somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৭০

১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১২:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


কল্মাষপাদ রাজার উপাখ্যানঃ

বিশ্বামিত্র মুনি হলেন অতি মহান যোগী তপস্বী। তাঁর সমান কেউ নেই। কিন্তু বিশ্বামিত্রের মনে সব সময় বশিষ্ঠের অপমানের কথা মনে ছিল। সুর(দেবতা), অসুর, নাগ, নর সকলে বশিষ্ঠের পূজা করে। দেবরাজ তাঁর সাথে বসে সুধা পান করেন। এত সব ভেবে ভেবে তিনি বশিষ্ঠের উপর আরো ক্রোধিত হলেন। বশিষ্ঠের কোন ছিদ্রতা, দুর্বলতার খোঁজে তিনি ঘুরতে লাগলেন।

ইক্ষ্বাকুবংশের রাজা সর্বগুণ সম্পন্ন, সংসারে তিনি কল্মাষপাদ নামে বিখ্যাত। মহা মুনি বশিষ্ঠ তাঁর পুরহিত। রাজা যজ্ঞের কারণে বশিষ্ঠকে আমন্ত্রণ জানালেন। কিছু কাজ থাকায় বশিষ্ঠ আসতে পারলেন না। রাজা বলে পাঠালেন তিনি তখনই যজ্ঞ করতে চান। তবু বশিষ্ঠ না এলে রাজা রেগে গেলেন ও বিশ্বামিত্রকে যজ্ঞ করার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। রাজা নিজে বিশ্বামিত্রকে নিয়ে এলেন।
পথে বশিষ্ঠের পুত্র শক্ত্রির সঙ্গে দেখা হল।
রাজা বলেন – মুনিবর আমার পথ ছেড়ে যান।
শক্ত্রি বলেন – রাজা আমাকে আগে যেতে পথ দিন।
রাজা বলেন – এ পথ রাজার, সবাই তা যানে। তাই আপনি আগে পথ ছাড়ুন। আমি এখনই যজ্ঞ করতে যাব।
শক্ত্রি বলেন – বেদে আছে ব্রাহ্মণকে আগে পথ ছেড়ে দিতে হয়। আপনি একটু পথ ছাড়ুন, আমি চলে যাই।


শক্ত্রি

এইভাবে দু’জনের কথা কাটাকাটি হতে লাগল, কেউই পথ ছাড়তে রাজি হলেন না। রাজা রেগে গিয়ে হাতে যে দন্ড ছিল তা দিয়ে মুনিকে প্রহার করলেন। আঘাতে শক্ত্রির শরীর দিয়ে রক্ত ঝরতে লাগল।


রাজা রেগে গিয়ে হাতে যে দন্ড ছিল তা দিয়ে মুনিকে প্রহার করলেন

শক্ত্রি মুনি রেগে গেলেন। ক্রুদ্ধ চোখে রাজাকে বললেন – উচ্চবংশে জন্মে এমন নীতি বিরুদ্ধ কাজ করলি। দুর্বুদ্ধিতে তুই ব্রাহ্মণকে হিংসা করলি! এই পাপে আমার অভিশাপে তুই নিশাচর হবি। নরমাংস ভোজী রাক্ষসে পরিণত হবি।

শাপ শুনে সৌদাসপুত্র কল্মাষপাদ ভয় পেলেন। তিনি শক্ত্রিমুনিকে প্রসন্ন করার জন্য চেষ্টা করতে লাগলেন। কল্মাষপাদকে যজমানরূপে পাওয়ার জন্য বিশ্বামিত্রেরও চেষ্টা ছিল।
রাজা যখন কাকুতি মিনতি করছেন তখন বিশ্বামিত্রের আদেশে কিংকর নামে এক রাক্ষস রাজার শরীরে প্রবেশ করল। সঙ্গে সঙ্গে রাজা হতজ্ঞান হলেন। বিশ্বামিত্র মুনিও সঙ্গে সঙ্গে অন্তর্দ্ধান হলেন। সামনে শক্ত্রিমুনিকে পেয়ে রাজা তাকে বাঘের মত চেপে ধরল। রাজা রেগে বলে – দুষ্ট তুমি আমাকে শাপ দিলে, এবার ফল ভোগ কর।
বলেই শক্ত্রিকে বধ করে তাঁর ঘাড়ের রক্ত খেল। শক্ত্রিকে ভক্ষণ করে তাঁর ভয়ঙ্কর মূর্তি হল। উন্মাদের মত বনের ভিতর ঘুরতে লাগল। বিশ্বামিত্রমুনি এ অবস্থায় দেখে কৌশলে তাকে বশিষ্ঠের আশ্রমে নিয়ে গেলেন ও মুনির শতপুত্রকে দেখিয়ে দিলেন। রাক্ষস এক এক করে শতপুত্র ভক্ষণ করল।


রাক্ষস রাজা
বশিষ্ঠ আশ্রমে ফিরে পুত্রদের না দেখতে পেয়ে অবাক হলেন। ধ্যানের মাধ্যমে তিনি জানতে পারলেন বিশ্বামিত্রের প্ররোচনায় রাক্ষস তাঁর শতপুত্রসহ শক্ত্রিকে ভক্ষণ করেছে। অতি ধৈর্য্যবন্ত হলেও তিনি শতপুত্রের শোক সহ্য করতে পারলেন না। পুত্রশোকে তিনি আত্মহত্যার চেষ্টা করলেন। শোকাতুর মুনি সমুদ্রে ঝঁপ দিলেন। সমুদ্র তা দেখে সস্নেহে তাকে কূলে রেখে গেল। সমুদ্রে মরণ হল না দেখে মুনি উচ্চ পর্বতে উঠলেন। সেখান থেকে ঝাঁপ দিলেন। বিশ সহস্র ক্রোশ উঁচু থেকে পরেও মুনি তুলোর রাশির উপর পরলেন। তিনি শোকে গড়াগড়ি দিতে লাগলেন। এবার শোকতপ্ত মুনি আগুনের মাঝে প্রবেশ করলেন। অগ্নিও নিজেকে প্রসারিত করে আকাশ স্পর্শ করে শীতল হয়ে গেল। মুনিকে অগ্নির তাপ স্পর্শ করল না। এরপর বশিষ্ঠ ঘন অরণ্যে প্রবেশ করলে হিংস্র বন্য পশু- বাঘ, হাতী, ভাল্লুক, শুকর সকলে শোকাতুর মুনিকে দেখে পালালো। এভাবে অনেক চেষ্টা করেও বশিষ্ঠ মৃত্যু বরণ করতে পারলেন না। শোকে মুনি নানা দেশ ভ্রমণ করতে লাগলেন। অনেকদিন পর শেষে নিজের আশ্রমে ফিরলেন। ঘরে প্রবেশ করে শতপুত্রকে দেখতে না পেয়ে আবার পুত্রশোকে তাঁর শরীর অবশ হল। তিনি পূর্বকাল স্বপ্নের মত দেখতে লাগলেন, চারদিকে পুত্রেরা উচ্চ কন্ঠে বেদপাঠ করছে। এসব চিন্তা করতে করতে বশিষ্ঠ কষ্ট পেতে লাগলেন। গৃহে প্রবেশের মন চাইল না। পুনরায় তিনি দেশান্তরি হলেন। আবার আত্মহত্যার নানা চেষ্টা তিনি করতে লাগলেন। দেখলেন একটি গভীর নদীতে লক্ষ লক্ষ ভয়ঙ্কর কুমীর ভাসছে, তাতে ঝাঁপ দিতে গেলেন মুনি। সে সময় পিছন থেকে বেদপাঠের ধ্বনি শুনতে পেলেন। বিস্মিত হয়ে মুনি পিছন ফিরে দেখলেন শক্ত্রির স্ত্রী বিধবা অদৃশ্যন্তী দাঁড়িয়ে আছে।


শক্ত্রির স্ত্রী বিধবা অদৃশ্যন্তী

যোড়হাতে শক্ত্রির বিধবা স্ত্রী বলেন – প্রভূ, আমি আপনার সাথে এখানে এসেছি।
মুনি প্রশ্ন করেন – তোমার সঙ্গে আর কে আছে! শক্ত্রির মত কণ্ঠস্বরে কে যেন বেদপাঠ করছিল মনে হল!
অদৃশ্যন্তী বিনয়ের সঙ্গে জানান – আমার গর্ভে শক্ত্রির পুত্র বড় হচ্ছে। বার বছর ধরে সে বেদ অধ্যয়ন করেছে, সেই বেদপাঠ করছিল।
তাঁর বংশের সন্তান জীবিত আছে জেনে বশিষ্ঠ আনন্দিত হয়ে পুত্রবধূকে নিয়ে আশ্রমে চললেন। পথে রাক্ষসরূপী কল্মাসপাদের সাথে দেখা হল।
রাক্ষস বশিষ্ঠকে দেখে ভয়ঙ্কর মূর্তি ধারণ করে তাকে খেতে গেল। তাঁর বিকটরূপ দেখে অদৃশ্যন্তী থরথর করে কাঁপতে লাগলেন। বশিষ্ঠ তাঁর ভীত পুত্রবধূকে বললেন – ভয় নেই, ইনি কল্মাষপাদ রাজা।


এই বলে তিনি হুঙ্কার করে কল্মাষপাদকে থামিয়ে তাঁর গায়ে মন্ত্রপূত জল ছিটিয়ে তাকে শাপমুক্ত করলেন। চেতনা পেয়ে রাজা পূর্বের কথা সব মনে পরল। কৃতাঞ্জলিপুটে তিনি বশিষ্ঠের স্তব করে বলেন – অধম, পাপিষ্ঠ আমি, আমার পাপের অন্ত নেই। আপনি দয়াবন্ত, দয়া করুন, মুনিরাজ!
মুনি বলেন- শীঘ্র অযোধ্যা নগরে ফিরে গিয়ে রাজ্য শাসন কর। কিন্তু আর কখনও ব্রাহ্মণের অপমান করো না।
রাজা কল্মাষপাদ বলেন – আমি আপনার আজ্ঞাধীন হয়ে দ্বিজ-ব্রাহ্মণদের পূজা করব। সূর্যবংশে আমার জন্ম সৌদাস রাজার পুত্র আমি। এমন কিছু করুন যাতে আমায় কেউ নিন্দা না করে।
আশীর্বাদ পেয়ে রাজা অযোধ্যায় ফিরলেন। পুত্রবধূকে নিয়ে বশিষ্ঠ নিজের ঘরে এলেন। কিছুদিন পর শক্ত্রির বিধবা স্ত্রী অদৃশ্যন্তী একটি পুত্র জন্ম দিল। ইনি হলেন মুনি পরাশর। পৌত্র দেখে বশিষ্ঠের শোক নিবৃত্ত হল। তিনি অতি যত্নে বালককে শিক্ষাদান করতে লাগলেন। শিশুকাল থেকেই পরাশর মহা মুনি। তিনি বশিষ্ঠকেই পিতা বলে জানতেন। একদিন পরাশর মায়ের সামনেই বশিষ্ঠকে পিতা বলে সম্বোধন করলে অদৃশ্যন্তী সাশ্রুনয়নে বলেন – পিতৃহীন পুত্র আমার বড় অভাগা। পিতামহকে পিতা বলে আর ডেকো না। যখন তুমি আমার গর্ভে ছিলে, তখনই তোমার পিতাকে বনে রাক্ষস খেয়ে নেয়।
মায়ের মুখে একথা শুনে, বিশেষ করে মায়ের শোক ক্রন্দন দেখে পরাশর মুনি রাগে কাঁপতে লাগলেন। ক্রুদ্ধ পরাশর চিন্তা করতে লাগলেন- বিধাতা এত বড় নির্দয়! রাক্ষসের হাতে আমার পিতাকে মারলেন! আজ আমি বিধাতার সব সৃষ্টি বিনাশ করব। ত্রিলোকে তাঁর সৃষ্টির একজনকেও রাখব না।


পরাশর মুনি
পরাশর যখন এই সংকল্প করছেন বশিষ্ঠ মুনি সব কথা জানতে পারলেন। পৌত্রকে নিরস্ত করার জন্য মধুর বচনে প্রবোধ দিয়ে বলেন – অকারণে শিশু তুমি কার উপর রাগ কর! ক্রোধ ব্রাহ্মণের উচিত কর্ম নয়। বেদে বলে ক্ষমা ও শান্তি ব্রাহ্মণের ধর্ম। কর্ম অনুসারে শক্ত্রির এমন মৃত্যু হল। তাঁর জন্য অনুশোচনা করো না। কার এত শক্তি তাকে মারতে পারে। সবাই সংসারে কর্ম অনুরূপ ফল পায়। ক্রোধ শান্ত কর, বস! তত্ত্বে মন দাও। অকারণে সৃষ্টির বিনাশ কেন করবে। এই বলে এক উপাখ্যান শোনান।

মহাভারতের কথা অমৃত লহরী। শুনলে অধর্ম ক্ষয় হয়, পরলোকের পায় তরি।
....................................
উৎসর্গ: সকল ব্লগার বন্ধুকে
......................................
আগের পর্ব:

কথাচ্ছলে মহাভারত - ৬৯

Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জানুয়ারি, ২০১৫ সকাল ১১:৪৫
৯টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×