আমি মারা গিয়েছি প্রায় ২০ বছর আগে।
যেদিন মারা গেলাম সেদিনটা ছিল ফাগুনের এক রৌদ্রতপ্ত ঘুঘু ডাকা মনখারাপ করা উদাস দুপুর। ধুলো ওড়া মাতাল বাতাসে জাম্বুরা ফুলের তিব্র গন্ধে ভরে ছিল দুপুরটা।
আমার মেয়ে তখন সবে ক্লাশ নাইনে উঠেছে। হঠাত্ করেই বড় হয়ে গেল মেয়েটা, অথচ এইতো সেদিনও কত সাধ্যি সাধনা করে মুখে ভাত তুলে খাওয়াতে হত।
নীল-সাদা সালোয়ার কামিজ আর সাদা ফিতেয় বাঁধা লম্বা লম্বা বেনী দুলিয়ে ও যখন স্কুলে যায় তখন আমি আমার মিষ্টি কৈশরটাকে ওর মাঝে খুঁজে পাই। কি যে লক্ষি হয়েছে মেয়েটা। এক দুপুরে মেয়েটা স্কুল থেকে ফিরে শুনতে পেল ওর মা ভীষণ অসুস্হ্য। আমি নিজেও বুঝিনি ঐ দুপুরটাই ছিল আমার শেষ দুপুর। আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল, বুকের বাঁ পাশের তিব্র যন্ত্রনায় নীল হয়ে গিয়েছিলাম। চোখের সামনে সাদাসাদা নীল নীল কতগুলো রিং দেখতে পাচ্ছিলাম। জাম্বুরা ফুলের গন্ধ নিয়ে আমি তখন হাওয়ায় ভাসছি। আবছা আলোয় মেয়ের জল ভরা চোখ আমাকে ভিষণ কষ্ট দিয়েছিল। মনে মনে শুধু বলেছিলাম, 'ভাল থাকিস মা।'
মরে যাওয়ায় আমার কোন দুঃখ ছিলনা। শুধু আমার মেয়েটার জন্য তিব্র যন্ত্রনা হত। মা বিহীন পৃথিবীতে মেয়েটা কি করে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাবে! বয়ঃসন্ধিকালে কত রকম সমস্যার মুখোমুখি হয় মেয়েরা যেগুলো মা ছাড়া আর কারো সাথে শেয়ার করা যায়না। আমার মেয়ে কাকে জানাবে তার সমস্যার কথা। বাবাকে সব কথা বলা যায়না।
নাহ একসময় ওর বাবাই ধীরে ধীরে ওর মা হয়ে উঠল। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে একা একাই কাটিয়ে দিল এতগুলো বছর।
মেয়ের উপচে পড়া সুখী জীবনে কোল জুড়ে জমজ মেয়ে এসেছে। কি যে তুলতুলে আর মিষ্টি বাচ্চা গুলো। আমার খুব ইচ্ছে করে ওদের গাল টিপে আদর করে দেই। নাহ ছুঁতে পারিনা। মৃত মানুষদের বুঝি কাউতে ছোঁয়ার অধীকার থাকেনা।
এতবছর পর মেয়ের বাবাকে দেখে খুব কষ্ট হচ্ছে। বয়সের ভারে ন্যুজ। কি ভিষণ রকম একা আর নিঃসঙ্গ মানুষটা। দুটো কথা বলার, দুটো কথা শোনার কিংবা শোনানোর জন্য কেউ নেই পাশে। বারান্দার ঝুল চেয়ারে বসে সারাটা দিন বাইরে তাকিয়ে থাকে উদাস আর অসহায় দৃষ্টিতে। আমার খুব ইচ্ছে করে পাশে গিয়ে বসতে, খুনসুটি করতে, ইচ্ছে করে জিগগেস করি এতগুলো বছর আমার না থাকার শূন্যতা কি এতটুকুও কষ্ট দেয়নি! আমার ভিষণ কাঁদতে ইচ্ছে করে। ঈশ্বর মৃত মানুষদের কাছ থেকে কাঁদার ক্ষমতাও কেড়ে নেন। ঐ তো টেবিলে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার বইটা পড়ে আছে। বোঝাই যাচ্ছে আমি চলে যাওয়ার পর আর কেউ ওটা খুলে দেখেনি। খুব ইচ্ছে করে কবিতার বইটা মেয়ের বাবাকে এগিয়ে দিয়ে বলি, 'একটা কবিতা শোনাওনা!' হঠাত্ খেয়াল করলাম ভিতরের ঘর থেকে ভেজা ভেজা কাঁপা গলায় মেয়ের বাবা আবৃত্তি করে চলেছে।
কী আশ্চর্য
কখনই
তুমিতো কাঁদোনা,
পুটুলি পাকিয়ে রেখে গেছ
এ বাড়ির আনাচে কানাচে
যে মনোবেদনা
পুড়ে যাচ্ছি তার আঁচে,
এ এক রকম ভালো
শুনতে পাইনা কানে,
কে কী বল্ল
কে কেন
চাইছে বেশী আরো!
গলিতে তোমার ছোট্র
এক চিলতে বাগানে
লঙ্কা গাছে ফুল ধরেছে সবে,
তুমি আসছ কবে?
ছেঁড়া সেলাইয়ের ছুঁচে,
ভাঙা জোড়া দেয়ার আঠায় তুমি আছ।
ছুঁলেই টের পাই।
লাঠি হাতে উঠে
এ-ঘর ও-ঘর
করি খোঁড়াতে খোঁড়াতে।
কখনও সাক্ষাতে বলিনি
লজ্জার মাথা খেয়ে মুখ ফুটে।
তবু খুব জানতে ইচ্ছে করে
কখনও না কেঁদে
সমস্ত বর্ষার জল
কেন তুমি হাসিমুখে তুলে নাও দু চোখের কোলে!
এক দিন বাঁধ ভেঙে দিয়ে
আমাকে ভাসিয়ে দেবে বলে।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের এই কবিতাটা পড়লেই আমার চোখের সামনে একটা দৃশ্য ভেসে ওঠে। আমার মৃত্যুর বহুবছর পর এক নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ সারাবাড়ি তন্ন তন্ন করে শুধু আমার স্মৃতি হাতড়ে বেড়ায়। সেই ভাবনা থেকে এই দিনলিপি লেখা।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




