somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

লুই আই কানের ঢাকায়

১২ ই আগস্ট, ২০১৯ দুপুর ২:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



লুই আই কান ঢাকার ব্যাপারে একবার নাকি বলেছিলেন, " আমি এমন এক শহরের পরিকল্পনা করতে চাই, যে শহরে হাঁটতে হাঁটতে তরুণেরা তাদের ভবিষ্যৎ স্বপ্নগুলো গুছিয়ে নিতে পারবে " । আমাদের জাতীয় সংসদের স্থপতির এ স্বপ্ন পূরণ হয়েছে কিনা তার সাক্ষ্য না হয় নিউজপ্রিন্টে ছাপা হয়ে চলা প্রতিদিনকার খবরের কাগজ, রাজপথের আইলেনে নষ্ট বাল্ব বুকে আগলে দাড়িয়ে থাকা ল্যাম্পপোস্ট, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রাতে নেকাব-বোরকায় শরীর ঢেকে রোজ হাজিরা দেয়া রূপোপজীবিনীর দল বা টিএসসির মোড়ে চরম অবহেলায় রাস্তা পার হতে থাকা টোকাইটার কাঁধের ঝোলা থেকে উঁকি দিয়ে অপার কৌতূহলে চারপাশ দেখতে থাকা কোমল পানীয়র বোতলগুলোর কাছেই পাওনা থাকুক ।

চলতে ফিরতে কতো দেয়াল লিখন আর পোস্টার চোখে পড়ে - রাজনৈতিক স্লোগান, ধর্মীয় সমাবেশ কিংবা বাড়ি ভাড়ার টু-লেট বিজ্ঞাপনের । দুই বেড, ডাইনিং, বাথরুম, ছোট্ট কিচেন আর এক ফালি বারান্দা । ভাড়া সাড়ে বারো হাজার টাকা মাত্র । হয়তো তার অবস্থান আকাশের কাছাকাছি কোথাও, কিংবা অন্ধকার কোন এঁদো গলিতে- দিনের বেলায়ও যেখানে বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালিয়ে রাখতে হয়। যেখান থেকে হয়তো আকাশ দেখা যায় না, কিংবা হয়তো যায় । সে বারান্দায় লাগানো গ্রিলের উপর রোদে পোহাতে থাকা বহু ব্যবহারে মলিন হয়ে আসা কালো প্যান্ট, সুতি গামছা বা লাল সায়ার উপর থেমে থাকা দুপুরে তারস্বরে প্রায় আর্তনাদ করে চলে কোন কাক । কর্কশ সে ডাকে কান পাতলে প্রতিধ্বনিত হয় যেন প্রিয়জন হারানোর বেদনা.... সকাল বেলা পুরোনো হয়ে যাওয়া কাঁধের ব্যাগে দুপুরের খাবার নিয়ে কিংবা নিউমার্কেট বা মিরপুরের কোন তুলনামূলক সস্তার দোকান থেকে কেনা বড় হ্যান্ডব্যাগের পার্সে এক প্যাকেট টিস্যু, কাজল, এক বোতল পানি, ছোট্ট একটা আয়না, চিরুনী আর কিছু টাকা নিয়ে বের হওয়া এমন কিছু যুবক-যুবতীদের আমি চিনি, যারা ওমন একটা গহ্বরে ঠাঁই পেলেও গড়ে নিতে চায় নিজেদের অমরাবতী । তাদের স্বপ্ন কি পূরণ হয়? নাকি সে কবুতরের খুপরীতে জমে ধুলো? এ শহরই সে জবাব দেক ।

তবে অদ্ভুত এক দেয়াল লিখন চোখে পড়েছে আজ আজিমপুরের চায়না বিল্ডিংয়ের গলিতে । ইটের টুকরো দিয়ে চুনকামবিহীন দেয়ালে কে যেন লিখে রেখে গেছে কেবল দুটো শব্দ - " কষ্টে আছি "। তার সামনে আমি বিহ্বল হয়ে দাড়াই কিছুক্ষন । কোন অভিযোগ নয়, আক্রোশ নয়, বেদনার্ত উচ্চারণও যেন নয় .... কেবল দুই শব্দে সরল এক স্বীকারোক্তি - কষ্টে আছি । চারপাশে এতো সুখের আয়োজন, তবু কিসের কষ্ট? সে কি গ্রাম থেকে আসা এমন কোন বেকার যুবক, যার কাছে প্রতিবার ইথারে ডাক পাঠিয়ে সসংকোচে গ্রাম্য মা পরোক্ষভাবে পেশ করে যান অভাবের ফিরিস্তি? কিংবা সে কি সম্প্রতি হারিয়েছে দুরুদুরু বুকে প্রেয়সীর আঙ্গুল, চিবুক, ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়ার অধিকার? নাকি সে কোন উদভ্রান্ত মানুষ যে একই সাথে একাকীত্বকে ভালোবাসে তৃষ্ণার্ত দৃষ্টিতে কারও মাঝে খুঁজে বেড়ায় একটু মমতার আশ্রয়, জীবনের মানে? .... এসব প্রশ্নের কোনটারই জবাব জানা যাবে না, ঐ শব্দদুটো সাদা চুনকামের নিচে চাপা পড়ে যাবে একদিন ।

কিছু কিছু দিন, কিছু কিছু সময় মূলত অর্থহীন । আকন্ঠ ব্যস্ত আপনি হয়তো হুট করে আবিষ্কার করবেন আপনার সব ব্যস্ততাই আসলে কোন এক নিষ্করুন পরিহাসের অংশই কেবল । কিছু বিকেল মনকে করবে উদ্বাহু, বোধ হবে হিসেব মিলছে না, মিলছে না । কিছু সন্ধ্যা আপনাকে করে তুলবে অস্থির । সৃষ্টিকর্তা তা ভালোই জানেন । তাই সন্ধ্যা তার কাছে আত্নসমর্পনের সময় । কেউ তাকবির দিয়ে নামাজে দাড়ায়, কেউ সান্ধ্য প্রদীপ জ্বালে, কেউ-বা সুর করে গায় স্রষ্টার গুণগান ..... অনাগত অন্ধকার কে ভয় পেতেন আমাদের পূর্বপুরুষরাও । অন্ধকার মানেই তখন বিপদ, মৃত্যু, পথ হারানোর গোঁলক ধাঁধা । তারা আগুন জ্বেলে দলবেঁধে গোল বসতেন তার চারপাশে রাত কাটাতে, কিংবা মাথার উপর বিছিয়ে থাকা নক্ষত্রের আলোয় চোখ রেখে সাহস যুগিয়ে পাড়ি দিতেন দূর-দুরান্তের পথ । কিন্তু ইদানীং শহরের অলিতে গলিতে নক্ষত্রেরা আর পথ দেখায় না .... দিকভ্রান্ত মানুষেরা পথ খুঁজে পাবে কিসে?

এ জিজ্ঞাসার জবাব নেই । খুঁজতে গেলে ঠকতে হবে শহরের কাছে । আমরাও যেমন অবলীলায় ঠকিয়েছি লুই আই কান কে তার পাওনার পুরোটা না মিটিয়ে দিয়ে । কিছু জবাব তাই অমিমাংসিতই থাক । " কষ্টে আছি " চিরকুট মুছে যাক চুনকামের মিথ্যা প্রলেপে । তারচেয়ে বরং গাড়ির তীব্র হর্নের শব্দ, নর্দমায় পড়ে থাকা কুকুরের গলিত মৃতদেহ, টং চায়ের দোকানে গরম পানিতে অনবরত গোসল করতে করতে সঙ্গীতের শব্দ করতে থাকা ভাঙ্গা কাপ-পিরিচ, চাকুরিজীবী মানুষের মানিব্যাগ ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে রাখা যত ভিজিটিং কার্ড, বিলবোর্ডে নিরোধকের বিজ্ঞাপনের আদিম উত্তেজনার আহ্বান, প্রগাঢ় ভালোবাসা-বাসির পর বাহুলগ্না হয়ে পরম নির্ভরতায় চোখ মুদে থাকা প্রিয় মানুষের গাঢ় নিঃশ্বাস, গলির মোড়ে ভাস্কর্যের মতো দাড়িয়ে থাকা অন্ধ ভিক্ষুকের থালায় পথ ভুলে চলে এসে ভ্যাবাচেকা খাওয়া চকচকে পাঁচ টাকার কয়েন, নতুন মাড় দেয়া আকাশী রঙের জামায় বেনি দুলিয়ে স্কুলে যাওয়া বালিকার ব্যাগের প্রিয় পেন্সিল বাক্স-ফ্লাস্ক আর প্রেমিক লাজুক ছেলেটার হাতের তালুতে সঙ্গোপনে লুকিয়ে থাকা রক্তলাল গোলাপের কুঁড়ি সগৌরবে ঘোষনা করুক আমরা ভালো আছি, ভালো আছি, ভালো আছি ।

... জানি— তবু জানি
নারীর হৃদয়— প্রেম— শিশু— গৃহ– নয় সবখানি;
অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়—
আরো-এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে
ক্লান্ত— ক্লান্ত করে

( লুই আই কানের বকেয়া ৬১ হাজার ডলার পাওনা পরিশোধ করা হয় ২০১৬ সালে, পেনসিলভেনিয়া ইউনিভার্সিটির আর্কাইভ থেকে জাতীয় সংসদের মূল নকশা নিয়ে আসার সময় । )
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই আগস্ট, ২০১৯ রাত ১০:০৩
৫টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিসিএস দিতে না পেরে রাস্তায় গড়াগড়ি যুবকের

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৫৫

আমাদের দেশে সরকারি চাকরি কে বেশ সম্মান দেওয়া হয়। আমি যদি কোটি টাকার মালিক হলেও সুন্দরী মেয়ের বাপ আমাকে জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। কিন্তু সেই বাপ আবার ২০... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কে কাকে বিশ্বাস করবে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৯


করোনার সময় এক লোক ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল। খবরটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কানে গেলে ওনি লোকটাকে ধরে এনে পিটিয়েছিলেন। কারণ, ৯৯৯ এ ফোন দেওয়ায় তার সম্মানহানি হয়েছে।

সমাজে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×