দ্বীপ সরকার এর কবিতা, রাজনীতিবিদঃ কাঠামোবাদের আলোকে আলোচনা
মতিন বৈরাগী
কবি দ্বীপ সরকার, জন্ম ১৯৮১ইং খ্রীঃ বগুড়া জেলা। কবির রাজনীতিবিদ কবিতার বিষয়ে বিশ্লেষণ তুলে ধরার চেষ্টা করছি স্বল্প পরিসরে।
"মাছেরা ঘুমোচ্ছে,পুকুর /জেগে আছে- /জল,জলের ভেতর ভুটি /তুলছে/ জলের সিথানে আজ রং /চুন,হইচই /কর্দমাক্ত বালিশ ঝুলিয়ে/ দিয়েছে নোটিশ /এখানে আজ /রাজনীতিবিদরা আসলে/ ওদের মাছ বানানো হবে/ শুক্রবার,পল্টনে/ রাজনীতিবিদদের/ সমাবেশ পুকুর জেগে/ আছে,মাছপ্রজারা /জেগে আছে /জলের সিথানে আওয়াজ/ আসে/ 'এই দেশের মাছেরাও/ ভালো নেই/ বড় মাছ /ছোটো মাছরে খায়'/ রাত বারোটার পর ঘুম/ থেকে জেগে দেখে/ যারা পল্টনে অপূর্ব/ ভাষণ হাঁকিয়েছেন/ সবাই হাঙর হয়ে গেছে/ সংসারের ছোটো ছো/ে প্রাণীদের খেয়ে সাবাড়/ করছে রাজনীতির মাঠ-/বাংলাদেশ/ ঈশ্বর বুঝেন,হাঙর কেন/ হচ্ছেন রাজনীতিবিদগণ --"

কাঠামোবাদের আলোকে পাঠ করলে বোঝা যায়, কবি এখানে ভাষার বিন্যাসের ভেতর দিয়ে শব্দ থেকে শব্দের বেড়াজালে বহুস্তরীয় সংকেত তৈরি করেছেন। এখানে “মাছ” কেবল জীবজগতের প্রাণী নয়, বরং সাধারণ মানুষের রূপক। কবি ‘রাজনীতিবিদ’-এর বিপরীতে ‘মাছ’কে দাঁড় করিয়ে একটি দ্বৈত-বিন্যাস তৈরি করেছেন—শাসক বনাম শাসিত, বড় মাছ বনাম ছোট মাছ, হাঙর বনাম অসহায় মাছ।
কবিতাটি কেবল ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার প্রকাশ নয়, বরং সাংস্কৃতিক সংকেতবাহী এক ভাষার খেলা। “মাছেরা ঘুমোচ্ছে, পুকুর জেগে আছে”এ বাক্যাংশে প্রতিফলিত হয় সামাজিক বাস্তবতা ও রাজনৈতিক শক্তির সমান্তরালতা। মাছের ঘুম সাধারণ মানুষের নিষ্ক্রিয়তা, পুকুর সমাজের রূপক, আর জেগে থাকা রাজনৈতিক পরিবেশের গতিশীলতা।‘পল্টন’ এখানে শুধু ভৌগোলিক স্থান নয়, বরং রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রতীক। কাঠামোবাদের পরিভাষায় একে মিথিক সিগনিফায়ার বলা যায়, যা স্থান ছাড়িয়ে রাজনৈতিক চেতনার প্রতীকী মঞ্চে পরিণত হয়েছে।‘বড় মাছ ছোটো মাছকে খায়’ প্রবাদটি কবিতার ভেতরে এক পুনরাবৃত্ত সাংকেতিক সত্য। এটি শুধু দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা নয়, বরং রাজনৈতিক শোষণের সর্বজনীন চিত্র। দেরিদার বাইনারি অপজিশনের আলোকে দেখা যায়—রাজনীতিবিদ ↔ মাছ, বড় মাছ ↔ ছোট মাছ, মানুষ ↔ হাঙর, ভাষণ ↔ শিকার সব দ্বিমুখী জুটিই ক্ষমতার কাঠামোকে উন্মোচিত করছে। এখানে রাজনীতিবিদ ও হাঙর প্রাধান্যশীল সংকেত, আর মাছ অধীনস্ত সংকেত। এর ফলে বাস্তব সম্পর্ক প্রতিনিয়ত পুনর্গঠিত হয়।

রোলাঁ বার্তের মতে, প্রতিটি সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তিই একসময় মিথে পরিণত হয়। ‘পল্টন’ কবিতায় কেবল একটি জায়গা নয়, বরং রাজনৈতিক স্মৃতি ও সংগ্রামের প্রতীক। বারবার সমাবেশ, ভাষণ, শ্লোগান এসব মিলিয়ে এটি হয়ে উঠেছে এক সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক মিথ। একইসাথে কবিতায় পুনরাবৃত্ত শব্দ—‘মাছ’, ‘পুকুর’, ‘হাঙর’ পাঠককে এক চক্রাকার সত্যে ফেরত নিয়ে যায়। রাজনীতিবিদেরা যখন হাঙরে রূপান্তরিত হন, তখন সাধারণ মানুষের নিয়তি কেবল শিকার হওয়া। কাঠামোবাদ, দেরিদার বাইনারি অপজিশন ও বার্তের মিথ ধারণার আলোকে এই কবিতাটি কেবল রাজনৈতিক ব্যঙ্গ নয়, বরং ক্ষমতার গঠন, শোষণ এবং সাংস্কৃতিক হেজেমনির এক নির্মম প্রতিচিত্র।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৪২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


