আজ থেকে স্কুলে বার্ষীক খেলাধুলার বাছাইপর্ব শুরু হবে। সেকেন্ড পিরিয়ড পর থেকে মাঠে যেতে হবে। প্রথম ক্লাশ নিয়ে কমনরুমে ফেরার পথে শুনলাম ক্লাশ থ্রির একটা পুচকু সুইট বাচ্চা গালফুলিয়ে আমাকে ডাকছে,'টিচার টিচার(কন্ঠে আহলাদ ঝড়ে পড়ছে)!'
আমি পিছনে ফিরতেই এগিয়ে এসে কাঁদো কাঁদো গলায় নালিশ জানাল,'টিচার টিচার,(গলার স্বরে কান্না আছে কিন্তু চোখে জল নেই)
একটা মেয়ে না আমাকে খালি লবন বলে খেপাচ্ছে।'
এরকম হাজারো নালিশ শোনা এবং সেটার শান্তিপূর্ন সমাধান করাটা রোজকার দায়িত্ব। আমি বাচ্চাটাকে দেখে মুগ্ধ, এত এত সুইট। বল্লাম,'কেন তোমাকে লবন বলছে কেন? চলো দেখি কে তোমাকে লবন বলে!'
ক্লাশে ঢুকে বাচ্চাটা যার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাল সেই বাচ্চাটাকেও দেখে মুগ্ধ হলাম। আরে এটাওযে দেখি আরেকটা তোতাপাখি।
তোতাপাখির কাছে জিজ্ঞেস করি কেন ওকে লবন বলা হচ্ছে। এবার তোতাপাখি কাঁদো কাঁদো গলায় বলে চলে,'ম্যাম, ম্যাম ও আমার নামটা খালি উল্টা করে বলতেছে!'
আমি জিজ্ঞাসিলাম,'তোমার নাম কী?'
তোতাপাখি বলে,' আমার নাম বিভা। লুবনা খালি আমার নাম উল্টা করে আমাকে ভাবি ডাকতেছে। তাই আমি লুবনাকে লবন বলেছি!'
কি আর করা দুজনকেই বল্লাম দুজনের কাছে সরি বলতে এবং যেন তারা সঠিক নামে একে আপরকে সম্বোধন করে।
আমার বিচারটা লুবনার খুব একটা মনঃপুত হোলনা মনে হচ্ছে। মুখটা তখনো তার গোমড়া। লুবনার মন ভালো করতেই বাধ্য হলাম একটা গল্প শোনাতে। ক্লাশের বাচ্চারা প্রচন্ড আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে আমার গল্প শোনার জন্য। গল্পটা পুরোটা মনে ছিলনা, যেটুকু মনে ছিল বলা শুরু করলাম।
'এক দেশে ছিল এক রাজা। রাজার ছিল তিন মেয়ে। একদিন রাজা তিন মেয়েকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন তার মেয়েরা তাকে কেমন ভালবাসে। রাজার প্রশ্নের জবাবে বড় মেয়ে বলে সে রাজাকে মধুর মত ভালবাসে। রাজা বেজায় খুশী বড় মেয়ের উত্তরে। মেঝো মেয়ে বলে সে রাজাকে চিনির মত ভালোবাসে রাজাকে। রাজা মেঝো মেয়ের জবাবেও প্রচন্ড খুশী হলেন। এরপর এলো ছোট মেয়ের পালা। রাজার কলিজার টুকরা, চোখের মনি এই ছোট মেয়ে। ছোট মেয়ে বল্ল সে রাজাকে লবনের মত ভালবাসে। ছোটমেয়ের জবাবে রাজা খুশী হতে পারলেন না। তখন তিনি প্রহরী ডেকে ছোটমেয়েকে বনবাসে পাঠিয়ে দিলেন। এদিকে দিন যায়, মাস যায়, বছর গড়ায়। ছোট মেয়ে বনের ভিতর অনেক কষ্টে দিনযাপন করে। বেশ ক'বছর পর রাজা একদিন শিকাড়ে বেরোলেন।
শিকাড় করতে করতে রাজা একসময় ক্লান্ত আর ক্ষুধার্থ হয়ে পড়লেন। রাজার কাছে খাবার দাবার যা ছিল সব ফুরিয়ে গেছে। রাজা আশে পাশে তাকাচ্ছিলেন কোন মানুষের বসতি পাওয়া যায় কিনা তা বোঝার জন্য।হঠাত্ দূরে একটা কুড়ে ঘর দেখতে পেলেন। রাজা কুড়ে ঘরের কাছে গিয়ে কাতর কন্ঠে বল্লেন যে, 'ভিতরে কেউ আছো? আমি খুব ক্ষুধার্থ। আমাকে কিছু খেতে দাও!'
ভেতর থেকে এক মেয়ে কন্ঠের জবাব এল, 'রাজামশাই একটু অপেক্ষা করুন।'
কিছুক্ষন পর খাবার এলো। ক্ষুধার্থ রাজা খাবার দেখেই খেতে বসে গেলেন। কিন্তু খাবার খেতে গিয়ে দেখলেন সব খাবারে মধু আর চিনি দেয়া। উনি খেতে পারলেন না। রাজা ভাবলেন কুড়ের ঘরের মালিক হয়তবা খাবারে ভুলে লবনের বদলে চিনি আর মধু দিয়ে ফেলেছে। তখন তিনি কুড়েঘরের মালিককে আবার বল্লেন,'শুনছ, সব খাবারে চিনি আর মধু দেয়া।খাওয়া যাচ্ছেনা, লবন ছাড়া খাবার খাওয়া যায়না! তুমি সম্ভবত লবনের বদলে ভুলে চিনি আর মধু দিয়ে ফেলেছ।'
ভেতর থেকে জবাব এল,' না রাজামশাই আমি ভুল করে না, ইচ্ছে করেই সব খাবারে মিষ্টি দিয়েছি। কারন আপনার তো লবন পছন্দ না। আপনার ছোট মেয়ে আপনাকে লবনের মত ভালবাসে শুনে আপনি রাগান্বিত হয়ে তাকে বনবাসে দিয়েছিলেন।'
রাজা তখন তার ভুল বুঝতে পারেন, এবং বলেন যে তিনি তার ভুল বুঝতে পেরেছেন। রাজার কথা শোনার পর কুড়ে ঘরের মালিক ঘর থেকে বেরিয়ে আসল রাজার সামনে। রাজা দেখলেন তার ছোটমেয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে। অতঃপর রাজা ছোটমেয়েকে নিয়ে রাজপ্রাসাদে ফিরে গেলেন এবং বুঝতে পারলেন ছোটমেয়ে তাকে সবথেকে বেশী ভালবাসে। কারণ লবন ছাড়া খাবার কি রকম বিস্বাদ তা তিনি বুঝেছেন।'
এতক্ষণে লুবনার গোমড়া মুখে হাসি ফুটেছে। বিভার উপর থেকেও তার রাগ চলে গেছে।
ওদিকে সেকেন্ড পিরিয়ড শেষ হবার ঘন্টাও পড়ে গেছে।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জানুয়ারি, ২০১২ রাত ১১:২৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




