সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় হিন্দু ধর্মাম্বলীদের ধর্মীয় উৎসব হোলি উদযাপনের বেশ কিছু ভিডিও সোস্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে । ভিডিওগুলো দেখে মনে হচ্ছে না যে, এটা বাংলাদেশের কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সাত বছর আগে চারুকলায় ঢোকানো হয়েছে এই দোল উৎসব।এই উৎসবে অংশ নেয়া কিছু শিক্ষার্থীর ইন্টারভিউ ভাইরাল হয়েছে। রঙ মেখে ইন্ডিয়ান স্টাইলের নাচ গানে অংশ নেয়া ছাত্র ছাত্রীরা বলেছে, ‘অসাধারন লাগছে এই রঙ এর উৎসবে অংশ নিয়ে!' একজন ছাত্র বলেছে , ‘ রোজা রেখে এই রঙ এর খেলায় অংশ নেয়াতে আমার মনে হয় না যে রোজা হাল্কা হয়ে হয়ে গেছে। Allah will understand this ’!! মূ্ল্যবোধের কতখানি অবক্ষয় ঘটলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এভাবে কথা বলতে পারে , তাই ভাবছি। তবে একতরফা এই শিক্ষার্থীদের দোষ দিয়ে লাভ নাই। এরা বর্তমান প্রজন্ম। কেন এদের মূল্যবোধের অধঃপতন হয়েছে , তা ভেবে দেখার দায় আমাদেরই। নিজের চারপাশে মানুষ যা দেখে তাতেই সে অনুপ্রানিত হয়। বছরের পর বছর আমাদের দেশের বাসা বাড়ীর টিভিতে চলছে স্টার জলসা, জি , সনি, স্টার প্লাস ইত্যাদি ইন্ডিয়ান টিভি চ্যানেলের সিরিয়াল , নাচ গানের প্রোগ্রাম। এসব চ্যনেলের প্রভাবে ইন্ডিয়ান সংস্কৃতিই এখন আমাদের দেশীয় সংস্কৃতিতে পরিনত হয়েছে। পোষাক আষাক , সাজ সজ্জা সব কিছুতেই এখন ইন্ডিয়ান সংস্কৃতির ছাপ সুস্পষ্ট। বিয়ে স্বাদীর প্রোগ্রামগুলোতেও আজকাল আর আগের মত বাঙ্গালী স্টাইলের হলুদ, বিয়ে - বৌভাতের প্রোগ্রাম হয় না। ইন্ডিয়ান নাচ গানে ভরপুর মেহেদি - সঙ্গীত অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় । অর্থাৎ মানুষ যা টিভিতে দেখছে তাই অন্ধ অনুকরন করছে । বাঙ্গালী সংস্কৃতি এখন অনেকটাই বিলুপ্তপ্রায়।
আজ থেকে ২০/২৫ আগে দেশের অবস্থা এমন ছিল না। আশি নব্বই দশকে আমাদের বিনোদনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম ছিল বই এবং টিভি। বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার লক্ষ নিয়ে আবদুল্লাহ আবু সাইদ গড়ে তুলেছিলেন বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র। স্কুলগুলোতে সপ্তাহে একদিন বই নিয়ে হাজির হত বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রামমান লাইব্রেরী। বিশ্ব বিখ্যাত সব লেখকদের অনুবাদকৃত বই পড়ার সুযোগ করে দিয়েছিল এই ভ্রাম্যমান লাইব্রেরী। বই পড়ার পাঠক তৈরী্তে আরেক বিশাল অবদান রেখেছিল কাজিদার সেবা প্রকাশনী। এছাড়াও বাংলা সাহিত্যের প্রতিথযশা কবি সাহিত্যকদের পাশাপাশি হুমায়ুন আহমেদও কাপিয়েছে কয়েক দশক । কাপিয়েছে ওপার বাংলার লেখকরাও। মূল্যবোধ ও নীতি নৈ্তিকতার জ্ঞান মানুষ মুলত অর্জন করে বই পড়ে। পরিবারিক ও ধর্মীয় শিক্ষাই কেবল যথেষ্ঠ নয় ভালো-মন্দ, ন্যায়- অন্যায় বিবেচনা বোধ তৈরীতে। ইন্টারনেট ও ইন্ডিয়ান টিভি কালচারের নেশায় আসক্ত বর্তমান প্রজন্ম কি বই পড়ে ? দেশে আমি বর্তমান প্রজন্মের অনেকের কাছে জানতে চেয়েছিলাম তারা বই পড়ে কিনা । তারা প্রত্যেকেই বলেছে যে, বই পড়ার সময় নাই !! এদিকে বইমেলা হয় প্রতি বছর। । পাঠকের চাইতে লেখকের সংখ্যাই এখন বেশী বলে মনে হয়। রংচঙ্গে পোষাক পড়ে বইমেলায় বই হাতে নিয়ে ছবি তুলে লেখক / পাঠক । ফেসবুকে সেই পোস্ট ভেসে যায় লাইক কমেন্ট এর বন্যায়। অনুরোধের ঢেকি গিলে কেনা সেই সব বই কজন পাঠক পড়ে, যথেষ্ঠ সন্দেহ আছে।
মূল্যবোধ সৃষ্টিতে বই এর পাশাপাশি নাটক , সিনেমা ও সঙ্গীতেরও বিশাল ভুমিকা রয়েছে । আশি নব্বই দশক হচ্ছে বাংলা গান ও নাটকের স্বর্নালী যুগ। সারাদিনের কর্মব্যস্ততা শেষে সন্ধার পর সবাই অপেক্ষায় থাকতাম বিটিভির বাংলা নাটকের জন্য। সে সময়ের বাংলা নাটকে ফুটে উঠত চলমান জীবনের বাস্তবতা । মধ্যবিত্ত সমাজ ড্রইংরুমে খুজে পেত তাদের জীবনের প্রতিফলন। গ্রামের খেটে খাওয়া সহজ সরল মানুষ খুজে পেত তাদের জীবনের ছোয়া। গ্রামে গঞ্জে তখন ঘরে ঘরে টিভি ছিল না। কিন্ত এলাকায় যার বাসায় টিভি ছিল সেখানেই বসত নাটক দেখার আসর। নব্বই দশকের শেষ ভাগে আমাদের দেশে ইন্ডিয়ান ডিশ টিভি কালচারের অনুপ্রবেশ ঘটে। পাড়ায় পাড়ায় স্থাপিত হয় cable লাইন সংযোগ দেবার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান । খুবই অল্প টাকায় এই cable লাইন নিলেই মেলে একশর উপড়ে চ্যানেল দেখার সুযোগ। চোখ ধাধানো সুন্দর সেটে , চড়া মেকাপের রুপসি তম্বী নায়িকাদের অভিনীত সিরিয়াল ও নাচ গানের পাশে বড্ড সাদামাটা হয়ে পড়ে বাংলা নাটক। ধীরে ধীরে দর্শক হারানো শুরু করে বাংলা নাটক। কিন্ত আদতে এসব হিন্দি সিরিয়ালগুলোতে না আছে শিক্ষনীয় কোন বিষয় , না আছে আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির কোন মিল। বছরের পর বছর এই হিন্দি সংস্কৃতি তরুন প্রজন্মের মূল্যবোধ পাল্টে দিচ্ছে, বিকৃতি ঘটাচ্ছে রুচির । মানুষ এখন বাঙ্গালীয়ানা ভুলে গিয়ে লাইফ স্টাইল পরিবর্তন করছে তাদের দেখে।
খোদ ইন্ডিয়াতেও সব রাজ্যে হিন্দি সংস্কৃতির জয় জয়কার নেই। হিন্দি ভারতের রাস্ট্রীয় ভাষা হলেও মাদ্রাজ, কেরালা, গুজরাট ইত্যাদি আরো বহু রাজ্যের মানুষ হিন্দি বোঝে না। তারা যে যার নিজস্ব ভাষার সংস্কৃতিকেই স্বযত্নে ধরে রেখেছে। আর সেখানে আমরা অন্য দেশের মানুষ হয়ে আরেক দেশের সংস্কৃতিকে লালন পালন করছি!! চলমান স্বদেশি পন্য প্রমোটের আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি জরুরী এই বিজাতীয় হিন্দি টিভি চ্যনেল বর্জন। হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী বাঙ্গালী সংষ্কতি ফিরিয়ে আনতে হলে হিন্দি সংষ্কৃতি বর্জন করতে হবে। এই বর্জনে প্রয়োজন শুধু আপনার/ আমার সদিচ্ছা। স্বদেশিবোধ জাগ্রত করুন , স্বদেশি পন্য কিনুন ও স্বদেশি বাংলা সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনতে বলিষ্ট ভুমিকা রাখুন।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:২৬