somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১০৮

১৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১২:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

[পূর্বকথা - সুভদ্রা হরণের কথা... সুভদ্রার ইচ্ছে রাখতে সত্যভামা কৌশলে তার গন্ধর্ব বিবাহ দিলেন অর্জুনের সাথে ... কৃষ্ণ সভায় অর্জুনকে সুভদ্রার জন্য উপযুক্ত পাত্র নির্বাচন করলে বলরাম ক্রুদ্ধ হল, তিনি দুর্যোধনকে পাত্র ঠিক করলেন ... দুর্যোধনের কন্যার সাথে কৃষ্ণের পুত্রের বিবাহ প্রসঙ্গ উঠল... ]

দুর্যোধনের কন্যা লক্ষণার স্বয়ম্বরঃ



বৈশম্পায়ন মুনি বলেন –অবধান করুন রাজা দুর্যোধনের কন্যার স্বয়ম্বরের কাহিনী।
ভানুমতীর গর্ভে এই একটি কন্যার জন্ম। রূপে, গুণে অনুপমা, সর্বগুণযুক্তা। ভুবন মোহিনী সুলক্ষণা বিভূষণা তাই তার নাম রাখা হল লক্ষণা।
কন্যাকে যুবতী হতে দেখে রাজা স্বয়ম্বরের আয়োজন করলেন। পৃথিবীর সব রাজাদের আমন্ত্রণ করা হল। রূপবন্ত, গুণবন্ত, কুলে শীলে খ্যাত বহু রাজা রথ, গজ, অশ্বে উপস্থিত হল।
বিবিধ বাদ্যের শব্দে গগন ছাইল, ধ্বজা, ছত্র, পতাকায় মেদিনী(পৃথিবী) ঢাকল। ধূলায় সূর্য ঢাকে গেল। সবাইকে দুর্যোধন সসম্মানে সিংহাসনে বসাল।

নারদের মুখে কৃষ্ণ-জাম্ববতীর পুত্র শাম্ব বীর কন্যার রূপ বর্ণনা শুনে অস্থির হল। একাই সে রথে চড়ে স্বয়ম্বর স্থানে যাত্রা করল। পথে যেতে যেতে কেবল চিন্তা করে কিভাবে কন্যাকে পাবে। সবার অলক্ষে একা রথের উপর বসে রইল।
এমন সময় লক্ষণাকে বাইরে আনা হল। অনুপম মুখ তার জিনি শরদিন্দু(শরৎকালের স্নিগ্ধ চাঁদকেও জয় করে)। ঝলমল কুন্ডল তার, মিহির(সূর্য) যেন অধর(ঠোঁট)কে রাঙ্গিয়ে তুলেছে। ভ্রূভঙ্গে অনঙ্গ(কামদেব) জয় সম্ভব। পাখির মত চঞ্চল চক্ষু(খঞ্জন) অঞ্জনে(কাজলে) রঞ্জিত। শুকচঞ্চুর(টিয়াপাখির ঠোঁট) মত নাক, শ্রুতি(কান) গৃধিনীকেও(শকুনী) লজ্জা দেবে। বিপুল নিতম্ব গতি মরালের(রাজহাঁস) মত। চরণে রসাল কিঙ্কিণী ও নূপুর বাজে। ধূমহীন অগ্নি কিংবা বিদ্যুতে যেন এর সৃষ্টি। শিশু সূর্যের যেন উদয় হল।
দৃষ্টিমাত্র রাজারা চেতনা হারাল। কন্যার রূপ দেখে জাম্ববতীর পুত্রের মদনপীড়া হল। দ্রুত গতিতে এসে সে কন্যাকে ধরে রথে তুলে দ্বারকার পথে রথ চালিয়ে দিল।
‘ধর, ধর’ বলে সেনারা তাড়া করল। নানা অস্ত্র নিয়ে কৌরবরা ধেয়ে গেল।

কৃষ্ণের পুত্র শাম্ব কৃষ্ণের সমান বীর। ধনুকে টঙ্কার দিয়ে বাণ ছাড়ল। চক্ষের নিমেষে অনেক সৈন্য কাটা পরল। নির্ভয়ে শাম্ববীর যুদ্ধ শুরু করল। হস্তী, অশ্ব, রথ, রথী সব কাটা পরতে লাগল। ভয়ে কেউ আর তার সামনে গেল না।

ক্রোধে আগুন হয়ে সূর্যের নন্দন কর্ণ বলে –বালক হয়ে তোমার এত অহংকার! আমার সামনে কন্যা হরণ করে নিয়ে যাও! এখনি এর উচিত শিক্ষা দেব।

এই বলে বীর কর্ণ ইন্দ্রজাল অস্ত্র প্রয়োগ করে শাম্বকে বেঁধে ফেলল। ‘চোর ধর, চোর ধর’ বলে রব উঠল। দুর্যোধন ‘কাট, কাট’ বলে আজ্ঞা দিল।
দুর্যোধন বলে –আমার সামনে আমায় লঙ্ঘন করার শাস্তি একে দেব। দক্ষিণের শ্মশানে নিয়ে গিয়ে একে কাট।

রাজার আজ্ঞা পেয়ে দুঃশাসন মারতে মারতে শাম্বকে নিয়ে চলল।

দুর্যোধন কর্ণকে জিজ্ঞেস করে –এই চোর কার পুত্র তুমি কি চিনতে পারলে!

কর্ণ বলে –মহারাজ, এ গর্ব আর কার! চোরের পুত্র ছাড়া আর কে এমন কাজ করবে।

শুনে দুর্যোধন রাগে কাঁপতে থাকে। দাঁত কড়মড় করতে করতে, হাত কচলে সে বলে –গোকুলে গোপের খেয়ে বাড়ল বলে ক্ষত্রিয়েরা কেউ কন্যা দেয় না, তাই চুরি করে বেরায়। সেই চোরের জাতের চুরিতে আর কি লাজ, ভয়! সবস্থানে চুরি করে মনে সাহস বেরে গেছে দেখছি! তাই এই যমের ঘরে চুরি করতে এসেছে। সভা মাঝে এমন ভাবে আমাকে অপদস্ত করা! আর সহ্য হয় না, এখনই একে কাট।

দুর্যোধন যখন এতসব বলছে, তখন ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির সেখানে এসে কে চোর তা দেখতে গিয়ে কৃষ্ণের পুত্রকে চিনতে পারলেন।

দুর্যোধন রেগে যুধিষ্ঠিরকে বলে –মহারাজ আপনি একে ঠিক চিনবেন। আপনি যাকে ভাই বলেন সেই গোকুলের চোর যে গোকুলের কামিনীদের(স্ত্রী) হৃদয় চুরি করত, আবার বিদর্ভে গিয়ে ভীষ্মকের কন্যাকে(রুক্মিণী) চুরি করল।
পুত্র কাম চুরি করল বজ্রনাভের কন্যাকে(প্রভাবতী)। [শিবের দ্বারা ভস্ম হয়ে কামদেব পুনরায় রুক্মিণির গর্ভে প্রদ্যুম্ন রুপে জন্মান]
পৌত্র অনিরুদ্ধ চুরি করে বাণাসুরের কন্যাকে(উষা)। [বাণাসুরঃ প্রহ্লাদ-বিরোচন-বলি মহারাজ-তার পুত্র বাণ শোণিতপুরের রাজা]
এই তিন পুরুষ ধরণীতে তো চোর নামে বিখ্যাত!

কৃষ্ণ নিন্দা শুনে দুঃখিত, বিষণ্ণ ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির বলেন –ভাই, সবার সামনে কৃষ্ণ নিন্দা উচিত হচ্ছে না। যে চুরি করতে পারে, সেই করে। কৃষ্ণের শক্তির সামনে কে কি করতে পারে!

দুর্যোধন বলে –ধর্মরাজ ভাল বললেন! যে আমার সম্মানহানি করল, আমার কন্যাকে চুরি করল, তার নিন্দা করতে পারব না!

যুধিষ্ঠির বলেন –ঠিক আছে কে কন্যা হরণ করল দেখি!

দুর্যোধন বলে –তাতে আর কোন কাজ নেই। যে কেউ পার এখনই তার মাথা কাট।

যুধিষ্ঠির বলেন –সত্যি যদি ইনি কৃষ্ণের পুত্র হন তবে তাকে বধ করা কি উচিত হবে! ভাই কৃষ্ণ বৈরী(শত্রু) হলে কারো রক্ষা নেই। আমাদের কুরুকুলে বাতি দেওয়ার আর কেউ থাকবে না। কৃষ্ণের ক্রোধ থেকে ইন্দ্র, যম, বরুণ(জলের দেবতা), কুবের, পঞ্চানন(শিব) কেউই আমাদের রক্ষা করতে পারবেন না।

দুর্যোধন বলে –তুমি যখন এত ভয় পেয়েছ তখন এখনই হস্তিনাপুর ত্যাগ করে ইন্দ্রপ্রস্থে প্রাণ নিয়ে পালাও আর সেখানে কৃষ্ণের শরণ নাও। আজ আমি এই দুষ্টকে মারবই। আমি কাউকে ভয় পাই না।

দুর্যোধনের কথা শুনে চিন্তিত যুধিষ্ঠির ভাই বৃকোদর ভীমকে দ্রুত শাম্ব রক্ষায় পাঠালেন। শ্মশানে দুঃশাসন শাম্বের চুল টেনে ধরে খড়্গ দিয়ে মুন্ড কাটতে উদ্যত হল। বায়ুবেগে ভীম সেখানে উপস্থিত হয়ে দুঃশাসনের হাত থেকে খড়্গ কেড়ে নিলেন।

ভীম দুঃশাসনকে বলেন –তোমার এ কেমন বিচার, কৃষ্ণের পুত্রকে হত্যা করছ! ধর্মরাজ আমায় একে উদ্ধার করতে পাঠিয়েছেন।

এই বলে ভীম শাম্বের বন্ধন ছিন্ন করলেন। শাম্বকে কোলে তুলে যুধিষ্ঠিরের কাছে গেলেন।
যুধিষ্ঠির জাম্বুবতীনন্দন শাম্বকে দেখে কাছে টেনে চুম্বন করলেন।

দেখে ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে দুর্যোধন বলে –দেখুন, দেখুন! ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপাচার্য এর বিহিত করুন। আপনারা সব সময় বলেন পাণ্ডবরা ভাল। এখন দেখুন কুলের কলঙ্ক দিল যে দুরাচার তাকে আদর করা হচ্ছে।

যুধিষ্ঠির বলেন –দেখ ভাই দুর্যোধন সভায় এর সমান রূপে-গুণে কে আছে! ইনি যদু মহাকুলে জন্মেছেন। তার উপর কৃষ্ণের কুমার। আমার কন্যা হলে আমি তাকে কৃষ্ণের পুত্রের হাতে সমর্পণ করতাম। কন্যাকে শাম্বের হাতেই দান কর। আর দেরি করলে কন্যার কলঙ্ক হবে। পরে কেউ আর তাকে বিবাহ করতে চাইবে না। সবাই দেখেছে শাম্ব তাকে কোলে তুলে হরণ করেছে।

দুর্যোধন বলে –তাতে আমার কিছু আসে যায় না। কন্যা আমার ঘরেই থাকবে। কিন্তু এর হাতে আমি কন্যা দেব না। একে আজ মেরেই ফেলব। তুমি একে ছাড়।

ভীম গর্জন করে বলেন –দুর্যোধন তোমার মতিচ্ছন্ন হয়েছে। তোমার এত কিসের গর্ব! আমার সামনে তুমি কৃষ্ণের পুত্রের হত্যা করবে! দেখি কত সাহস! শাম্বকে কেউ স্পর্শ করলে আমার গদাঘাতে সে যমের বাড়ি যাবে।
এই বলে ভীমসেন মাথার উপর গদা ঘোরাতে থাকেন।

ভীমের কথা শুনে দুর্যোধন আরো রেগে বলে –কেড়ে নাও শাম্বকে।

আজ্ঞা পেয়ে দুর্যোধনের ভাইরা ঝাঁপিয়ে পরে। কিন্তু বাঘের সামনে ছাগল পড়লে যেমন হয়, তেমনি ভীমের বিক্রম দেখে সকলে পালাতে লাগল।

তখন ভীষ্ম ও দ্রোণাচার্য তাদের মাঝে এসে বলেন –পুত্ররা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করছ কেন! এখন শাম্বকে বন্দি করে রাখা হোক। পরে বিচার বিবেচনা করে একে শাস্তি দেওয়া যাবে।
দুর্যোধনকে তারা বলেন –এ কৃষ্ণের পুত্র। যদুরা জানতে পারলে দলে দলে চলে আসবে। যদি একে মেরে ফেল তবে গোবিন্দের ক্রোধ থেকে কেউ রক্ষা পাব না। তিনি এলে তখন তাকে যুদ্ধ করে পরাজিত করা যাবে। এ যখন আমাদের ঘরে এসে গেছে এখন একে বন্দি করে রাখি।

শুনে যুধিষ্ঠির ‘ভাল, ভাল’ বলে সমর্থন করলেন।

দুর্যোধন বলে –তবে এর পায়ে শিকল পরান হোক।

শাম্বের পায়ে শিকল দিয়ে গুরু দ্রোণ ভীষ্মের গৃহে নিয়ে চললেন। অন্যেরাও যে যার গৃহে গেল।

মহাভারতের কথা অমৃত সমান। কাশীরাম দাস কহেন, শুনেন পুণ্যবান।
......................................
উৎসর্গ: সকল ব্লগার বন্ধুকে
......................................
আগের পর্ব:

কথাচ্ছলে মহাভারত - ১০৭ Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১২:২৮
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×