somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ধারাবাহিক সায়েন্স ফিকশান উপন্যাস: নিউক (পর্ব দুই)

০২ রা জুন, ২০২০ সকাল ১১:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


তৃতীয় অধ্যায়

ছোট এই কক্ষের চারদিকটায় তাকিয়ে দেখছিল নিউক। চারদিক কাচ দিয়ে ঘেরা, সামনের কাঠের টেবিলটা সম্প্রতি বার্ণিশ করা হয়েছে, চকচক করছে। চকচকে টেবিলে প্রতিফলিত হয়ে আছে টেবিলটাকে ঘিরে থাকা কয়েকজন অস্ত্রধারী রোবট এবং তরুণী মুখমণ্ডল, তারা সবাই দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখোমুখি বসে আছে একজন কুৎসিত চেহারার মহিলা, মহিলাটির চেহারায় অসংখ্য দাগ, চুলগুলো নাভির কাছে ঠেকেছে, চোখে চশমার মত কিছু একটা পরে আছে। নিউকের কেমন জানি চেনা চেনা লাগছে মহিলাটিকে। পরক্ষনেই মনে পরল, একে সে দেখেছে আজ সেই বিদ্রোহী তরুণীকে ধরে নিয়ে যাবার সময়। ইনি বিজ্ঞান পরিষদের প্রধান জেনারেল গ্রাটিয়া। তখন দূর থেকে দেখতে যেমন লাগছিল এখন কাছ থেকে আরো বেশী ভয়ানক লাগছে। জেনারেল গ্রাটিয়া বেশ গম্ভীর মুখ নিয়ে নিউকের সামনে বসে আছে। কেউ কোন কথা বলছে না, একটি পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে চারদিকে, যেন নিজের নিঃশ্বাসের শব্দও কানের কাছে জোরে এসে আছড়ে পরে।

টেবিলটার চারদিকে ঘিরে থাকা বিচিত্র ধরনের পোশাক পরা মেয়ে এবং রোবটগুলো আড় চোখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল নিউককে। সামান্য ভীতির এবং অস্বস্তির একটা কুণ্ডলী পাকানো অনুভূতি পেটের টের পায় নিউক।

নীরবতা ভেঙে জেনারেল গ্রাটিয়া জেরা করা শুরু করল। মুখে যথাসম্ভব গাম্ভীর্য এনে বলে “এই গ্রহে কোন পুরুষ মানুষ নেই, পুরুষ মানুষের বিলুপ্তি হয়েছে সেই দুহাজার বছর আগেই। তুমি ব্যাপারটাকি একটু খোলাসা করবে? ”

“আমি এই বর্তমান সময়ের মানুষ নই, আমার জন্ম প্রায় চার হাজার বছর আগে! ঘুমিয়ে ছিলাম এত বছর।” বলেই একটি ছোট্ট করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে নিউক।

"আমার জন্মও এখনকার সময়ে নয়। গত পাঁচ হাজার বছর ঘুমিয়ে ছিলাম। জেগে থাকতে ভাল লাগে না। দেখি এপার্টমেন্টে গিয়ে আর এক দুই লাখ বছরের জন্য একটা ঘুম দিতে হবে!” হালকা চালে বলে জেনারেল গ্রাটিয়া।

জেনারেল গ্রাটিয়ার হালকা রসিকতায়ও চারদিকে দমকা হাসির বন্যা বয়ে গেল। টেবিলটাকে ঘিরে থাকা ভয়ানক অস্ত্রধারী তরুণী এবং রোবটগুলো হেলে-দুলে হাসছে।

"জেনারেল গ্রাটিয়া আপনি যদি সত্যটা জানতে চান তাহলে আমার কথা আগে শুনুন। আপনি কথার মাঝখানে এরকম করলেতো আর কিছু বলতে পারব না।

এবার জেনারেল গ্রাটিয়া হাত শূন্যে উঠিয়ে সবাইকে হাসি থামানোর নির্দেশ দিলেন। মেরুদণ্ড সোজা করে বসে গম্ভীর গলায় বলে “আমার কাছে ফালতু সময় নেই! দিন-রাত আঠার ঘণ্টা ব্যস্ত থাকতে হয়, আমার সময় নষ্ট করবে না। ঠিকঠাক করে সব কিছু খুলে বল।”

নিউক জেনারেল গ্রাটিয়ার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলে “আমি এত দিন ক্রোয়োনিক টিউবে ঘুমন্ত অবস্থায় ছিলাম, দুইদিন আগে ঘুম থেকে উঠেছি।”

“মনে মনে প্রচণ্ড আশ্চর্য হয় জেনারেল গ্রাটিয়া, তবে সেটা গোপন করে চোখে মুখে প্রশ্নবোধক চিহ্ন ফুটিয়ে তুলে জিজ্ঞেস করল সেটা কিভাবে সম্ভব?”

“ক্রোয়োনিক এক্সপেরিমেন্ট সম্পর্কে নিশ্চয়ই আপনি জানেন?”

উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলতে শুরু করে নিউক “মাছ মাংস যেমন ফ্রিজিং করে রাখা যায়, আস্ত মানুষকেও ফ্রিজিং করে রাখার প্রযুক্তির নাম হচ্ছে এই ক্রয়োনিক এক্সপেরিমেন্ট। ক্রোয়োনিক এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে কাউকে ফ্রিজিং করে রাখলে তার বয়স বাড়ে না, যেমন আমাকে ফ্রিজিং করার সময় যেই বয়স ছিল আজ চার হাজার বছর পরেও সেই একই বয়স। আমার বয়স এই চার হাজার বছরে একচুলও বাড়েনি।”

“এটা কিভাবে সম্ভব? তাছাড়া তুমি কোথায়ইবা ফ্রিজিং অবস্থায় ছিলে এতদিন, আমাদের চোখে পরেনি কেন? মানুষের মত বহুকোষী প্রাণীকে ফ্রিজিং কিভাবে সম্ভব? মস্তিষ্ক পুনরায় সচল হল কিভাবে?” নিজের স্বভাবের বাইরে গিয়ে এক নিশ্বাসে গরগর করে প্রশ্ন করে যায় জেনারেল গ্রাটিয়া। তার ভয়ানক চেহারাটা আরো ভয়ানক হয়ে উঠে। কাচের আড়ালের চোখদুটি আরো বেশী তীক্ষ্ণ হয়ে উঠে।

“মূল শহর থেকে উত্তর পশ্চিম দিকে আরেকটি অরণ্য আছে যেখানে আমি এতদিন ঘুমন্ত অবস্থায় ছিলাম। একটি ছোট কাচের ক্রোয়োনিক টিউবে ছিলাম পুকুরের নিচে। হঠাৎ দুদিন আগে আমার টিউবটি খুলে যায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে এবং টিউটি ভেসে পানির উপর চলে আসে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল এই স্বয়ংক্রিয় টিউবটি ন্যূনতম দশ হাজার বছর পরে খোলার কথা, সেভাবেই এটাকে ডিজাইন করা হয়েছিল। এটা চার হাজার বছর পরে কেন খুলল সেটা আমি ঠিক জানিনা। এর পিছনে কেউ আছে নাকি কাকতালীয়ভাবে খুলেছে সেটাও আমার কাছে বিস্ময়, যাইহোক তারপর এই দুইদিন আমি শহরে ঘুরাঘুরি করি আর বাকিটা-তো আপনারা জানেনই।” বলে নিউক।

জেনারেল গ্রাটিয়াকে দেখে বুঝার উপায় নেই কতটা বিস্ময় সে মনের মাঝে চেপে রেখেছে। নিজের চেয়ারের ডান দিকে মাথাটা কাত করে আছেন তিনি। পুনরায় একই প্রশ্ন করে জেনারেল গ্রাটিয়া “ক্রোয়োনিক এক্সপেরিমেন্ট কি একটু খুলে বলবে?”

নিউক একটু দম নিয়ে বলতে শুরু করে “আমাদের সময়ের বিজ্ঞানও কিন্তু খুব একটা পিছিয়ে ছিল না, হ্যাঁ আপনাদের মত এত এডভান্স রোবট ছিল না কিন্তু আমাদের সময় মাত্র রোবটের বুনিয়াদ হচ্ছে। তার উপর দাড়িয়েই আপনাদের আজকের এই সভ্যতা। বুঝলেন?” বেশ গর্ব ঝরে পরে নিউকের গলায়।

ঈষৎ বিরক্ত হয় জেনারেল গ্রাটিয়া।

থেমে বলে আবার নিউক “আপনি নিশ্চয়ই জানেন এক কোষী প্রাণী কয়েক মিলিয়ন বছর পর্যন্ত ফ্রিজিং অবস্থা টিকে করতে পারে। এই ব্যাপারটা আমাদের বিজ্ঞানীদের ভাবতে সাহায্য করে, তারা চিন্তা করল মাছ মাংস যদি ফ্রিজিং অবস্থায় থাকতে পারে কোন-পরিবর্তন ছাড়াই, এক কোষী প্রাণীও যদি কয়েক মিলিয়ন বছরে ফ্রিঞ্জিং অবস্থায় থাকতে পারে, তাহলে মানুষ পারবে না কেন ফ্রিজিং অবস্থায় থাকতে?”

বেশ নড়েচড়ে বসে জেনারেল গ্রাটিয়া, গম্ভীরভাবে বলেন “হুম প্রাচীন কালে সেই উনবিংশ শতাব্দীতেই এটা নিয়ে লেখালেখি হয়েছিল, তবে আমি ভাবতাম এগুলো সেই কল্প কাহিনী পর্যন্তই সীমাবদ্ধ! কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব? মানুষের শরীরে-তো প্রায় ৭০ শতাংশ পানি, তাছাড়া রক্তও তরল জাতীয়, ফ্রিজিং করলে-তো বরফ জমে মৃত্যু হবার কথা!”

“হুম তা ঠিক, তবে আমাদের বিজ্ঞানীরা এই সমস্যাগুলো বিবেচনা করে তিনটি ধাপে এই সমস্যার সমাধান করে এক্সপেরিমেন্ট সফল করেন, একটি ক্রোয়োনিক টিউবটি এমনভাবে ডিজাইন করা হয় যাতে যন্ত্রটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। প্রথম ধাপে মানুষের শরীরের প্রতিটা কোষ থেকে বিশেষ উপায়ে পানি বের করে ফেলা হয়, দ্বিতীয় ধাপে রক্তে এক ধরনের ইনজেকশন পুষ করা হয় যেটা রক্তকে ফ্রিজিং না করেই সতেজ রাখে, এবং সর্বশেষ ধাপে পুরো শরীরকে ফ্রিজিং করা হয়।”

“এখন ছয় হাজার আশি সাল, তার মনে তোমাকে যখন ফ্রিজিং করা হয় তখন দুই হাজার আশি সাল ছিল! পৃথিবীতে এরকম একটি সত্যিকার এক্সপেরিমেন্ট হয়েছিল চার হাজার বছর আগে কিন্তু তার তথ্য আমাদের থেকে কিভাবে এড়িয়ে গেল?” বেশ বিস্ময়ের সাথে বলল জেনারেল গ্রাটিয়া।

“হুম, আপনি ঠিকই ধরেছেন আমি দুই হাজার আশি সালের মানুষ। এই এক্সপেরিমেন্টটি খুব গোপনে করা হয়েছিল, এটা আমদের সময়ের কেউই জানত না, কারণ এই ভয়ংকর এক্সপেরিমেন্টের কথা জানাজানি হলে হিউমেন রাইট সংস্থাগুলো বাধা দিত, বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, মিডিয়া জনগণের মন বিষিয়ে তুলে এটাকে নিষিদ্ধ করিয়ে ছাড়ত, এর জন্যই অত্যন্ত গোপনে এই এক্সপেরিমেন্ট হয়েছিল যেন কাক-পক্ষীও জানতে না পারে। এই এক্সপেরিমেন্টের সমস্ত ডকুমেন্ট পর্যন্ত নষ্ট করা হয়েছিল।”

নিচের ঠোটটি সামনে ঠেলে দিয়ে হুম বলে জেনারেল গ্রাটিয়া।

আমাকে একটি প্রশ্নের উত্তর দিবেন “এই সমাজে কোন পুরুষ মানুষ নেই, তাহলে কিভাবে চলছে এই সমাজ! মানে বংশগতির ধারা কিভাবে বয়ে চলছে!” চোখেমুখে দ্বিধা ফুটিয়ে উঠে নিউকের।

চেয়ারটাতে হেলান নিয়ে মাথা পিছন দিকে কাত করে জেনারেল গ্রাটিয়া, যেন খুব অপ্রয়োজনীয় এবং তুচ্ছ একটি প্রশ্ন করেছে নিউক।

নাটকীয়তা করে বলে “বংশগতির ধারা বজায়ের জন্য কেন পুরুষ মানুষ দরকার?”

নিউক কি বলবে ঠিক বুঝতে পারে না। বেশ দ্বিধান্বিত দেখায় নিউককে! চোখে মুখে বিস্ময় ফুটিয়ে তোলে।

একটু থেমে উত্তরের অপেক্ষা না করে বলে চলে জেনারেল গ্রাটিয়া “প্রায় বাইশ-শত বছর আগেই পুরুষ মানুষ ছাড়া বিজ্ঞানীরা বাচ্চা জন্ম দেবার প্রযুক্তি আবিষ্কার করে ফেলে। বাচ্চা জন্মের জন্য একটি শুক্রাণু এবং একটি ডিম্বাণুর প্রয়োজন হয়, এই ডিম্বাণু শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত হবার পরই তৈরি হয় মানব ভ্রূণ তথা নবজাতক। প্রায় বাইশ-শত বছর আগে মেয়েদের স্টেম সেল থেকে ডিম্ভানু তৈরি করে ফেলে বিজ্ঞানীরা এবং ল্যাবরেটরিতে তৈরি হয় কৃত্রিম শুক্রাণু। আর এভাবেই বাচ্চা জন্ম দানের পুরো পক্রিয়া থেকে পুরুষের অবধান চলে যায়।”

“কিন্তু পুরুষ কিভাবে বিলুপ্তি হল?” জিজ্ঞেস করে নিউক।

উত্তর না দিয়েই উঠে যায় জেনারেল গ্রাটিয়া। একটু চুপ করে থাকে তারপর যেতে উদ্যত হন তিনি।

নিউক আবারো বলে “বললেন না জেনারেল গ্রাটিয়া? তাছাড়া আমার সাথে আপনারা কি করবেন?” চোখে মুখে প্রশ্ন বোধক চিহ্ন নিউকের।

জেনারেল গ্রাটিয়া নিউকের কাছে ঝুঁকে এসে মুখ শক্ত করে বলে “তোমাকে হত্যা করা হবে।”

কথাটা শুনেই নিউকের বুকের ভিতরটা ধরাস করে উঠে। “কি বলছেন? আমি কি করেছি, আমার কি দোষ?”

চথুর্ত অধ্যায়

একটি ভারি অস্ত্র নিউকের দিকে তাক করে দাড়িয়ে আছে জেনারেল গ্রাটিয়া। তার চোখে মুখে নেই কোন আবেগ, যেন একজন মানুষকে মারা মামুলী ব্যাপার। তার হাত যেন নিশপিশ করতে থাকে নিউককে মারার জন্য। আশে পাশে ঘিরে থাকা তরুণী এবং রোবট গোল হয়ে দাঁড়িয়ে নিউকের দিকে তাকিয়ে আছে। এই মুহূর্তে পৃথিবীর শেষ একজন পুরুষ মানুষকে হত্যা করা হবে এই অভূতপূর্ব দৃশ্যটি দেখার জন্য সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।

“একটু পরেই উচ্চ মাত্রার রেডিয়েশনে তোমার শরীরের সমস্ত কলকব্জা গলে যাবে। মৃত্যু জন্য তৈরি হও!” আবেগহীন গলায় বলে জেনারেল গ্রাটিয়া। তার চোখে ঘৃণা ঝরে পরে।

বিশ্বাস এবং অবিশ্বাসের মাঝে দুলতে থাকে নিউক, সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে তাকে এভাবে মারা হবে। প্রচণ্ড নির্বাক, নিস্পন্দ, সাংঘাতিক আতংকে তার গলার ভিতরটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এলো। একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে নিউক। জিবে অনেক কসরত করে গলা ভিজিয়ে খসখসে কণ্ঠে বলে “আমার কি দোষ? আমাকে মারবে কেন?”

“তোমার দোষ তুমি একজন পুরুষ মানুষ। আর এই পৃথিবীতে পুরুষের কোন স্থান নেই।” চিনচিনে গলায় বলে জেনারেল গ্রাটিয়া। তার চোখ জোরা ধূর্তের মত খেলে যায়।

“নারী এবং পুরুষ একে উপরের পরিপূরক। সৃষ্টির শুরু থেকে নারী এবং পুরুষ একে অন্যের বিপদে এগিয়ে এসেছে, ভালবেসে কাছে থেকেছে। পুরুষ মানুষ হওয়াতো কোন অপরাধ হবার কথা নয়।” বলে নিউক।

হাতের অস্ত্রটি অল্প সময়ের জন্য নামিয়ে বাম হাত দিয়ে জোরে টেবিলে থাবা মারে জেনারেল গ্রাটিয়া, তার মুখের মাংসপেশি শক্ত হয়ে আসে।

“হ্যাঁ, পুরুষ মানুষ এই সমাজে দরকার নেই, এরা উল্টো সমাজের জন্য ভাইরাসের মত, একটি ক্ষতিকর প্রজাতি।” সর্পিণীর মত ফোঁস করে বলে জেনারেল গ্রাটিয়া।

কিংকর্তব্য মত দাঁড়িয়ে থাকে নিউক।

“আমি ঠিক বুঝলাম না?” চোখে প্রশ্ন বোধক চিহ্ন ফুটিয়ে তুলে বলে সে। তার পুরো মুখমণ্ডল একটা নির্দিষ্ট ছন্দে কাঁপছে, সে কাঁপুনিটা সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে জ্যামিতিক হারে বেড়েই চলছে।

“পুরুষ মানুষ প্রতিশোধ পরায়ণ হয়, নারীদের সবসময় নিজের অধীনস্থ রাখতে পছন্দ করে। যখন পুরুষ মানুষ ছিল তারা নিজেদের মধ্যে সবসময় মারামারি হানাহানি করে বেড়াত হিংস হায়েনার মত।” কণ্ঠে ঝাঁঝ মিশিয়ে বলে জেনারেল গ্রাটিয়া।

একটু দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করে “পৃথিবীতে যত দিন কর্তৃত্বে ছিল পুরুষ মানুষের ততদিন পৃথিবীটাকে নরক বানিয়ে রেখেছিল, মেয়েদের পায়ের নিচে দাবিয়ে রাখাই যেন দায়িত্ব ছিল তাদের, খুন ধর্ষণ এমন কোন অপরাধ নেই যে তারা করত না!”

“আপনি যেই অভিযোগগুলো করলেন সেগুলো মানুষের একটি স্বাভাবিক প্রবৃত্তি……” আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল নিউক।

নিউকের মুখের থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলে উঠে আবার “মানুষের প্রবৃত্তি নয় বল পুরুষ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। তাই যখন সন্তান জন্মদান থেকে পুরুষের অবধান চলে গেল তখনই এই গ্রহ থেকেকি পুরুষ মানুষের বিদায় ঘণ্টা বেজে গিয়েছিল, আস্তে আস্তে নারীরা তাদের সংস্পর্শে আশা কমিয়ে দিল, পুরুষের তখন সারাদিন মদ জুয়া নিয়েই পরে থাকত, পরিবার ব্যবস্থা আস্তে আস্তে ভেঙ্গে গেল। একসময় পৃথিবীর সমস্ত কৃতিত্ব চলে আসে মেয়েদের কাছে, অর্থাৎ পুরুষ প্রধান সমাজ থেকে হয়ে উঠে নারী প্রধান সমাজ। তারপর নারীরা একেবারে পুরুষদের ত্যাগ করা শুরু করে, প্রায় দুইশত বছর লেগেছিল পুরো পুরুষজাতি বিলুপ্তি হবার। আজ থেকে ঠিক দুহাজার বছর আগে পুরো পুরুষ প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটে প্রকৃতি থেকে।”

একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে নিউক। “পৃথিবীতে যেমন নিষ্ঠুর পুরুষ মানুষ আছে ঠিক তেমনি ভাল পুরুষ মানুষও আছে, পুরুষ মানুষ একজন দায়িত্ববান পিতা, দয়ালু ভাই এবং নিষ্ঠাবান স্বামীও হয়। পুরুষ একজন প্রেমময়ী প্রেমিকও হয়, মানব মানবীর প্রেমের শত শত ইতিহাস আছে, যেখানে একজন প্রেমিক তার প্রেমিকার জন্য জীবন দিয়েছে। একজন ছেলে তার মায়ের মুখের হাসির জন্য হাসতে হাসতে মরতেও দ্বিধা করেনি। একজন পিতা তার সন্তানের সমস্ত সুখের জন্য সারা জীবন অনেক ত্যাগ শিকার করেছেন, সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য নিজের মাথার ঘাম পা ফেলে আয় রোজগার করেছেন।”

থেমে আবার বলতে শুরু করে নিউক “আমার বাবা ছিল একজন অফিস কেরানী, আমি তার একমাত্র সন্তান ছিলাম। আমার জন্য তিনি তার জীবনের সমস্ত সুখ শান্তি বিসর্জন দিয়েছেন।” বলতে বলতে অন্যমনস্ক হয়ে যায় নিউক। চোখটা ঝাপসা হয়ে উঠে, বুকের কাছে একটি চাপ অনুভব করে সে।

যোগ করে বলে “তাই কিছু দুষ্টু পুরুষ নামক অমানুষ পৃথিবীর সব পুরুষ মানুষকে প্রতিনিধিত্ব করে না।” বলেই মুখ শক্ত করে নিউক।

“আমি দুঃখিত নিউক পুরুষ মানুষ ছাড়া এই পৃথিবী অনেক শান্তিতে আছি, পৃথিবীতে কোন মারামারি নেই, নেই কোন যুদ্ধ। বিদ্রোহী এবং পুরুষ মানুষ এই দুইটা জিনিষ প্রচণ্ড অপছন্দ আমার। তাই তোমাকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয়।” অস্ত্রটি পুনরায় তাক করে বলে জেনারেল গ্রাটিয়া। তার চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। জেনারেল গ্রাটিয়ার চোখে মুখে একজন নারীর আবেগের চিহ্ন নেই, কাচের আড়ালে চোখগুলোয় প্রচণ্ড ঘৃণা খেলে যায়। মানব মানবীর আবেগে যেন তার কাছ একটি তুচ্ছ বিষয়। পুরুষ জাতটাকে যেন পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে পারলেই তার শান্তি।

“আপনি এরকম করতে পারেন না।” চেঁচিয়ে বলে নিউক।

সামনের দিকে কয়েক কদম এগিয়ে আসে জেনারেল গ্রাটিয়া, অস্ত্রটি নামিয়ে দুহাত দিয়ে নিউকের গলা ধরে উঁচু করে ফেলে। চোয়াল শক্ত করে বলে “পৃথিবীতে সাতটা বিশ্বযুদ্ধ হয়েছে, লক্ষ্য লক্ষ কোটি কোটি মানুষ প্রাণ দিয়েছে, অনেক মানুষ পঙ্গু হয়েছে, রোগ বালাই বহন করেছে, আর এসবের পিছনে দায়ী একমাত্র পুরুষ মানুষ। প্রাচীন পৃথিবীতে এডলফ হিটলার, রুশ সাম্যবাদী নেতা জোসেফ স্টলেন এবং চিনের মাও জেদং সবাই পুরুষ ছিল। এরা প্রত্যেকেই মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী। তুমিও একজন পুরুষ মানুষ তাই তোমারও বেচে থাকার কোন অধিকার নেই।” বলেই প্রচণ্ড জোরে সামনের দেয়ালে পুতুলের মত ছুড়ে মারে নিউককে, দেয়ালে কয়েক সেকেন্ড আটকে থেকে মেঝেতে আঁচড়ে পরে নিউক। কাচের দেয়ালটি চুরমার হয়ে ভেঙে পরে, ভাঙ্গা কাচের চুরচুর শব্দ হয়। শরীর থেকে রক্ত বেরিয়ে আসে নিউকের।

“আমাকে মেরে আপনার লাভ কি?” হাফাতে হাফাতে বলে নিউককে। দুর্বল শরীর নিয়ে দাড়াতে চেষ্টা করে সে।

তাচ্ছিল্যে হাসি হেসে বলে “আবার এই পৃথিবীতে পুরুষ নামক ভাইরাসকে ফিরিয়ে আনতে চাই না, তাছাড়া একজন পুরুষ বাঁচিয়ে রেখে সমাজে ভারসাম্যও নষ্ট করতে চাই না।” বলেই পুনরায় টিগারে চাপ দেয়ার প্রস্তুতি নেয় জেনারেল গ্রাটিয়া।

নিউক বুঝতে পারে তাকে এখন মেরে ফেলবে হয়ত, তবে সে এখনই মরতে প্রস্তুত নয়। চারপাশে কয়েকজন মেয়ে এবং রোবট তেজস্ক্রিয় অস্ত্র তাক করে আছে তার দিকে, এখান থেকে বাচার সম্ভাবনা কম। কি করবে ঠিক করতে পারে না সে! হঠাৎ করে মাথায় একটি বুদ্ধি আসে।

“আমাকে মেরেও আপনার কোন লাভ হবে না কারণ আমি মরলেই পৃথিবীতে পুরুষ মানুষ সব শেষ হয়ে যাবে সেটা কিভাবে নিশ্চিত হলেন?” মুখ শক্ত করে বলে নিউক। মনকে যথেষ্ট শান্ত রাখার চেস্ট করে নিউক। যেভাবেই হোক তার মাথা গরম করা যাবে না। ভিতরে ভিতরে ভয় পেলেও মুখে একটি সাহসী ভাব প্রকাশ করার চেষ্টা করে নিউক।

কিছুটা দ্বিধান্বিত দেখায় জেনারেল গ্রাটিয়াকে “মানে বুঝলাম না!”

“আমি ছাড়াও আরও অনেকে আছে যারা ক্রোয়োনিক এক্সপেরিমেন্টের অংশ ছিল, সারা পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে তাদের লুকিয়ে রাখা হয়েছে!” হালকা চালে বলে নিউক। জেনারেল গ্রাটিয়াকে সে দোটানায় ফেলতে চাইছে।

নিউক কিছুটা সফল হয়, সামান্য দোটানায় পরে যায় জেনারেল গ্রাটিয়া।

“তুমি মিথ্যে বলছ! আর যদি থেকেও থাকে তাদের খুঁজে বের করে মেরে ফেলা হবে!” নিউকের কথা সে পুরপুরি বিশ্বাসও করতে পারছে না আবার অবিশ্বাসও করতে পারছে না।

“কত জনকে মারবেন জেনারেল গ্রাটিয়া? লাখ লাখ মানব মানবী পৃথিবীর আনাচে কানাচে রয়ে গেছে! সবাই জেগে উঠলে সামাল দিতে পারবেতো? যখন পুরো ব্যাপারটা এই পৃথিবীতে ছড়িয়ে যাবে, সমাজকে সামাল দিতে পারবেন?” প্রশ্ন ছুড়ে দেয় নিউক।

নিউক বুঝতে পারছে জেনারেল গ্রাটিয়া দোটানায় পরে গেছে, এই মোক্ষম সুযোগ তাকে মানসিকভাবে পরাজিত করার।

“কোথায় আছে বল?” গলা পরিষ্কার করে বললেন জেনারেল গ্রাটিয়া।

“এত সহজে বলব?” কৃত্রিম একটি হাসি দিয়ে বলে নিউক।

জেনারেল গ্রাটিয়া বুঝতে পারে নিউককে এই মুহূর্তে মারা ঠিক হবে না, বরং যদি সে সত্যি বলে থাকে তা হলে সত্যিই একটি হযবরল অবস্থা সৃষ্টি হবে, তাছাড়া যতই দুর্বল হোক সাধারণ জনগণ এবং মানবাধিকার সংস্থা একসাথে জেগে উঠলে পরিস্থিতি সামাল দেয়া মুশকিল হয়ে যাবে।

আগের পর্ব:
ধারাবাহিক সায়েন্স ফিকশান উপন্যাস: নিউক (পর্ব এক )
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ রাত ১:৫৭
১০টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিব নারায়ণ দাস নামটাতেই কি আমাদের অ্যালার্জি?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৭


অভিমান কতোটা প্রকট হয় দেখেছিলাম শিবনারায়ণ দাসের কাছে গিয়ে।
.
গত বছরের জুন মাসের শুরুর দিকের কথা। এক সকালে হঠাৎ মনে হলো যদি জাতীয় পতাকার নকশাকার শিবনারায়ণ দাসের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতি মাসে সামু-ব্লগে ভিজিটর কত? মার্চ ২০২৪ Update

লিখেছেন জে.এস. সাব্বির, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৮

মার্চ ২০২৪ সালে আমাদের প্রিয় সামু ব্লগে ভিজিটর সংখ্যা কত ছিল? জানতে হলে চোখ রাখুন-

গত ৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভিউ ছিল জানুয়ারি মাসে। ওই মাসে সর্বমোট ভিজিট ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×