আমার একটি ছোট্ট সুন্দর গ্রাম ছিল। তার নামটিও ছিল
ভারী সুন্দর—কাশতলা। হয়তো একসময় কাশফুলের খুব
প্রাচুর্য ছিল ঐ গ্রামে। আমি কবিত্ব করে তার নাম পাল্টে
রেখেছিলাম কাশবন; ভালোবেসে প্রেমিক যেমন তার
প্রেমিকার নাম পাল্টে রাখে। সেই আমার প্রথম কবিতা।
ঐ গ্রামটির জন্ম হয়েছিল আমাকে জন্ম দেবার জন্য,
এ ছাড়া ঐ গ্রামের আর কোনো উল্লেখযোগ্য অর্থ নেই।
প্রতিটি গ্রামই কাউকে না কাউকে জন্ম দিয়ে চলেছে,
সেদিক থেকে আমার গ্রামটি এমন কিছু করেনি যাতে
তাকে পাগলের মতো মাথায় তুলে নাচতে হবে শিবনৃত্য।
তবু নবকবিত্বের উন্মত্ততায়, এই জীর্ণশীর্ণ দেহেও, আমি
আমার আদুরে গ্রামটিকে মাথায় নিয়ে বেশ কিছুদিন নৃত্য
করেছি।
কিন্তু আজকাল কী যে হয়েছে আমার। আমিও কেমন যেন
তাদের মতোই হয়ে যাচ্ছি। ভুলে যাচ্ছি আমার গ্রামটিকে,
আমাকে জন্ম দেবার জন্যেই একদিন যার জন্ম হয়েছিল।
মাথায় নিয়ে তো দূরের কথা, আজকাল কোমর জড়িয়েও
আর নৃত্য করি না। আমাকে টেনেছে এই নগর নটিনী।
অথচ নিশ্চিত জানি কাশবন এখনো আমার অপেক্ষায় বসে
অনিদ্র প্রহর গোনে বেহুলার মতো, এই তার একমাত্র কাজ।
এক-একবার ভাবি, যাবো। চলে যাবো। ফিরে যাবো...।
কিন্তু যাওয়া হয় না। কেন হয় না? নানা কারণেই হয় না।
মা আমাকে জন্ম দিয়ে ম’রে গিয়েছিলেন মাকড়সার মতো।
তাঁকে ধন্যবাদ। কাশবন কেন যে আমার মায়ের মতো নয়?
কবিতার জন্মকথা
‘কাশবন ও আমার মা’ কবিতাটি আমার দুঃখ কোরো না, বাঁচো কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত।
এই কাব্যগ্রন্থের প্রকাশকাল: ১৯৮৭ সালের একুশে বইমেলা।
কবিতা রচনার পর আমি রচিত কবিতার নিচে রচনা-তারিখ লিখে রাখি না।
কাব্যগ্রন্থের প্রকাশকাল দেখে গ্রন্থভুক্ত কবিতার রচনাকাল আন্দাজ করে নিই।
জন্মের পর একনাগাড়ে প্রায় ১৬ বছর আমি আমার জন্মগ্রামে কাটিয়েছি।
আমার জন্মগ্রামটিকেই আমি আমার অন্তিম গন্তব্য বলে মানি।
যখন কাশবনের সঙ্গে আমার নাড়ির বন্ধন ছিন্ন হওয়ার উপক্রম হয়েছে,
গ্রামের প্রতি কর্তব্য পালন করতে না পারার অপরাধবোধে আক্রান্ত হয়েছে আমার মন—
তখন আমাদের দুজনের মধ্যে সৃষ্ট বিচ্ছিন্নতা দূর করার উদ্দেশ্যেই
এই কবিতাটি লিখেছিলাম। আমার গ্রাম, কাশবন আমার কাছে মাতৃবত্।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



