ভদ্রলোক সম্ভবত কানে খাটো। হতেও পারে। এটা তো আর অস্বাভাবিক কিছু না। দিনকাল যা পড়েছে তাতে কান ঠিক রাখাও এক ধরনের বীরত্ব। কোথায় নেই শব্দের অত্যাচার? ব্যস্ত রাস্তা থেকে শুরু করে শোবার ঘর অব্দি, শান্তি নেই কোথাও। তবে আশার কথা হল বিজ্ঞান নামক দৈত্যের পেটটা দিনে দিনে ফুলে ফেপে উঠছে। ভবিষ্যতে হয়ত শহরের লোকেরা কৃত্রিম কান তৈরি করে ফেলবে। যাতে করে ঐ বোকাসোকা ঈশ্বরের দেওয়া কর্ণদ্বয় অকেজো হয়ে গেলেও শুনতে অসুবিধে না হয়। এখনই অবশ্য বুদ্ধিমান লোকেরা কি একটা যন্ত্র তৈরি করে ফেলেছে। যাদের কানের ক্ষমতা কমে গেছে তারা সেই যন্ত্র লাগিয়ে আগের মতই শুনতে পায়। রুবির পাশের সিটে বসে থাকা লোকটার কানে সেরকম কোন যন্ত্র নেই। কি জানি, লোকটার হয়ত যন্ত্র কেনার মত টাকা পয়সাই নেই। কিন্তু বেশভূষা দেখে তো সেরকম মনে হচ্ছে না। অবশ্য বেশভূষা দেখে বোঝার উপায় নেই কার কি আছে। এই যেমন গলির মোড়ের কানা রহিম। প্রতিদিন ঘর থেকে বের হতেই দেখা হত। পা দুটো ছড়িয়ে, ভাঙা থালাটা সামনে রেথে, চোখেমুখে করুণ একটা ভাব ফুটিয়ে ,শীর্ণ দেহটা থামের সাথে লাগিয়ে বসে থাকত। তার নাকি দেড় লাখ টাকা জমা আছে ব্যাংকে। খবরটা রুবি জেনেছে লোকটা মরে যাওয়ার পর।
পত্রিকার পাতায়। পত্রিকাগুলোই কি আর সব খবর সত্যি লিখে। দেখে তো মনে হয় সবাই একবারে সাধুসন্ত। কিন্তু ভেতরে ভেতরে?
সেদিন মৌচাক মার্কেটের সামনে ছিনতাইকারীকে ধরল জনতা। আর সব পত্রিকায় খবর বের হল স্থানীয় এক রাজনীতিবিদ এর ছেলে নাকি সিনেমার নায়কদের মত ধাওয়া করে ছিনতাইকারী ধরেছে। পাশের বাসার কবির সাহেব সকালবেলা সুট টাই পড়ে অফিসে যান। সেদিন রঞ্জু বলল, আসলে নাকি লোকটা প্রতিদিন রমনা পার্কে গিয়ে বসে থাকে। সংসার চলে বড়লোক শ্বশুড়ের টাকায়। এমনকি হাতখরচও গুণে গুণে দেয় বউ। প্রতিদিন বিশ টাকা। পার্কে বসে বাদাম খাদাম খাওয়ার জন্য। এর বেশি চাইতে গেলে আগে বউয়ের দাপানি খেতে হবে। অথচ লোকটাকে দেখে মনে হয় মন্ত্রী টন্ত্রী গোছের কিছু একটা হবে। সমাজের লোক যাতে নিন্দে না করে এজন্য প্রতিদিন অফিস যাওয়ার অভিনয়টা করে।
রুবিদের দোতলা বাসাটার নিচতলায় থাকতেন রফিক মুন্সী। দাড়ির জঙ্গল মুখটায় সবসময় মিষ্টি মিষ্টি কথা। আল্লার নাম না নিয়ে এক পাও এগোন না। হাতের তসবিহ টা ব্যবহার করতে করতে ক্ষয় হয়ে গেছে। চাকরি করতেন কাস্টমস এ। সবাই বলত লোকটা নিশ্চিত বেহেস্তে যাবে। আজকালকার যুগে এমন সৎ মানুষ খুব কমই হয়। কাস্টমস এ কাজ করে অথচ সংসার চালাতেই কষ্ট হয়। একপয়সা ঘুস খায় না। কাস্টমস তো টাকার খনি। রফিক সাহেবকে ধরে নিয়ে গেল দুদকের কর্মকর্তারা। তার নাকি টাকা জমা আছে বিদেশী ব্যাংকে। পরিমাণটা এতই বড় যে বাংলাদেশী ব্যাংকে রাখতে ভরসা পাচ্ছিলেন না। সবই ঐ কাস্টমস নামক খনি থেকে তোলা।
আর পারছে না রুবি। ছোটখাট মানুষ সে। বসেছেও আটোসাটো হয়ে। তাও লোকটা একেবারে গায়ের উপর চেপে আছে। তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। শান্তিনগর মোড় থেকে উঠার পর একবারের জন্যও রুবির দিকে ফেরেনি। ভাবখানা এই, পাশেই যে একটা মেয়ে বসে আছে তা সে জানেই না। অথচ রুবির সিটের অর্ধেকটা এখন তারই দখলে। রুবি কয়েকবার চেষ্টা করেছে লোকটাকে তার অস্বস্তির কথা বুঝিয়ে দিতে। দুচারবার নড়াচড়া, সাত আটবার কাশি আর দশ-পনেরবার মিনমিনিয়ে বলেছে, “ভাই একটু সরেন”। কিন্তু লাভ হয়নি কোন। এরপর জোড়েসোরেই কয়েকবার বলল, “এই যে ভাই”। লোকটা যেন পাথরের মূর্তি।
লোকটা কি ইচ্ছে করেই শুনছে না? অসম্ভব কিছু না। এসব তো হরহামেশাই হয়। রাস্তঘাটে চলতে ফিরতে ভিড়ের সুযোগে সুন্দরী মেয়েদের গন্ধ নেওয়া, মাঝেমধ্যে নিষিদ্ধ অঙ্গে হাত লাগিয়ে দেওয়া। অনেক ছেলেই এসব করে। রুবির পাশে দাঁড়ালে কিছু কিছু ছেলের একটা জায়গা যে ফুলে যায় তা রুবি ঠিকই টের পায়। এই লোকটাও কি তাদের মতই একজন? গায়ে হাত দেওয়ার চেষ্টা করেনি এখন পর্যন্ত। শুধু রুবির সিটের অর্ধেকটা দখল করে বসে আছে। দেখে মেনে হচ্ছে কি একটা চিন্তায় ডুবে আছে। কি করা উচিত বুঝতে পারছে না রুবি।
গলাটা বেশ চড়িয়ে একটু ঝাঁঝের সঙ্গেই সে বলল,
-এই যে ভাই একটু চেপে বসেন।
লোকটার কোন বিকারই নেই। পিছনের সিট থেকে মাঝবয়সী এক লোক দাঁড়িয়ে গেল তখন।
-কি হয়েছে আপা?”
- দেখুন না সেই কখন থেকে বলছি সরে বসতে, লোকটা শুনছেই না।
- আর বলবেন না। এসব বদমাইশদের জন্য মা বোনদের নিয়ে রাস্তায় বের হওয়াই দায়। দাঁড়ান দেখাচ্ছি মজা।
কিরে শালা কথা শুনছিস না কেন? মেয়েছেলে দেখলেই বুঝি চুলকানি শুরু হয়ে যায়?
নিজের সিটে বসেই চেচামেচি শুরু করল মাঝবয়সী ভদ্রলোক। আর তা শুনে আশেপাশের নারীবাদী পুরুষের দল দাঁড়িয়ে গেল। নিজেদেরে ঝুলিতে জমানো সব ধরনের গালগাল একসাথে বাজাতে লাগল। অথচ এদের অনেকেই খানিক আগে উঁকিঝুকি মেরে দেখছিল রুবিকে। হয়তো এদের নিজেদেরও চুলকানি শুরু হয়ে গিয়েছিল। এতক্ষণে মোক্ষম একটা সুযোগ পেয়েছে তা থামানোর।
একজন বলল,
- ব্যাটাকে পুলিশে দেওয়া উচিত।
সাথে সাথে যোগ করল আর একজন,
- তার আগে জুতাপেটা করতে হবে ভাল করে।
আরও এককাঠি বাড়িয়ে বলল একজন,
-মাথা ন্যাড়া করে আলকাতরা ঢাললে খুব ভাল হয়।
প্রতিবাদ করল বিশ বাইশ বছরের এক ছোকড়া,
-না না । হাত পা বেধে ন্যাংটো করে দাঁড় করিয়ে রাখা উচিত তিন রাস্তার মাথায়।
রুবির মনে হল একটা গন্ডগোল আছে কোথাও। নইলে নিজের দেহটার এতসব প্রক্রিয়াকরণ শুনেও লোকটা এমন নির্বিকার থাকে কি করে? একটা কথাও বলেনি সে।
ততক্ষণে ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলেছে উপস্থিত জনতা। বিশ বাইশ বছর বয়সী ছেলেটা উঠে এসে ঠাস করে থাপ্পর বসিয়ে দিল। লোকটা পড়ল একবারে রুবির কোলে। একটুও নড়াচড়া নেই। লোকটা কি মরে গেল?
মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে গেল সকলে।
হাসপাতালে নেওয়ার পর বোঝা গেল আসল ব্যাপার। কোন কারণে লোকটা অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল বাসের ভিতর। সেজন্যেই সবার চেচামেচি সত্বেও কথা বলেনি সে। ডাক্তাররা অবশ্য তার দেহে কোন রকম অস্বাভাবিকতা খুঁজে পাননি। রক্তচাপ, নাড়ীর গতি, তাপমাত্রা সবই ঠিকঠাক। তবু কেন যেন সে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। অনেক সময় হয় এমন।
রুবিই তাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে। লোকটা পড়ে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে কেটে পড়েছিল সবাই। যে ছেলেটা থাপ্পর দিয়েছিল সবার আগে অদৃশ্য হয়েছিল সে। শুধু রুবিই রয়ে গিয়েছিল। সবাই ধরে নিয়েছিল লোকটা মরে গেছে। তার মনে হচ্ছিল লোকটা মরে যাওয়ার জন্য দায়ী সেই। হয়ত আগে থেকেই মৃত ছিল। এক থাপ্পরে কি আর মানুষ মরে যায়? কেউ কেউ ভাবল হতেও পারে। জায়গামত পড়লে থাপ্পড় বুলেটের সমান। পুলিশের খপ্পরে পড়তে চায়নি কেউ। তাই পালিয়ে গিয়েছিল। ড্রাইভার আর তার সহযোগীরা যেতে পারেনি গাড়িটার কারণে।
রুবি তখন অথই সমুদ্রে। এরকম একটা অবস্থায় মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করতে হয়। কি করা যায় ভাবছিল সে। আর তথনই বাবা ফোন করলেন।ফিরতে দেরি হওয়ায় চিন্তা করছে বাসার সবাই। করাই কথা। সন্ধ্যা হয়ে গেছে ঘন্টাখানেক আগেই। চাকরি করে বটে, তবে রাত করে বাড়ি ফেরার অভ্যাস রুবির নেই। বাবাকে সে সব বলল। আশেপাশে লোক জমে গেছে যথেষ্ট, কিন্তু ড্রাইভারের কাছে সব শুনে কেউই সামনে এগোয়নি। পুলিশে ছুলে আঠার ঘা। কেউ ছুয়ে পর্যন্ত দেখেনি লোকটা সত্যিই মরে গেছে কিনা।
সব শুনে বাবা বললেন আগে দেখতে লোকটা মৃত না জীবিত।
বেঁচে আছে, হা মরেনি লোকটা। রুবির মুখে হাসি ফুটল। রুবি লোকটার হৃদস্পন্দন টের পেয়েছে। একটা ট্যাক্সি ডেকে লোকটাকে নিয়ে পৌছে গেল সিটি হসপিটালে। বাবাও পৌছে গেলেন খানিক পরেই। জ্ঞান ফিরতেও সময় লাগে নি খুব বেশি। কোন রোগবালাই নেই তার। স্রেফ খানিকটা ক্লান্তি। সুতরাং হাসপাতালে থাকতে দেওয়ার প্রশ্নই উঠে না। কিন্তু একটা সমস্যা রয়েই গেল। জানা গেল লোকটা শহরে নতুন এসেছে। উঠার কথা ছিল দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাসায়। কিন্তু এমন ঘোরের মধ্যে রাতের বেলায় সেই আত্মীয়ের বাসা তো খোঁজা সম্ভব না। লোকটা অনুরোধ করল তাকে একটা ভাল হোটেল ঠিক করে দিতে।বাবার মুখের দিকে তাকাল রুবি। রুবির বাবা আজমল সাহেব একজন প্রাণখোলা লোক। রুবি জানে এরকম বিপদগ্রস্ত একটা মানুষকে তিনি অবশ্যই হোটেলে থাকতে দিবেন না। কিন্তু তার নিজের কেমন জানি ভয় ভয় লাগছে। ঠিক ভয় না, কেমন যেন একটা অস্থির অনুভূতি। অজানা অচেনা লোককে বাসায় থাকতে দেয়া। কেউ কি বলতে পারে কার মনে কি আছে?
বাসায় পৌছতে পৌছতে এগারটা বেজে গেল।। লছনি বুয়া রান্না বেশ ভালই করে। ওদরে ঘরে তিনজন মাত্র লোক এখন। কদিন হল ভাইকে নিয়ে মা গেছেন গ্রামের বাড়ীতে। বাবা, রুবি আর লছনি। তিনজনই এখন বাসায়। বাবা অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা, রিটায়ার করেছেন দুবছর হল। ঘরে শুয়ে বসে থাকা আর রুবির জন্য পাত্র খোজাই এখন তার প্রধান কাজ। সংসার চলে রুবি আর তার ভাইয়ের রোজগারে। দুজনেই চাকরি করে প্রাইভেট ফার্মে।
সঙসারে অভাব তেমন নেই। ধীরে ধীরে কিছু গয়না গাটিও জমিয়ে ফেলেছে। এসব মায়ের কারসাজি। রুবিকে যখন বিয়ে দেবে তখন নাকি রাজকন্যার মত সাজিয়ে দেবে। আর ভাইটা হয়েছে মায়ের মতন। বোনকে ঠিকমত সাজিয়ে দিতে না পারলে নাকি তার নিজের কখনো বিয়ে করতে ইচ্ছে হবেনা। রুবি অবশ্য জানে মুখে যাই বলুক ভাই আসলে নিজের স্বার্থেই রুবির বিয়ের জন্য এমন কোমর বেঁধে লেগেছে। না হলে যে শীলাদির সাথে তার বিয়েটা হবেনা। মনে মনে হাসে রুবি। ভাইযে গোপনে আলাদা করে টাকা জমায় এটাও সে জানে। সবই আছে ওই বড় আলমারিটাতে। ভাইয়ের নিজস্ব ড্রয়ারে।
আশ্চর্য লোকটা। কোন মানুষ যে এতটা চুপচাপ হতে পারে একে না দেখলে রুবির জানাই হত না। হাসপাতালে যা কয়েকটা কথা বলেছিল। এরপর থেকে মুখে কুলুপ এটে দিয়েছে। কেমন যেন গোয়েন্দাদের মত দৃষ্টি। আর সবসময় ভাবছে কি যেন। চেহারা সুরত অবশ্য খারাপ না। গ্রামের ছেলে, কিন্তু দেখে মনে হয় না নতুন পরিবেশে ভয় পাচ্ছে। বরং সবসময় ঠোটের কোণে অবজ্ঞার ভঙ্গি লেগে আছে। লোকটা চোখদুটোর কারণেই বিদঘুটে লাগে দেখতে। ইদুরের মত। পিট পিট করে তাকায়। লোকটার কি কোন মতলব আছে? বুঝতে পাছে না রুবি।
লছনিকে দিয়ে গেষ্টরুমটা ঠিকঠাক করে দিল। খাবার দিয়ে আসার পর রুবি লক্ষ্য করল লছনির মুখে স্পষ্ট বিরক্তি। লোকটা নাকি তাকে দেখে অদ্ভুত একটা হাসি দিয়েছে। জানতে চেয়েছে বাসার সবার সম্পর্কে। বাসায় মানুষ কজন?কে কি করে?এসব আর কি।
রুবিকে সে বলে দিল লোকটাকে তার ভাল লাগেনি। বাড়িতে এসেই জানতে চাইছে কে কি করে। বেতন কেমন? আবার বলে রুবির বিয়ে হয়েছে কিনা? রুবির মনে হল এত তো অস্বাভাবিক কিছু নেই। একটা বাড়িতে সে আশ্রয় পেয়েছে, বাড়ির লোকগুলো সম্পর্কে জানার ইচ্ছে তো হতেই পারে।
সাড়ে বারোটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল সবাই।
যতক্ষণে রুবির ঘুম ভাঙল ততক্ষণে পেরিয়ে গেছে আঠারটা ঘন্টা। সে নিজেকে আবিষ্কার করল হাসপাতালের কেবিনে। লছনি আর বাবারও একই অবস্থা। লোকটার কোন খোজ পাওয়া যায়নি।
২৭.১১.২০১০
সকাল ১০.৩০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



