জুলাই ১৬ (মঙ্গলবার) : আগের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যম্পাসে ছাত্র ছাত্রীদের দের ওপর পুলিশ ও ছাত্র লীগের ন্যক্কারজনক হামলার পর থমথমে রুপ ধারন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। মধ্যরাতে এই হামলার প্রতিবাদে একযোগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেন। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষোভে ছাত্রলীগের হামলার অভিযোগ ওঠে। ১৬ই জুলাই মঙ্গলবার দুপুর আড়াইটার দিকে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে রংপুর শহরের লালবাগ এলাকা থেকে ক্যাম্পাসের দিকে যায়। এরপর ক্যাম্পাসে প্রবেশের চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের বাধা দেয়। ফলে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ বাধে। তখন পুলিশ শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে রাবার বুলেট ছোড়ে। এতে বেরোবির ইংরেজি বিভাগের সমন্বয়ক আবু সাঈদ নিহত হন।
পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার একদিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি স্টেটাস দিয়েছিলেন আবু সাঈদ। যেখানে তিনি গণ অভ্যুত্থানে শহীদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শামসুজ্জোহাকে স্মরণ করেন। তিনি লিখেন, ‘স্যার! এই মুহূর্তে আপনাকে ভীষণ দরকার স্যার! আপনার সমসাময়িক সময়ে যারা ছিল সবাই তো মরে গেছে, কিন্তু আপনি মরেও অমর। আপনার সমাধি, আমাদের প্রেরণা। আপনার চেতনায় আমরা উদ্ভাসিত।’
শিক্ক্ষকদের ইঙ্গিত করে আবু সাঈদ বলেন, ‘প্রজন্মে যারা আছেন, আপনারাও প্রকৃতির নিয়মে একসময় মারা যাবেন। কিন্তু যতদিন বেঁচে আছেন মেরুদণ্ড নিয়ে বাচুঁন। নায্য দাবিকে সমর্থন জানান, রাস্তায় নামুন, শিক্ষার্থীদের ঢাল হয়ে দাঁড়ান। প্রকৃত সম্মান এবং শ্রদ্ধা পাবেন। মৃত্যুর সাথে সাথেই কালের গর্ভে হারিয়ে যাবেন না। আজন্ম বেঁচে থাকবেন শামসুজ্জোহা হয়ে। অন্তত একজন 'শামসুজ্জোহা' হয়ে মরে যাওয়াটা অনেক বেশি আনন্দের, সম্মানের আর গর্বের।’
বেরোবিতে আবু সাইদের জানাজা শেষে ছাত্রদের ‘’ আমার ভাই মরলো কেনো, জবাব চাই, জবাব চাই’’ শ্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে উঠে পুরো ক্যাম্পাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের শিক্ষক ওমর ফারুক বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করা হয়েছে। আমরা এর বিচার চাই। আমি মনে করি বিভাগীয় তদন্ত করে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক ড. মতিউর রহমান বলেন, একটি পাখিকেও একজন মানুষ এভাবে গুলি করে না যেভাবে গুলি করে শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে হত্যা করা হয়েছে। আমি তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, সারাদেশের শিক্ষক সমাজ যদি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতো তাহলে দেশ আজ এই অবস্থায় যেত না। শিক্ষকরা যখন মাথা নিচু করে চলতে শুরু করেছে, শিক্ষার্থীরা তখন পথ দেখিয়েছে। পুলিশ যেভাবে গুলি করেছে তাতে দেখতে হবে সরকারের নির্দেশ ছিল কি না যাকে পাও গুলি করো। যদি এটা না হয় তাহলে দেখতে হবে পুলিশ কেন অতি উৎসাহী হয়ে গুলি করল? আমরা এর বিচার চাই। আমি শিক্ষকদের বলবো আপনারা মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ান। তাহলে জাতির মেরুদণ্ড সোজা হবে। view this link
আবু সাইদের হত্যাকান্ড সম্পর্কে পরবর্তীতে সাবেক তথ্যপ্রতিমন্ত্রী আরাফাত বলেছিলেন, “ 'আপনারা টেলিভিশনে দেখেছেন ওদের চেহারা, এপ্রোচ, এক্সপ্রেশন, ড্রেসআপ! কোথাও আপনাদের মনে হয়েছিল কোমলমতি ছাত্র এরা? পুরো বুঝা যাচ্ছে এটা একটা জঙ্গি দল। আসছে, আক্রমণ করছে আর চলে যাচ্ছে। এবং এই ধরণের প্রমাণও পাওয়া গেছে, অনেককে ড্রাগ দেওয়া হয়েছে। এজন্য তারা বুক পেতে পুলিশের সামনে চলে আসে।'
সারাদেশে পুলিশ ও ছাত্রলীগের হামলায় ৬ জন নিহত হবার খবর প্রচার করে গনমাধ্যম। নিরস্ত্র ছাত্র হত্যা ও হামলার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। "আমার ভাইয়ের রক্ত, বৃথা যেতে দিবো না", "রক্তের বন্যায়, ভেসে যাবে অন্যায়" জ্বালাময়ী শ্লোগানে ক্যম্পাস প্রকম্পিত করে তোলে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীরা। রাত সাড়ে ৮টায় ঢাবি ভিসিচত্বরে পরবর্তী কর্মসূচির ঘোষণা দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ।হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, বুধবার ( ১৭ই জুলাই) দুপুর ২টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ‘গায়েবানা জানাজা ও কফিন মিছিল’ করবেন তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাত প্লাটুন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মোতায়েন করা হয় । রাত নয়টায় বিজিবির সদস্যরা ক্যাম্পাসে ঢুকে উপাচার্য বাসভবনের সামনে অবস্থান নেয়। view this link
রাতে দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এবং শিক্ষার্থীদের হল ছাড়তে বলা হয়। হল ছাড়ার সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীরা। সিন্ডিকেট মিটিংয়ে হল খালি করার নোটিশ দেয়া হলেও তা প্রত্যাখ্যান করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
জুলাই ১৭: মঙ্গলবার মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে ছাত্রলীগ নেতাদের বের করে দেয় শিক্ষার্থীরা । বঙ্গবন্ধু, জহরুল, একাত্তর, জসীম উদ্দিন, সূর্য সেন হল থেকে বিতারিত ছাত্রলীগ নেতাদের বিছানাপত্র বাইরে ফেলে দেয় ঢাবি শিক্ষার্থীরা। মধ্যরাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল ছাত্রলীগ সভাপতি আতিকা বিনতে হোসাইনসহ নয় নেত্রীকে হল থেকে মারধর করে বের করে দেয় ছাত্রীরা। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা অধিকাংশ হলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। হলকে রাজনীতিমুক্ত রেখে প্রশাসনিক ভাবে হল পরিচালনার দাবি তোলে সব হলের ছাত্র ছাত্রীরা। শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে ডজনখানেক হলে 'ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ' ঘোষণার অঙ্গীকারনামায় প্রাধ্যক্ষদের স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হয়। প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মো. ইকবাল রউফ মামুন বলেন, “শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে বিভিন্ন হলে প্রভোস্টরা বাধ্য হয়ে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করছেন।” । যে ১২টি হলে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধর অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করে প্রাধ্যাক্ষরা সেগুলো হলো- শহীদুল্লাহ হল, ফজলুল হক মুসলিম হল, অমর একুশে হল, রোকেয়া হল, মহসীন হল, কুয়েত মৈত্রী হল, জহুরুল হক হল, শামসুননাহার হল, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল, সুফিয়া কামাল হল, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল।রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণার পাশাপাশি আরও কয়েকটি নির্দেশনাও দেওয়া হয়। view this link
একই সময়ে বুয়েটের শিক্ষার্থীরা সকল একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম বন্ধ করে শিক্ষকদের নিজেদের কোয়ার্টার ত্যাগ করার জন্য নির্দেশ দিয়ে এক পরিপত্র জারী করে যেখানে তারা উদ্ভুত পরিস্থিতিতে নিশ্চুপ থাকার জন্য মেরুদণ্ডহীন, স্বার্থপর শিক্ষক, কর্মকর্তাদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
বুধবার দুপুর সারে ৩টার দিকে ঢাবি, বুয়েট সহ আরো বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীরা পুর্ব নির্ধারিত কর্মসুচী অনুযায়ী কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গায়েবানা জানাজা পড়েন। এরপর তারা মিছিল নিয়ে ভিসি চত্বরের সামনে যান। সেখানে দ্বীতিয় দফা গায়েবানা জানাজা পড়া হয় । এরপরে তারা কফিন মিছিল নিয়ে টিএসসির দিকে রওনা দিলে তাদের লক্ষ্য করে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে । এতে শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন সাংবাদিকদের বলেন ‘ ভিসি আমাদের অভিভাবক। অথচ তার বাসভবনের সামনেই আমাদের দিকে সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করেছে পুলিশ।’ বিকেল সাড়ে ৪টায় পাওয়া তথ্য অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে পুলিশের সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়া অব্যাহত আছে।view this link
এই দিন দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে ‘নিপীড়নবিরোধী শিক্ষক সমাবেশ’ শীর্ষক এক কর্মসূচি পালন করা হয়। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হত্যাকাণ্ড, হামলা ও নির্যাতনে দায়ী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে বিচার করে শাস্তি দেওয়াসহ বিভিন্ন দাবিতে সমাবেশ করেন বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষক। বুয়েটের শিক্ষক ড. আবদুল হাসিব চৌধুরী বলেন, "স্কুল-কলেজ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে গলা চেপে ধরা হয়েছে। শাহবাগে আমরা দেখলাম, বিজিবি সেখানে টহল দিচ্ছে। বলি, বাংলাদেশের সীমান্ত কি এখন শাহবাগ পর্যন্ত এসে ঠেকেছে যে বিজিবি আজকে এখানে? view this link
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের বলেন , দেশের সাধারণ মানুষ যখন ভোটের অধিকার নিয়ে কথা বলে, যখনই ভাতের অধিকার নিয়ে কথা বলে তখনই তারা রাজাকার হয়ে যায়। যখনই তারা ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে কথা বলে তখনই তারা রাজাকার হয়ে যায়। আর তারা নিজেরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী। অথচ এটাই সবচেয়ে বড় রাজাকারি। আজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের রাজাকার বলে গালি দেওয়া হয়েছে। তাদেরকে এ ধরণের অপবাদ দিয়ে সরকার জঘন্য অপরাধ করেছে।
view this link
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়িয়ে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে। নর্থ সাউথ, ব্র্যাক , বিইউপি, আইইউবি , ইত্যাদি ক্যম্পাসে শিক্ষার্থিরা বিক্ষোভ শুরু করে। এইদিন ব্র্যক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কর্মসূচীর সঙ্গে একাত্মতা জানিয়ে অংশ নেন ব্র্যাকের বিদেশি রেজিস্ট্রার ড. ডেভিড ডাউল্যান্ড।ডেভিড ডাউল্যান্ড শিক্ষার্থীদের বলেন, ‘তোমাদের দাবি আদায়ের কর্মসূচিকে আমি উৎসাহিত করছি। তোমরা নিরাপদে থেকো। কর্মসূচিতে কোনো ধরনের আক্রমণ হলে আমি প্রধান ফটক খুলে দেব। বাকিটা নিরাপত্তাকর্মীরা দেখবে। তোমরা চিন্তা করো না।
১৭ই জুলাই বুধবার রাতেই সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের হল ছাড়তে বাধ্য করে পুলিশ ও হল প্রসাষন। পুলিশ, বিজিবি, র্যাব , সোয়াটের ন্যক্কারজনক হামলার প্রতিবাদে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সংগঠন কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসুচী ঘোষনা করে। বুধবার (১৭ জুলাই) রাত ৮টার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফেসবুক পেজে এই ঘোষণা দেয়া হয়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন - পর্ব ১
ছবি ও তথ্যসুত্র ঃ গনমাধ্যম ও বুয়েটিয়ান গ্রুপ ( ফেসবুক)
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা অক্টোবর, ২০২৪ রাত ১০:০০