খুব বেশিদিন হয়নি ঢাকায় এসেছি। সেজন্যেই হয়ত জ্যাম দেখলেই নষ্টালজিয়ায় আক্রান্ত হই। ঢাকার তুলনায় বলতে গেলে চিটাগং এ জ্যামই নেই। জ্যাম ব্যাপারটা অঙ্গাঅঙ্গিভাবে লেগে আছে ঢাকার রাজপথে। আর বিশেষ করে অফিস টাইমে তো আর কথাই নেই। প্রতিদিন শুধুমাত্র ফার্মগেট এর সিগন্যাল পার হতেই আধাঘন্টা লাগে। হিসাব টিসাব করে দেখলাম মোহাম্মদপুর থেকে কাউরানবাজার এ এসে ৯টায় অফিসে এসে হাজিরা দিতে হলে ঘন্টাখানেক সময় হাতে নিয়ে বেরোনোই বুদ্ধিমানের কাজ। আপেল মামা একটা ভাল পরামর্শ দিয়েছেন। “জ্যাম এ পড়লেই পাজোড়া(পাজেড়ো নয়) চালিয়ে দিবে। আবার যখন জ্যাম ছুটবে বাস উঠে যাবে। সাবধান ভাড়া কিন্তু আগেই দিয়ো না। আবার কখন নেমে পড়তে হয়!” আমার সকালবেলার সাধের ঘুম একেবারে গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে রাজপথে মারা গেল। কি আর করা, পেটের দায় বড় দায়। কুম্ভকর্ণ হয়ে গেল ভোরের পাখি।
আজকেও সেই একই কাহিনী। যুদ্ধ করে অফিসে এলাম। কাজ-টাজ শেষে আবার মনে মনে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে অফিস থেকে বের হলাম। যথারীতি জ্যাম। আপেল মামার বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে হাটা শুরু করলাম ফার্মগেটের দিকে। প্রথম আলো অফিসের কাছে আসতেই দেখি বিরাট জটলা। করুণ চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা বাস। আমাদের দেশে এটাও খুবই স্বাভাবিক একটা ঘটনা।
বল্টু ভাইকে পুলিশে ধরেছে? বাস ভাঙো।
ভাড়া বেশি? বাস ভাঙো।
কন্ডাক্টর বেয়াদবি করেছে? বাস ভাঙো।
কদম আলীর মুরগী রাস্তা পার হতে গিয়ে মারা গেছে? অবশ্যই বাস ভাঙো।
চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য কাচেঁর টুকরা। প্রত্যেকটা জানালা ভাঙা। পঞ্চাশোর্ধ এক মহিলা রাস্তার পাশে বসে আছে হতবুদ্ধি হয়ে। হাতের কয়েক জায়গায় কেটে গেছে। তিনি বাসের ভিতরেই ছিলেন। তার মত এরকম শখানেক যাত্রী ছিল বাসে। ছেলে , মেয়ে ,শিশু ,বুড়ো সব। সন্ধ্যায় কিরকম গাদাগাদি করে কিভাবে মানুষ বাসে উঠে তা তো সবারই জানা। আর এ অবস্থায় বাসটা ভাঙা হয়েছে। আতঙ্কে নীল হয়ে গিয়েছিল সবাই। ঐ পঞ্চাশোর্ধ সেই মহিলার ভাষায়, “মনে হচ্ছিল যেন গোলাগুলি শুরু হয়েছে। আর বাসায় ফেরা হবেনা।”
বাসটা যারা ভেঙেছে তারা সবাই খুব সচেতন মানুষ। ৫০-৬০ জন তরুণ। সবার হাতেই রড। তার সবাই স্কুল কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। উপস্থিত জনতার কাছে শুনলাম আহসানউল্লাহ ইউনিভার্সিটির ছাত্র এরা। যদি তাই হয়ে থাকে নিঃসন্দেহে সবার বাবাই কাড়ি কাড়ি টাকার মালিক।
এক হকার বলছিল, “লাখ টাকা দিয়া ভার্সিটিতে পড়ে আর বাসভাড়া দিতে পারে না।”
একজনকে ধরেছে পুলিশ। আর একজন আবার পুলিশের কাছে সাফাই গাইছে “ড্রাইভার আমাদের সাথে বেয়াদবি করেছে”। পুলিশ তাকেও নিয়ে গেল। কি করবে তা অবশ্য আমি জানি না।
গাবতলীর বাসের নিয়মিত যাত্রী আমি। ছাত্রদের কাছ থেকে ওরা অর্ধেক ভাড়া নেয়। ব্যাপারটা বেশ ভালই লেগেছিল। কিন্তু একদিন দেখলাম এক ছেলের কাছে ভাড়া চাওয়ার পর সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।
কয়েকবার চাওয়ার পর কন্ডাক্টর বলল, ভাড়া নাই কইলেই পারেন।
ছেলেটি তখন বলল, থাকবোনা কেন? আছে, কিন্তু দিমুনা।
কন্ডাক্টর কারণ জানতে চাইল।
ছেলেটি বেশ হামবড়া ভাব নিয়ে বলল, স্টুডেন্ট।
তার চাউনি দেখে মনে হচ্ছিল ভাড়া চেয়ে কন্ডাক্টর দুনিয়ার সবচেয়ে বড় অপরাধ করে ফেলেছে।
স্টুডেন্টদের জন্য বাসভাড়া মাফ! অবাক কান্ড, জানতামই না।
সেই বাসেই আরও দশ পনেরজন ছাত্র ছিল। ওরাও মনে হয় জানে না। তাই ভাড়া দিয়েছে।
একবার এক স্টুডেন্ট বাড়ী যাওয়ার সময় তার কম্পিউটারের জন্য অতিরিক্ত ভাড়া দাবী করায় সাঙ্গ পাঙ্গ নিয়ে অনেকগুলো বাস ভেঙেছিল তা অনেকেই জানি। টঙ্গীতে তা-মীরুল মিল্লাতের ছেলেরা রাস্তার রাজা। ওরা ইচ্ছে করলেই পুরো রাজপথ বন্ধ করে দিতে পারে। অনেক কলেজ ইউনিভার্সিটিতেই ছাত্ররা তাদের ছাত্রত্ব দেখায় ভাঙচুরের মাধ্যমে। এমনকি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের নিজেদের ন্যায়সঙ্গত দাবী নিয়ে যখন আন্দোলন হয়েছিল তখনও ভাঙচুর করে কোটি টাকার ক্ষতি করেছিল এক শ্রেণীর ছাত্র। আর কিছুদিন আগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও তাই করেছে।
কিন্তু এটাই কি হওয়া উচিত। এতে করে কি কোন সমস্যার সমাধান হয়। বাসের যে যাত্রীরা কষ্ট পেয়েছে তাদের কি দোষ ছিল? ছাত্ররা কেন জংলী জানোয়ায়ারের মত আচরণ করবে? আমরা কি পারি না বুদ্ধি দিয়ে আলোচনার মাধ্যমে অন্যকে কষ্ট না দিয়ে কোন সম্পদ নষ্ট না করে সমস্যার সমাধান করতে? না পারলে আমাদের অর্জিত জ্ঞানের মূল্য কোথায়?

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



