somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আই উইল সি ইউ ইন মাই ড্রিম

০৯ ই নভেম্বর, ২০১৮ রাত ৯:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



- এই... এই ..

অফিস টাইম । বাস স্ট্যান্ডে ব্যাগ কাঁধে দাড়িয়ে আছি । এমন সময় সামনে দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ একটু দূরে একটা রিকশা থামলো ।

- এই ... এই খালিদ ... এদিকে!

নিজের নাম শুনে একটু অবাক হয়েই তাকালাম । আমাকে প্রায় সকলেই এখন ডাকে প্রয়োজনে, প্রয়োজনের গলায় । এমন আকুল আর আনন্দিত গলায় ডাকার মতো আমার কে আছে ভাবতে ভাবতে তাকিয়ে দেখি রিকশার এক পাশ থেকে মুখ বের করে পেছনে তাকিয়ে আছে একটা মেয়ে । বত্রিশ-তেত্রিশ বয়সের পরিনত মুখ, হাসছে । মুখটা খুব চেনা চেনা লাগলো, কিন্তু চিনতে পারছি না ।

- এদিকে আসো না একটু!

মেয়ে হাত নেড়ে আবার ডাকে এবং তার হাত নাড়ার ভঙ্গি দেখে বিদ্যুৎ চমকের মতো চিনে ফেলি তাকে । সুরমা, আমার সুরমা । সুরমাকে আমি দেখে চিনতে পারি নি - তেঁতে উঠতে থাকা সকালের রোদ আর বাস স্ট্যান্ডের মানুষ, গাড়ি, রিকশার হট্টোগোলের মাঝে দাড়িয়ে এ আমার নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য লাগে । সুরমা তো আমার চোখ বন্ধ রেখেও চিনে ফেলার মানুষ ছিলো; নীলক্ষেত, কাঁটাবন, শাহবাগ, সংসদ ভবন এলাকায় রিকশা করে একসাথে ঘোরার সময় হাত নাড়তে নাড়তে ওর হাসিমুখের গল্প বলে যাওয়ার যে চেহারা ভাবতাম মিশে গেছে আমার রক্তের স্রোতে, তা মাত্র কয়েক বছরের বিচ্ছিন্নতায় অপরিচিত হতে হতে অচেনাই হয়ে যাবে, রিকশাটার দিকে হেঁটে যাওয়ার সময় এ ভাবনাটা আমার কাছে অদ্ভুত লাগলো খুব ।

যে দিন সুরমার বিয়ের খবর পেয়েছিলাম, বিয়ে হয়ে যাবে জানতাম, সেদিন দস্তয়ভস্কির উপন্যাসের চরিত্রের মতো সারা রাত আমাদের একসাথে ঘুরে বেড়ানোর পথে পথে একা হাঁটতে ইচ্ছে হলো খুব । সুরমার নিবিড়ভাবে অন্য কারও বাহুলগ্না হওয়ার সে রাতের মুহূর্তগুলো আমার কাটলো ফাঁকা রাস্তায় দু'হাত ছড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রিয় গানের কিছু লাইন গুনগুন করে - ' আইরিন গুড নাইট, গুড নাইট আইরিন .... আই উইল সি ইউ ইন মাই ড্রিম ' । বিশ্বাস করো, সেদিন সত্যিই নিজেকে আমার পুরোপুরি নিঃস্ব মনে হয়েছিলো ।

- মূর্তি হয়ে গেলে নাকি! আছো কেমন?

ঘোর ভাঙ্গে আবার । ব্যস্ত রাস্তার মাঝে দাড়িয়ে দিবাস্বপ্নে ডুবে গিয়েছিলাম । কাছে দাড়িয়ে সুরমার ডিম্বাকার মুখের দিকে তাকাই । চেহারা ভরাট হয়েছে আরও, বেশ সুখি একটা ছাপ পড়েছে তাতে । ধাক্কা লাগে মনে । সুখে থাকুক সব সময়ই চেয়েছি, কিন্তু আমাকে ছাড়া আসলেই সুখে আছে দেখে একটু যেন নিজের ভেতর দুমড়ে যাই । মানুষ কি তবে ভালোই থাকে?

তিন শব্দে নিঃস্পৃহ কন্ঠে কোন ফিরতি জিজ্ঞাসাবিহীন সাদামাটা জবাব দেই - এই তো চলছে ।

- রোগা হয়ে গেছো বেশ । দাঁড়ি রাখা শুরু করলা কবে থেকে? ফ্রেঞ্চকাট মানায় নি ।

সহজ স্বাভাবিক কথা-বার্তা, যেন কখনো কিছুই ঘটে নি । হঠাৎ খেয়াল করলাম পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি কথা হওয়া মানুষটার সাথে আমার কোন কিছু বলার মতো অবশিষ্ট নেই । ওর সাথে অর্থহীন নাগরিক ভদ্রতাসুলভ আলাপও আসবে না । তাই নীরবে দাড়িয়ে থাকি ।

- আমি একটু সামনে যাবো । তোমার কোন তাড়া না থাকলে চলো । বহুদিন পর দেখলাম তোমাকে ।

অফিসের তাড়া ছিলো । নতুন চাকরি নিয়ে আগের ঠিকানা ছেড়ে চলে এসেছি দেশের আরেক প্রান্তে । এখানে আসার পর কি হবে, তা নিয়ে অনেক ভাবনাই ভেবেছি, তবে এমন সাক্ষাতের চিন্তা মাথায় আসে নি । উঠলাম রিকশায় । হুড তুললে আগে গাদাগাদি হয়ে যেতো বেশ, চলতো ভূমিদস্যুর মতো আমি দিন দিন রিকশার পুরোটা দখল করে ফেলছি বলে সুরমার কপট অনুযোগ । এখন স্পর্শবিহীন ভাবে বেশ এঁটে গেলাম দু'জনে, মাঝে রইলো না পেরোনোই মতো এক চিলতে নিরালম্ব অপরিচিত দুরুত্ব ।

রিকশা চলতে শুরু করে । আমি ভাবতে শুরু করি কেন উঠলাম রিকশায়? কোন প্রয়োজন তো ছিলো না । আচরনটা বুক পকেটে বিবাহিত প্রেমিকার ছবি আর অবান্তর বিরহ নিয়ে ঘুরে বেড়ানো মফস্বলের প্রেমিকের মতো হয়ে গেছে । এড়িয়ে গেলেই পারতাম ।

আমি আসলে সুরমাকে দেখে আশাহত হয়েছিলাম । মনে মনে হয়তো ভাবনা ছিলো আবার কখনো দেখা হলে ওর চোখে একটু হলেও স্থায়ী হয়ে যাওয়া বিষাদের ছাপ থাকবে যার জন্ম কেবলমাত্র এই আমার জন্যে । কিছুই নেই ... সুরমা তবে বেশ ভালোই আছে । বিস্মৃতি স্বাধীনতার ।

- আমার মেয়ের ছবি দেখো ।

বলে পার্স থেকে একটা ছবি বের করে এগিয়ে দেয় । তিনজনের আনন্দিত মুখের ছবি, সমুদ্রের ধারে বসে তোলা । সম্ভবত সেন্টমার্টিন, সুরমার প্রিয় জায়গা । ঠিক করা ছিলো একদিন না একদিন আমরা দুজন একসাথে যাবোই যাবো ওখানে । মেয়ে দেখতে ওর মতোই হয়েছে ।

- বিয়ে তো করেছো নিশ্চয়ই । তোমার বউয়ের ছবি দেখাও দেখি ।

হেসে কথা এড়িয়ে গেলাম । এ হাসিতে ইদানীং আমি বেশ অভ্যস্ত । চারপাশের সবার অগনিত কৌতুহলের জবাব দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে একসময় এ হাসিটা রপ্ত করে নিয়েছি । প্রশ্নের জবাব ধোঁয়াটে রেখে দিব্যি কাজ চালিয়ে নেয়া যায় । জবাব না দিয়ে আমি বরং পাল্টা প্রশ্ন করি ।

- তারপর, আছো কেমন?
- এই তো ভালোই । তুমি?
- চলে যাচ্ছে ।

আশ্চর্য! আসলেই তো চলে যাচ্ছে, বেশ চলে যাচ্ছে । অথচ একটা সময় একজন কে ছাড়া আমাদের আরেকজনের চলে নি, তোমার হারিয়ে যাওয়ার পর কি আকুল হয়েই না ভাবতাম আমার বুঝি আর চলবেও না কখনো । সময়ের চেয়ে বড় চিকিৎসক আসলেই আর কেউ নেই ; শরীরের ব্যথা আর মনের ক্ষত দুই-ই এ সারিয়ে দেয় । এক বয়সের আবেগ আরেক বয়সে এসে হয়ে দাড়ায় বাতুলতা ।

রিকশা এগোয়, টুং টাং শব্দে বেল বাজে । সুরমা নানা টুকরো টুকরো কথা বলে যায় । আমি শুনি, শুনতে শুনতে আবিষ্কার হয় এই মধ্যবয়সের দিকে যাত্রা করা মানসিকতায় নিপাট গৃহিনী হয়ে যাওয়া মানুষটার প্রতি আমি আর কোন আগ্রহ অনুভব করছি না । এর জীবন, জগত আটকে গেছে স্বামী - সংসার - বাচ্চা - শ্বাশুড়ি আর কাজের মেয়ের ঘুরপাকে । অথচ আমরা একসময় প্রবল উচ্ছ্বাসে গল্প করেছি ইনকা সভ্যতা নিয়ে, ঝগড়া বেঁধেছে ক্লিওপেট্রাকে আর হারমাচিসের প্রেম নিয়ে, পিঠে হেলান দিয়ে বসে বিষন্ন হয়েছি আলেকজান্ডার বেলায়েভের উপন্যাস উভচর মানবের নায়ক ইকথিয়ান্ডরের নিঃসীম নিঃসঙ্গতায় । আমার প্রেমিকা ছিলো অন্য কোন একজন যে বিস্মিত হতে জানতো, যার আলাদা এক জগত ছিলো যেখানে পড়ন্ত বিকেলে ডুব দিয়ে আমি প্রশান্তিতে ডুবে যেতে পারতাম । পাশে বসা এ মানুষ পুরানো দিনের কঙ্কালই কেবল । এর সাথে দশটা - ছয়টা অফিস করার মতো সংসার হয়তো করা যায়, কিন্তু ফেলে আসা দিনগুলোর মতো ভালো আর বাসা যায় না ... অথচ মনে মনে কতো কল্পনা ছিলো হঠাৎ পথে দেখা হয়ে যাওয়া নিয়ে! কোথায় যেন পড়েছিলাম - মানুষ পরিকল্পনা করে, আর ঈশ্বর হাসেন । আমারও হঠাৎ হাসি পেলো কেন যেন ।

- নামতে হবে সুরমা । কাজ আছে কিছু ।

কিছু একটা বলছিলো সে, হুট করে আমার এ কথা শুনে একটু থমকে যায় । এতোদিন পরের দেখায় এমন নিঃস্পৃহ কথা বলবো ভাবে নি হয়তো । রিকশা থামে । আমি নেমে একটু হেসে হাত নেড়ে বিদায় নেই । জগতের সব মানুষ সুখি হোক ।

সুরমা, আমি ভেবে নেবো তোমার সাথে আমার এ দেখাটা আসলে হয় নি । স্মৃতিতে তোমার যে উজ্জ্বল ছবিটা আছে তারপাশে আজকের গতানুগতিক তুমি বড় বেশি বেমানান, মলিন । সতর্ক, নিশ্চয়তাপ্রেমী নারীর হয়তো এ গতানুগতিকতাই পছন্দ বলে তারা নিতান্তই সংসারী, সুখি । পুরুষ উদ্দাম, সাধারণ হয়েও অসাধারণ, তাই তারা প্রেমিক, নিঃসঙ্গ শেরপা । আমার স্মৃতিতে তুমি বরং প্রেমিকা হয়েই থাকো ।

সারাটা দিন পড়ে আছে সামনে । আজ আবার পথে পথে হাঁটার তৃষ্ণা হচ্ছে তোমার বিয়ে হয়ে যাওয়ার দিনটার মতো । মনে হচ্ছে আজ তোমাকে আমি আবার হারালাম । শেষবারের মত, আর কখনও দেখা হবে না আমাদের ।

সূর্যকে পেছনে রেখে আমি সুরমার চলে যাওয়ার বিপরীত পথে পা বাড়াই, গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠি পুরানো দিনের সুর- ' গুড নাইট আইরিন, আইরিন গুড নাইট ... আই উইল সি ইউ ইন মাই ড্রিম ... '
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই নভেম্বর, ২০১৮ রাত ১০:০৫
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৮




আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না। আমাদের দেশে মানুষ জন্ম নেয়ার সাথেই একটি গাছ লাগানো উচিৎ । আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানবতার কাজে বিশ্বাসে বড় ধাক্কা মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৭


মানুষ মানুষের জন্যে, যুগে যুগে মানুষ মাজুর হয়েছে, মানুষই পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে কাজের ব্যস্ততায় এবং নিজের সময়ের সীমাবদ্ধতায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে না। তখন তারা সাহায্যের হাত বাড়ান আর্থিক ভাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস দিতে না পেরে রাস্তায় গড়াগড়ি যুবকের

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৫৫

আমাদের দেশে সরকারি চাকরি কে বেশ সম্মান দেওয়া হয়। আমি যদি কোটি টাকার মালিক হলেও সুন্দরী মেয়ের বাপ আমাকে জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। কিন্তু সেই বাপ আবার ২০... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×