৩২শে জুলাই ( অগাস্ট ১ ) : এইদিন দুপুরে গ্রেফতারকৃত ৬ সমন্বয়ককে ছেড়ে দেয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ছাড়া পাওয়ার পর জানা যায় যে, ডিবি কার্যালয়ে ৬ সমন্বয়ক ৩০শে জুলাই থেকে অনশন করছিলেন। টানা ৩২ ঘন্টা অনশনে ছিলেন সমন্বয়কেরা যা তাদের পরিবার এবং মিডিয়ার কাছ থেকে কঠোরতার সাথে গোপন রাখা হয়। শারীরিকভাবে প্রচন্ড বিপর্যস্ত অবস্থায় সন্তানদের ফেরত পান বলে মিডিয়াকে জানান অভিভাবকবৃন্দ।
৩৩শে জুলাই ( অগাস্ট ২ ) : এক যৌথ বিবৃতিতে ছয় সমন্বয়ক জানান যে, আন্দোলন প্রত্যাহারের স্টেটমেন্টটি আমরা স্বেচ্ছায় দেইনি।বৈষম্যবিরোধি আন্দলনের কোন সিদ্ধান্ত ডিবি অফিস থেকে আসতে পারে না।
সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ ফেসবুকে এক পোস্টের মাধ্যমে নতুন কর্মসুচী ঘোষনা করেন -
সারাদেশে ছাত্র-নাগরিকদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে হামলা করে খুনের প্রতিবাদ ও ৯ দফা দাবিতে আগামীকাল শনিবার সারাদেশে বিক্ষোভ মিছিল ও রবিবার থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য "সর্বাত্মক অসহযোগ" আন্দোলনের ডাক দেওয়া হলো।
সারাদেশের আপামর জনসাধারণকে অলিতে-গলিতে, পাড়ায় পাড়ায় সংগঠিত হয়ে কর্মসূচি সফল করার আহ্বান করা যাচ্ছে। অসহযোগ আন্দলন সফল করার লক্ষ্যে বৈষম্য বিরোধি আন্দোলনের পক্ষ থেকে কিছু নির্দেশনা দেয়া হয় জনগনের উদ্দেশ্যে।
তীব্র দমন নীপিড়নের মুখেও সারা দেশে আন্দোলনের তীব্রতা ছড়িয়ে পড়ে। মুষলধারে টানা বৃষ্টিও পারেনি মানুষকে ঘরে আটকে রাখতে। রাজধানীর উত্তরা, বাড্ডা, যাত্রাবাড়ী , মিরপুর রনক্ষেত্রে পরিনত হবার খবর আসে দফায় দফায়। শহীদ মিনারে শিক্ষার্থীরা স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পদত্যাগ চেয়ে জ্বালাময়ী শ্লোগান দিতে থাকে।
৩৪শে জুলাই ( ৩রা অগাস্ট) : সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ এক ফেসবুক পোস্টে ঘোষনা দেন -
আজ কেউ ঘরে বসে থাকবেন না। আপনার নিকটবর্তী বিক্ষোভ মিছিলে যোগ দিন। না হলে নিজ এলাকা থেকেই সংগঠিত করে বিক্ষোভ মিছিল বের করুন। ৩ টার আগেই সবাই দলে দলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে চলে আসুন। ছাত্র-জনতার আশা-আকাঙ্ক্ষার ঘোষণা নিয়েই আজ আসছি।
শান্তিপুর্ণভাবে বিক্ষোভ মিছিল পালন করুন৷ আঘাত কিংবা বাঁধা আসলে প্রতিরোধ করুন। অনুপ্রবেশ করে যেন কেউ আন্দোলনকে বিতর্কিত না করে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখুন।
আসিফ মাহমুদ
সমন্বয়ক
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন
দুপুরের আগেই স্রোতের মত মানুষ শহীদমিনারে ছুটে যেতে থাকে। জনসমুদ্রে পরিনত হয় পুরো এলাকা। বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে সমবেত ছাত্র-জনতার উদ্দেশে বক্তব্য দেন নাহিদ ইসলাম। সমাবেশে দেওয়া বক্তব্যে নাহিদ ৯ দফার বদলে ১ দফা দাবি তুলে ধরেন। ১ দফা দাবি হলো, সরকারের পদত্যাগ। এ দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আগামীকাল রোববার থেকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন কর্মসূচি পালন করবে। নাহিদ বলেন, ‘‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে আমরা খুব দ্রুতই সর্বস্তরের নাগরিক, ছাত্রসংগঠন ও সব পেশাজীবী মানুষের সঙ্গে মিলে সম্মিলিত মোর্চা ঘোষণা করব। সবার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জাতীয় রূপরেখা আমরা সবার সামনে হাজির করব৷’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘আমরা এমন একটি বাংলাদেশ গঠন করতে চাই, এমন একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরি করতে চাই, যেখানে আর কখনো কোনো ধরনের স্বৈরতন্ত্র-ফ্যাসিবাদ ফিরে আসতে না পারে৷’’
৩৫শে জুলাই ( অগাস্ট ৪) : ৫ই অগাস্ট সমাবেশ এবং ৬ই অগাস্ট 'লংমার্চ টু ঢাকা' কর্মসূচি ঘোষনা দেয় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন।সারাদেশে প্রতিটি পরিবার থেকে একজন করে ঢাকায় মুক্তির লড়াইয়ে শামিল হবার আর্জি জানান সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ।
সরকার পতনের ১ দফা ঘোষনার পর স্বৈরাচারী সরকার ছাত্র-জনতার ওপড় দানবীয় কায়দায় হামলে পড়ে। একদিনেই ৮০ র উপর মৃত্যূর খবর ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ঢাকা মেডিকেল থেকে মরদেহ বের করে কাধে নিয়ে আন্দোলনকারীরা বিক্ষোভ করতে থাকে।
সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ এক ফেসবুক লাইভে এসে সেনাবাহিনীকে অফিশিয়ালি গণঅভ্যুত্থান সমর্থনের আহবান জানান এবং সেই সাথে লং মার্চ টু ঢাকা কর্মসুচী একদিন এগিয়ে ৫ই অগাস্ট করার ঘোষনা দেন।
রাজধানীসহ সারাদেশে রোববার (৪ আগস্ট) দুপুর ২টা থেকে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যায়। অনেক এলাকায় গ্রামীণফোনের নম্বর দিয়ে কলও দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, ম্যাসেঞ্জারও বন্ধ হয়ে যায়। তবে ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়নি বলে দাবি করেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। মিডিয়াকে তিনি জানান যে, আমরা কোথাও ইন্টারনেট বন্ধ করিনি। বন্ধের কোনো নির্দেশও দেইনি। কোথাও কোথাও ইন্টারনেটের সমস্যা হচ্ছে। এটা আমাদের নির্দেশনার কারণে নয়!!! ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যাবার কারনে আবারো প্রবাসিরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে দেশ থেকে। প্রচন্ড উৎকন্ঠায় কাটতে থাকে প্রতিটা মুহুর্ত। তবে ভিপিএন এর মাধ্যমে অনেকেই ইন্টারনেট সংযোগ পেতে সফল হয়।
৩৬শে জুলাই ( ৫ অগাস্ট) : লং মার্চে যোগ দেয়ার উদ্দেশ্যে ভোরের আলো ফোটার আগেই বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকার উপকন্ঠে পৌছে যায় লাখ লাখ মানুষ।বাধ ভাঙ্গা স্রোতের মত ঢাকার সব প্রবেশ মুখ দিয়ে প্রবেশ করতে থাকে ছাত্র- জনতা।বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধিরা ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ স্পট ও প্রবেশমুখ গুলোতে উপস্থিত থেকে জনতাকে গাইড করতে থাকে। ঢাকামুখী এই বিপুল জনস্রোত ঠেকাতে হত্যাযজ্ঞ নেমে পড়ে আইন শৃংখলা বাহিনী। সমন্বয়ক রিফাত রশিদ ফেসবুকে জানায় যে, আসিফ-বাকের-মোয়াজ্জেম ভাইকে হত্যার জন্য চানখারপুলে বার্ন ইউনিটের উপর থেকে স্নাইপার দিয়ে গুলি চালায়।
কেন্দ্রীয় সমন্বয়কেরা সবাই এরপর শাহবাগে অবস্থান নেয়। সেখান থেকেই তারা জ্বালাময়ী বক্ততা জারী রাখে। আসিফ সতর্কবার্তা দিয়ে বলেন - দাবানলের সামনে দাড়ানোর দুঃসাহস দেখাবেন না। পুড়ে ছাই হয়ে যাবেন। শহীদি মৃত্যূর প্রস্তুতি নিয়ে নাহিদ ইসলাম আগেই এক ভিডিও বার্তাও বানিয়ে রাখেন, দু-একজন জার্নালিস্টকে এই ভিডিও বার্তা পাঠিয়ে রাখেন যদি তারা কেউই পরবর্তীতে ঘোষণা দেওয়ার জন্য বেঁচে না থাকে; তাহলে ৫ তারিখের পর যাতে আন্দোলন নির্দেশনার অভাবে নিস্তেজ না হয়ে যায়।
লাখ লাখ মানুষ গনভবন অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। ফেবুকে ইউটিউবাররা জানান যে , গণভবনের আশেপাশে কয়েকস্তরের কাঁটাতারের বেষ্টনী স্থাপন করা হয়েছে। কাঁটাতারের বেষ্টনী ক্রস করার ওয়্যার কাটার, ভারী কম্বল, তোষক, ভারী চটের বস্তা, হেভি ডিউটি/ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্লাভস ব্যহারের পরামর্শ দেন তারা। লংমার্চ গনভবনে পৌছানোর আগেই স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পলায়নের খবর ছড়িয়ে পড়ে। মুহুর্তের মধ্যে লংমার্চ পরিনত হয় বিজয় মিছিলে। হেলিকপ্টারে চড়ে পালানোর এক ভিডিওতে বোনসহ পালাতে দেখা যায় বাংলাদেশের ইতিহাসের নিষ্ঠূরতম স্বৈরশাষককে। লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে বিজয় উল্লাসে ফেটে পড়ে। ঈদের আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে পুরো দেশজুরে…
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন - পর্ব ১
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন - পর্ব ২
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন - পর্ব ৩
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন - পর্ব ৪
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন - পর্ব ৫
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন - পর্ব ৬
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন - পর্ব ৭