১৮১৬ সালে ভগ্নপ্রায় লালবাগ দূর্গ
মীর জুমলার আসল নাম ছিল মুহাম্মদ সাঈদ এবং তিনি ছিলেন জন্মসূত্রে ইরানী। ইস্পাহানের আর্দিস্থানে ১৫৯১ সালে তার জন্ম। তিনি ছিলেন এক দরিদ্র তেল ব্যবসায়ীর ছেলে। সামান্য লেখাপড়া জানার সুবাদে গোলকুণ্ডার এক হীরা ব্যবসায়ীর অধীনে চাকরি পান। পরবর্তীতে আরেক ব্যবসায়ীর অধীনে চাকরির সুবাদে ভারতে আসেন এবং এবসময় নিজেই হীরার ব্যবসা শুরু করেন। পরে একসময় তিনি গোলকুণ্ডার সুলতানের অধীনে চাকরি নেন এবং উজির পদে উন্নীত হন। তিনি সেসময় দক্ষিণাত্যের সুবেদার শাহজাদা আওরঙ্গজেবের নজরে আসেন এবং তার সহযোগিতায় আরো উন্নতি করেন।
সম্রাট শাহজাহানের ছেলেদের মধ্যে উত্তরাধিকার নিয়ে যুদ্ধ শুরু হলে, আওরঙ্গজেব দিল্লির মসনদ দখল করেন। সম্রাট হ্ওয়ার পর তিনি মীর জুমলাকে বাংলা ও উড়িষ্যার সুবেদার শাহ সূজাকে মোকাবিলা করার জন্য পাঠান। খাজোয়ার যুদ্ধে পরাজিত হয়ে শাহ সূজা পালিয়ে যান। মীর জুমলা খাজোয়া থেকে তান্ডা, তান্ডা থেকে ঢাকা পর্যন্ত শাহ সূজার পশ্চাদ্ধাবন করেন। সূজা উপায় না পেয়ে ঢাকা থেকে পূর্ব সীমান্ত পার হয়ে আরাকান (বর্তমানে চট্টগ্রাম অঞ্চল) রাজার কাছে গিয়ে আশ্রয় পান। ঢাকায় পৌছার (১৬৬০) অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মীর জুমলা বাংলার সুবেদার নিযুক্ত হন। দায়িত্ব গ্রহণ করেই তিনি প্রথমে রাজধানী রাজমহল থেকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনেন। উত্তরাধিকার যুদ্ধের কারণে বাংলার প্রশাসন এবং বিচার ব্যবস্থায় চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিলো। মীর জুমলা শুরুতেই প্রশাসন এবং বিচার ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন।
বাংলার শাসন ব্যবস্থা ঠিক করে মীর জুমলা কামরুপ, কুচবিহার এবং আসাম জয়ের জন্য অগ্রসর হন। আসাম জয় করতে যেয়ে মূঘল বাহিনী বর্ষার কারণে প্রচন্ড বিপদে পড়ে। বর্ষায় পথঘাট ডুবে যাওয়ায় সৈন্যবাহিনীর রসদ আসা বন্ধ হয়ে যায়। খাদ্যাভাব আর মহামারীতে কাবু সৈন্যদের উপর অসমীয়ারা রাতের বেলা চোরাগোপ্তা হামলা চালাতে থাকে। খাদ্যের অভাব এতটাই তীব্র ছিল যে সৈন্যরা যুদ্ধের ঘোড়াগুলি হত্যা করা শুরু করে। এভাবে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ সেনা মৃত্যুবরণ করে। মীর জুমলা নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়েন। বর্ষা শেষ হলে আসামের রাজা আর মীর জুমলা এক শান্তিচুক্তি করেন। ফিরে আসার পথে খিজিরপুরে ৩০শে মার্চ ১৬৬৩ সালে মীর জুমলা মারা যান এবং আসাম মূঘলদের হাতছাড়া হয়ে যায়।
মীর জুমলা'র নাম ঢাকায় দু'ট রাস্তা এবং দু'টি সেতু নির্মানের সাথে জড়িয়ে আছে। সৈন্য, গোলাবারুদ দ্রুত চলাচলের জন্য এবং জনকল্যানে তিনি এগুলো নির্মান করেন। সড়ক দৃ'টির একটি ঢাকার সাথে এর উত্তরের জেলাগুলিকে সংযুক্ত করে, যা বর্তমানে ময়মনসিংহ রোড নামে পরিচিত। রাস্তাটি জামালপুর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। জামালপুরে একটি দূর্গ এবং টঙ্গীতে তুরাগ নদীর উপর টঙ্গী ব্রিজ তিনি তৈরী করেন। অন্য আরেকটি রাস্তা পূর্বদিকে প্রসারিত হয়ে ফতুল্লা (প্রাচীন নাম ধাপা) 'র সাথে ঢাকা'কে সংযুক্ত করে। ফতুল্লায় তিনি আরো দু'টি দূর্গ নির্মান করেন। রাস্তাটি পরে খিজিরপূর পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। ফতুল্লার কাছে পাগলা ব্রিজ তিনিই তৈরী করেন। ঢাকা শহরে তার আরেকটি স্থাপনা হলো 'মীর জুমলা'র গেট' যা রমনা গেট নামেও পরিচিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টি.এস.সি. থেকে আরেকটু সামনে তিন নেতার মাজারের কাছে এর অবস্থান। ঢাকার নিরাপত্তার জন্যই এটি তৈরী করা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। ঢাকা শহরবাসী মীর জুমলার আরেকটি নিদর্শনের সাথে কমবেশী পরিচিত - কামান। এই কামানটি আগে ছিল বঙ্গবন্ধু স্কয়ারের পূর্ব দিকে, বর্তমানে এর অবস্থান ওসমানী উদ্যানে।
(ক্রমশ....)
ঢাকা - ৪০০ বছরের পুরানো এক শহর - পর্ব ১
ঢাকা - ৪০০ বছরের পুরানো এক শহর - পর্ব ২
ঢাকা - ৪০০ বছরের পুরানো এক শহর - পর্ব ৩