই দেশে পেঁয়াজের দাম বেড়েই চলছে কারন হিসাবে বলা হচছে, ভারত থেকে আমদানি কম হওয়াকে । ফলে মানভেদে পাইকারিতে কেজি প্রতি ১০-১২ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে। এ কারণে খুচরা বাজারে বেড়েছে ১৪-১৫ টাকা। গত বুধবার ও বৃহস্পতিবার আমদানি করা পেঁয়াজ ৩৮-৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও এখন সেই পেঁয়াজ বিক্রি হচছে ৫০ টাকা দরে। এদিকে দেশি পেঁয়াজও বিক্রি হচ্ছে ৫৫-৬০ টাকায়।
ছবি - pasturespoultry.co.uk
৫। ডিম -
রাজধানী সহ সারা দেশেই বেড়েছে ডিমের দাম। খুচরা বাজারে প্রতি পিস ফার্মের মুরগির ডিম ১০ টাকা, হালি ৪০ টাকা আর ডজন বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকায় যার দাম আরও বাড়তে পারে বলে মনে করছেন পাইকাররা। মাছ - মাংস অনেক আগে থেকেই নিম্নবিত্তের নাগালের বাইরে। এখন মাছ-মাংসের পর ডিমও চলে যাচ্ছে নিম্নবিত্তের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে।
এছাড়াও মানুষের আরও কয়েকটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য হলো মসুর ডাল,আটা,চিনি। এসবের দামও বাড়ছে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে।
কাঁচাবাজারেও কোন সুখবর নেই গরীব- নিম্নবিত্তের জন্য।একটি মোটামুটি মানের লাউয়ের দাম একশ টাকা।ফুলকপির দাম আকার- প্রকার ভেদে ৪০-৫০-৬০ টাকা। গোল আলুর দামও ৩০-৩৫ টাকা ,টমেটো ৫০ টাকা। বেগুন যদিও ৭০-৮০ টাকায় এখনো মিলে তবে রোজায় এর দাম কোথায় গিয়ে দাড়াবে তা কেউ বলতে পারবে না। এদিকে বাণিজ্যমন্ত্রী বলছেন, কাঁচাবাজারের দাম নিয়ন্ত্রণ তো আমার কাজ নয়, তাহলে কে নিয়ন্ত্রণ করেন কাঁচাবাজার? ব্যবসায়ীরা ? কৃষিমন্ত্রী? নাকি খাদ্যমন্ত্রী?
৬। রেমিট্যান্স -
বিগত দুই বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন রেমিট্যান্স এসেছে গত মাসে (ফেব্রুয়ারি - ২০২২)। এ মাসে ১৪৯ কোটি ৬০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। যা টাকার হিসাবে (১ ডলার ৮৬ টাকা ধরে) ১২ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা। জানুয়ারিতে ১৭০ কোটি ৪৩ লাখ ডলার বা ১৪ হাজার ৬০০ কোটি টাকা রেমিট্যান্স এসেছিল।( তথ্য সূত্র-বাংলাদেশ ব্যাংক)। করোনা ভাইরাসের কারণে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ভাটা পড়ে গেছে। আর তারই প্রভাব পড়ছে সব চেয়ে বেশী বৈদেশিক মুদ্রার যোগানদার প্রবাসী আয় তথা রেমিট্যান্স এ।
৭। দেশে বাড়তে পারে ডলারের দাম -
বিশ্বব্যাপী এখনো রয়েছে করোনা মহামারির রেশ এবং এ মহামারী শেষ কবে হবে কেউ জানে না। এরই মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় নতুন মাত্রা যোগ করছে। ইউক্রেনের ওপর হামলার জের ধরে এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপানসহ একাধিক দেশ রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, যার বেশির ভাগই অর্থনৈতিক। বিশ্বব্যবস্থার এই পরিবর্তনের প্রভাব পড়বে বাংলাদেশেও, যাতে বৈদেশিক মুদ্রা - বিশেষ করে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের বাজারে ডলারের দাম বাড়তে শুরু করেছে। আর ডলারের দাম বাড়লে আমদানিকারদের গুনতে হবে বাড়তি অর্থ। তাতে বেড়ে যাবে আমদানি ব্যয় আর এর প্রভাবও পড়বে গ্রাহক পর্যায়ে নিত্যপণ্যের দামে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে একটি অনিশ্চয়তার দিকে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক পণ্যের মার্কেট। এর প্রভাব কিছুটা পড়ছে এবং পড়বে আমাদের দেশের বাজারেও। তারা এও বলছেন, পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, সেখানে দাম সমন্বয় করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই বরং বিশ্ববাজারের তুলনায় এখনো আমাদের দেশে অনেক পণ্যের দাম কম আছে। বাজার অর্থনীতির নিয়ম অনুসারে সাধারণত সারা বিশ্বে দ্রব্যমূল্যের হ্রাস-বৃদ্ধির বিষয়টি নির্ভর করে বাজারে পণ্যের চাহিদা ও সরবরাহের ওপর। কিন্তু বর্তমানে আমাদের দেশে বাজার অর্থনীতির এ নিয়ম পুরোপুরি খাটছে না। কিছু পণ্যের পর্যাপ্ত আমদানি ও বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকলেও কোন কারন ছাড়াই তা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে যার পিছনে হয়ত কাজ করছে বাজার সিন্ডিকেট অথবা অসাধু চক্র। আবার কখনো কখনো তারা পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে নানা অজুহাতেও দাম বাড়িয়ে দেয় । আর এখন আবার দিচছে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের অযুহাত। এমনিতেই গত দুই বছর যাবত পুরো বিশ্বের অর্থনীতি ধুকছে এবং মানুষের আয় রোজগার কমে গেছে,বন্ধ হয়ে গেছে অনেক এয়ারলাইনস সহ নানা কল-কারখানা। কাজ-কর্ম হারিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে পাইলট-শিক্ষক সহ সব শ্রেণী-পেশার কোটি কোটি মানুষ। এর মাঝেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও পশ্চিমা অবরোধে। আর তাই সাধারন মানুষের জন্য এখন কোটি টাকার যে প্রশ্ন ,"রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারনে ও পশ্চিমা অবরোধের প্রভাবে কি শুধু পুতিন-রাশিয়াই ডুববে নাকি সারা দুনিয়ার দরিদ্র-গরীব-মধ্যবিত্তরাও তাদের সাথে সাথে ডুবে মরবে দ্রব্যমূল্যের যাতাকলে পিষ্ঠ হয়ে"?
তথ্যসূত্র - বিবিসি, রয়টার্স, ডয়চে ভেলে, আল-জাজিরা, দৈনিক ইত্তেফাক (০৩ মার্চ ) ও নয়া দিগন্ত (০৭ মার্চ)।
=====================================================
পূর্ববর্তী পোস্ট -
"রাশিয়া - ইউক্রেন যুদ্ধ" - (১ ম পর্ব) Click This Link
এবং
" ইউক্রেন সংকট " - (শেষ পর্ব) - Click This Link
" ইউক্রেন সংকট " - ২ য় পর্বের লিংক - Click This Link
" ইউক্রেন সংকট " - ১ ম পর্বের লিংক - Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মার্চ, ২০২২ দুপুর ১:৫৮