ক্রিকেট, ফুটবল আর রাজনীতিতে কে কোন দল সাপোর্ট করবে সেটা মোটামুটিভাবে পারিবারিক ভিত্তিতেই নির্ধারিত হয়। পরিবারের বড়রা যে দল সাপোর্ট করে ছোটোরাও মোটামুটি সিওর সেই দলই সাপোর্ট করে। বুঝেই হোক আর না বুঝেই হোক।
আমার আব্বাজান ফুটবলে আর্জেন্টিনার ক্রেজি সাপোর্টার। আমার আম্মাজানও তাই। ১৯৮৬ তে ম্যারাডোনার জাদুতে তারা উভয়ই সম্মোহিত। শুনলাম আব্বাজান নাকি এবার বাড়ির ছাদে আর্জেন্টিনার এক বিরাট পতাকা লাগাইসেন। কয়েকদিন আগে আম্মাজান আমাকে ফোন করে আর্জেন্টিনার জন্য দোয়া করতে বললেন। আমিও তাঁর কাছে ব্রাজিলের জন্য দোয়া চাইলাম। ফ্যামিলিতে ব্রাজিল আর্জেন্টিনার মিউচুয়াল সাপোর্টিং চলতেসে। দেখা যাক কার দোয়ার কত জোর।
১৯৯৮ সাল। ক্লাস থ্রিতে পড়ি তখন। আব্বাজান বিশ্বকাপ দেখার জন্য নতুন কালার টিভি কিনে আনলেন। সনি ট্রিনিটন, ৪ বছর গ্যারান্টি। মজায় মজা। আব্বা আম্মার মত আমরা ছোট দুই ভাইবোনও আর্জেন্টিনার সাপোর্টার। যদিও তখন ৩ নম্বর ডিয়ার বলে শট মারা ছাড়া ফুটবলের ফ-ও বুঝতাম না। কিসের অফসাইড, কিসের ফাউল, কিসের কার্ড, কিসের রেফারি; এগুলা কিছুই বুঝতাম না। একদিন তো আব্বাজান কে জিজ্ঞেসই করছিলাম “ আব্বু, ঐ যে বাঁশি বাজায় প্লেয়ারটাকে কেউ বল দেয় না ক্যান? খালি দৌড়ায়”। এই ছিল আমার তৎকালীন ফুটবল জ্ঞান।
যাহোক, আমি ছিলাম আর্জেন্টিনার দুর্দান্ত সাপোর্টার। বাতিস্তুতা, ওর্তেগা, ভেরন ছিল সেবার আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের কান্ডারি। আমার রিয়েল হিরোস।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হওয়াতে অপু ভাইয়া চলে আসলেন বাড়িতে। ব্রাজিলের সাপোর্টার । তাঁর বাবা মোঃ আজিজ খান আমাদের ছোট্ট শহর পার্বতিপুরের বলতে গেলে একমাত্র ফ্রান্সের সাপোর্টার। বেশ রাশভারী লোক। তাঁর এই ফ্রান্স প্রীতির কারণটা হল তিনি বছর কয়েক আগে ফরেন ট্রেনিং-এ ফ্রান্সে গিয়েছিলেন। সেই থেকে তাঁর ফ্রান্সের প্রতি ভালবাসা। কে জানত ১৯৯৮ এর বিশ্বকাপে শেষ হাসিটা মোঃ আজিজ খান-ই হাসবেন।
যাহোক, অপু ভাইয়া লোকটা অনেক ভাল। আমাকে অনেক আদর করতেন। চকলেট লজেন্স খাওয়াইতেন। খেলতেনও আমাদের সাথে। সেই অপু ভাই একদিন ইত্তেফাক পেপারে বিশ্বকাপ ট্রফির ছবি দেখিয়ে আমাকে বললেন,
- জিনিসটা সুন্দর না?
- হুম, অনেক সুন্দর।
-জানিস এটা কার?
-কার আবার? আর্জেন্টিনার।
-আরে না। এটার মালিক এখন ব্রাজিল। সবচেয়ে ভাল টিম।
- না, আর্জেন্টিনা সবচেয়ে ভাল টিম।
-ধুর, আর্জেন্টিনা তো হারু পার্টি। গোল খায় আর হারে।
- আর্জেন্টিনার ম্যারাডোনা আছে । অনেক গোল দেয়।
-হে হে হে, ম্যারাডোনা এখন আর খেলেনা। বুড়া হয়ে গেসে। এখন আর্জেন্টিনা খালি গোল খায়। হারু পার্টি।
অপু ভাইয়া আমাকে হারু পার্টি বলে ক্ষ্যাপাতে শুরু করলেন। আমিও পাল্টা জবাব দেয়া শুরু করলাম।
- ব্রাজিলে কে আছে? ব্রাজিল গোল খায়।
- কম কম খায়। আর্জেন্টিনা বেশি খায়। হারু পার্টি।
তারপর অপু ভাইয়া রোনাল্ডোর ছবি বের করে বললেন,
- এ কে চিনিস?
- না।
- এর নাম রোনাল্ডো। ম্যারাডোনার মত। অনেক ভাল প্লেয়ার।
- ম্যারাডোনার মত?
- অনেক আগে ম্যারাডোনা যখন আর্জেন্টিনায় খেলত, তখন আর্জেন্টিনা ভাল টিম ছিল। এখন ম্যারাডোনা নাই, আর্জেন্টিনা পচা। হারু পার্টি। এখন ব্রাজিলে রোনাল্ডো আছে। ব্রাজিল ভাল টিম। এবার বিশ্বকাপ নেবে।
- তাই?
- হুম। বিশ্বকাপ যদি জিততে চাস তাহলে ব্রাজিল সাপোর্ট কর। তা নাহলে সবাই তোকে হারু পার্টি বলে ক্ষ্যাপাবে। হারু পার্টি। হারু পার্টি।
- না । আর্জেন্টিনাই ভাল।
- ব্রাজিল সাপোর্ট করলে আইচক্রিম খাওয়াব। কাপ আইচক্রিম।
এই যা, অপু ভাই টোপ ফেললেন। আমি আর না গিলে পারি? তারপরও চিন্তা করলাম, “ আর্জেন্টিনায় তো রোনাল্ডো নাই। আর্জেন্টিনা তো তাহলে বিশ্বকাপ জিততে পারবে না। আর ব্রাজিল সাপোর্ট করলে কাপ আইচক্রিম আর বিশ্বকাপ দুইটাই পাওয়া যাবে। তাহলে ব্রাজিলই সাপোর্ট করি”। বাচ্চা ছেলে আমি কাপ আইচক্রিমে অটো কনভেন্সড হয়ে আর্জেন্টিনা থেকে ব্রাজিলের সাপোর্টার হয়ে গেলাম।
দুর্দান্ত ফর্মে থাকা রোনাল্ডো, রিভালদো, রবার্তো কার্লোস, কাফু ব্রাজিল কে ফাইনালে নিয়ে নিয়ে গেল। আমি তো মুগ্ধ হয়ে গেলাম। আর্জেন্টিনা তো আগেই বাদ। ভাগ্যিস অপু ভাইয়া আমাকে ব্রাজিলের সাপোর্টার হতে বলছিলেন। তা নাহলে তো সবাই আমাকে হারু পার্টি বলে ক্ষ্যাপাতো। বেঁচে গেসি। বন্ধু মহলে ব্রাজিল ব্রাজিল করে বিরাট তাপ নিতাম। এই তাপ নেয়ার দরুন বন্ধু নিলয় আমার শত্রু হয়ে গেল।
১৯৯৮ ফিফা বিশ্বকাপ ফাইনাল। ব্রাজিল বনাম ফ্রান্স। মাহেন্দ্রক্ষণ। গভির রাতে খেলা। বিশ্বকাপ জেতার উত্তেজনায় আমার ঘুম ধরে না। কিন্তু খেলা শুরুর আগে অপু ভাইয়াদের বাসায় বিপত্তি ঘটে গেল। বাপ বেটার যুদ্ধ। ফ্রান্সের সাপোর্টার মোঃ আজিজ খান ও তাঁর ছেলে ব্রাজিলের সাপোর্টার মোঃ আশিক খান অপুর মধ্যে খেলা নিয়ে কিঞ্চিত গণ্ডগোল হওয়ায় অপু ভাইয়া আমাদের বাড়িতে খেলা দেখতে আসলেন। আমার আনন্দ দেখে কে? আমার মাস্টার, আমার পাইওনিয়ার অপু ভাইয়ার সাথে একসাথে বসে ব্রাজিলের বিশ্বকাপ জেতা দেখব এর চেয়ে আনন্দ কি হতে পারে। কিন্তু সময়টা ছিল সেদিন খুব খারাপ সেটা জানা ছিল না।
খেলা আরম্ভ হল। আম্মাজান মুড়ি মেখে দিলেন। খাচ্ছি আর খেলা দেখছি। কিন্তু হায়, সুখ আর বেশিক্ষণ থাকল না। জিনেদিন জিদান ঢিক ঢিক করে দুই দুইটা গোল ঢুকায় দিল ব্রাজিলের জালে ফার্স্ট হাফেই। যেই গোল হয় তখনই পাশের বাড়ি থেকে মোঃ আজিজ খানের চিল্লানি শোনা যায়, “ গো ও ও ও ও ও ল”।
সর্বসাকুল্যে তিনটা গোল খেয়ে গো হারা হারল ব্রাজিল। আমার অশ্রুসিক্ত নয়ন, অপু ভাইয়ার বাকরুদ্ধ চেহারা, আব্বা আম্মার মুচকি মুচকি হাসি এই তিনে মিলে ঘরের মধ্যে দোজখময় পরিবেশ। অনেক কেঁদেছি সেদিন। কেঁদেছি বলেই ব্রাজিলের প্রতি ভালবাসা আমার সেদিনই পোক্ত হয়েছে।
পরেরদিন শত্রু নিলয় আমাকে পেল। কথায় কথায় দিল আচ্ছা ধোলাই। স্কুলে, খেলার মাঠে, রাস্তাঘাটে। বাচ্চা ছেলে আমি কি আর এত অপমান সহ্য করতে পারি? কষ্টে আমার বুক ফাটে। ঠিক সেই মুহূর্তেই আমাকে সান্তনা দিতে এগিয়ে এলেন ব্রাজিলের আরেক সাপোর্টার রবিউল ভাইয়া। তিনি এসে বললেন,
-ইমন, মন খারাপ করিস না। আমি একটা ছড়া লিখেছি। কেউ যদি তোকে ক্ষ্যাপায় তাহলে এই ছড়াটা বলবি। আচ্ছা?
- কি ছড়া?
-“ সুজানা সুজানা, তুমি আর কেঁদোনা/ ২০০২ সালে আমি তোমায় এনে দেবো কাপের মত খেলনা”।
- সুজানা কে?
-রোনাল্ডোর বউ।
রবিউল ভাইয়ের ছড়াটা সত্যি সত্যিই মিলে গেসে ২০০২ সালে । রোনাল্ডো তাঁর বউ সুজানার হাতে বিশ্বকাপ তুলে দিয়েছিল কি না জানিনা তবে আমার মত কষ্ট পাওয়া সাপোর্টারদের দিয়েছিল বাঁধভাঙ্গা আনন্দ। এই আনন্দের কোন সংজ্ঞা নেই।
১৯৯৮ থেকে ২০১৪। মাঝখানে চলে গেছে ১৬ টি বছর। অপু ভাইয়ার দুটি ছেলে হামিম আর তামিম। জানি ওরাও ব্রাজিলের সাপোর্টার। হয়ত পিচ্চি হামিম তামিম তাদের দাদু মোঃ আজিজ খানের সাথে ফ্রান্স ব্রাজিল নিয়ে ঝগড়া করছে। অনেক দিন অপু ভাইয়াকে দেখি না। রবিউল ভাইয়াও কোথায় আছে জানিনা। আমিও অনেক বড় হয়ে গেসি।
আমার আব্বাজানের কথাই বলি। কত সখ করে টাকা ধার করে সনি ট্রিনিটন কালার টিভিটা কিনেছিলেন। আশা ছিল এই টিভিতেই আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয় দেখবেন। বয়সের ভারে নুহ্য টিভিটা নষ্ট হয় হয় অবস্থা। কতবার বলেছি নতুন একটা টিভি কিনতে। আব্বা কেনেন না। এটাতেই হয়ত তিনি আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয় দেখতে আশায় বুক বেঁধেছেন এবারও। সখ করে কষ্ট করে কেনা টিভিতে প্রিয় দলের বিশ্বকাপ জয় দেখে আনন্দে আত্মহারা হোক আমার আব্বাজান। মেসি, ডি মারিয়া যে করেই হোক আর্জেন্টিনাকে কাপ জেতাও। আমার আব্বার কেনা টিভিটা যে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


