somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফিরে দেখা পথরেখা।

২২ শে নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মনসুরের মা ।
রাজা সরকার।

১৯৬৪ সাল পর্যন্ত আমি মনসুরের মাকে দেখে গেছি।
তার বছর দেড়েক আগে আমি গ্রাম থেকে এসে এই নেত্রকোণা শহরের একটি ইশকুলে ভর্তি হয়েছি । আমার থাকার জায়গা ঠিক হয়েছে শহরের নিউটাউনে এই পিসিদের বাড়িতে। ওই বাড়িতে থাকতে থাকতে দেখেছি মনসুরের মায়ের বাড়িতে কোনও কিছু ভালো খাবারের জিনিস আসলে সেটার কিছু অংশ আমাদের এই বাড়িতেও আসত। সেই খাবার বাটিতে করে তিনি নিজেই নিয়ে আসতেন অথবা তাঁর ছেলে মনসুরকে দিয়ে পাঠাতেন। আর তারপরে সেই বাটি ফেরত দিয়ে আসার দায়িত্বটি ছিল আমার। আর সেটাতেও আমার বড় পিসি কিছু না কিছু দিয়ে পাঠাতেন। আমাদের বাড়ির থেকে মনসুরদের বাড়ি ছোট পায়ে হেঁটে গেলে মিনিট তিন চারেকের বেশি লাগত না । এটা আমার বছর দশেক বয়সের স্মৃতি।
মনসুরের মা আমার বড়পিসির প্রাণের বন্ধু। তাঁরা পরস্পর সই পাতিয়ে ছিলেন। সেই সূত্রে আমিও তাঁকে পিসি ডাকতাম। তখনও আমি জানতাম না পিসিকে মনসুরদের বাড়িতে ফুফু বলা হয়। ফলে আমি যখনই তাঁকে পিসি বলে ডাকতাম তিনি খুব অবাক হতেন। হয়তো খুশিও হতেন। কখনো কখনো তিনি আমার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিতেন।
কিন্তু এই দেয়ানেয়ার মধ্যে আমি কোনোদিন দেখিনি মনসুরের মা তাঁদের রান্না করা কোনও খাবার; যেমন মাছ বা মাংস আমাদের এই বাড়িতে পাঠাতে। বা আমাদের এই বাড়ি থেকেও কোনও রান্না করা খাবার মনসুরদের বাড়িতে পাঠাতে। পাঠানোর মধ্যে ফল মিষ্টি নানা ধরণের আচার ইত্যাদিতে সীমাবদ্ধ ছিল। আমারও ওই বয়সে এমন ধারনা ছিল যে রান্না করা খাবার বোধহয় কেউ কারোর বাড়িতে পাঠায় না । কিন্তু ধারনাটা যে ভুল পরে ক্রমে ক্রমে জানতে পারি। খাবার আদান প্রদানের সীমাবদ্ধতাটা ছিল হিন্দু মুসলমানের মধ্যে। এও জানতে পারি যে হিন্দু মুসলমানের মধ্যেকার নানাবিধ দূরত্বের মধ্যে রান্নাঘরের দূরত্বটাই ছিল সব চাইতে বেশি। বিশেষ করে যেখানে খাদ্যের মাধ্যমেই জাত-গেল জাত-গেল ব্যাপারটা হয় বেশি। যা হোক, ওই বয়সে আমি এতসব না জানলেও মনসুরের মা হিন্দু নয়, আর আমরাও মুসলমান নই এটা জানতাম। কিন্তু পরবর্তীকালে ভেবেছি যে মনসুরের মা’ও কি জানতেন এত সব বিভেদের কথা ! তিনি কি জানতেন দেশভাগ, দ্বিজাতিতত্ব, মুসলমান ম্লেচ্ছ, হিন্দু কাফের, মালাউন ! তিনি কি জানতেন কাফের হিন্দুর সঙ্গে মেলা মেশা একরকমের গুনাহ। আমার কখনো তাঁর মুখ দেখে তখন এমন মনে হয়নি। এতই সই অন্ত প্রাণ ছিল তাঁর কী করেই বা ভাবতাম। এই মহিলাই তারপর দেখলেন তাঁর প্রাণের সই একদিন শ্বশুর বাড়ি চলে গেল তাঁর বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে। তার কিছুদিন পর খবর পেলেন তাঁর প্রাণের সই ইন্ডিয়ায় চলে গেছে। শুধু তো এরাই না ক্রমে ক্রমে দেখলেন নিউটাউন থেকে অনেক চেনা মানুষ, অনেকে আদরের, অনেক শ্রদ্ধেয় মানুষ দেশ ছাড়া হয়ে গেল। তিনি অবাক হয়ে শুধু দেখলেন। বোধ হয় সইয়ের কথা ভেবে একবার নিজে নিজেই বললেন---কেন কেন দেশটা কি না ছাড়লেই হইত না বইন?

আমার এই নিউটাউনের বাড়িতে থাকার সময় আমার বড় পিসির বিয়ে হয়ে যায়। আমি খুব অবাক হয়েছিলাম যে বিয়ের আগে আগে এই বাড়িতে মনসুরের মা এলেও বিয়ের দিন বা রাতে মনসুরের মা এই বাড়িতে পা দেননি। রাতে বিয়ে হয়ে পরদিন শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার সময় একটা খুব কান্নাকাটির ব্যাপার হয়। আমি খেয়াল করেছিলাম সেই ভিড়ের মধ্যে এক কোনে দাঁড়িয়ে মনসুরের মা’ও খুব কান্নাকাটি করছিলেন। একবার বোধহয় পিসির চোখে পড়াতে পিসি তাঁর কাছে এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে দুজনে খুব কাঁদলেন।

মনসুরের মা এই পর্যন্তই আমার স্মৃতিতে ছিলেন একজন স্নেহময়ী মহিলা হিসেবে। তারপর ১৯৬৪ থেকে ১৯৮৭ এই দীর্ঘ তেইশ বছরের ব্যবধান। আমি পূর্বপাকিস্তান ছেড়ে এসে পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা হয়েছি। ইত্যবসরে আমার বয়স বেড়েছে। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে আমারও পরিবর্তন হয়েছে। শিক্ষাজীবন শেষ হয়েছে। চাকরি করছি। সংসার জীবনে থিতু হয়েছি। কিন্তু মন থেকে ছেড়ে আসা ভূখণ্ডটির প্রায় কিছুই ভুলতে পারিনি। ঠিক এই সময় অর্থাৎ তেইশ বছর পর আমার সাধ হলো ফেলে আসা ভূখণ্ডটিকে ফিরে দেখার। একদিন দেখতেও গেলাম। তবে খুব সহজে সে যাওয়া হয়নি। পাসপোর্ট ভিসা সহ আইনের কাঠ খড় পুড়িয়ে নিজেরই জন্মভূমি দেখতে আমার যাওয়া হল। দুচোখ ভরে ক্ষুধার্তের মত দেখতে লাগলাম ফেলে আসা জায়গা মানুষজন সব। দেখে দেখে একসময় আমি নেত্রকোণায়ও গেলাম। তখন সেই নিউটাউনের বাড়িতে শুধু আমার ছোট পিসি; রিক্তা আছে। যে প্রায় আমার কাছাকাছি বয়সের। বাকিরা পশ্চিমবঙ্গের কোথাও কোথাও এসে গেছেন যা আমার আর জানা নেই। জানা থাকার কথাও নয়। এরজন্য কেউ বোধ হয় দায়ী নয়। সবাই যেন চেনা কক্ষপথ থেকে ছিটকে গিয়ে মহাশূনের কোনো অজানা কক্ষপথে হারিয়ে গেছে। তবু যার যার কথা মনে ছিল সবার কথাই ছোট পিসিকে বললাম। দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে তাদের কেউ হয়তো আর নেই, কেউ প্রয়াত হয়েছেন, কেউ বা বৃদ্ধ হয়েছেন। আমারও বয়স হয়েছে। কিন্তু চোখটা রয়ে গেছে সেই ১৯৬৪ সনের। ছোট পিসিকে একসময় জিজ্ঞেস করলাম, মনসুরের মা কেমন আছে গো? পিসি বলল---বাব্বা! মনসুরের মায়ের কথাও তোর মনে আছে!
---থাকবেনা কেন---কতবার তাঁর বাড়িতে তখন বাটি নিয়ে গেছি আসছি। খুব ভালো মহিলা ছিলেন।
---ঠিক আছে তোকে নিয়ে যাব। মনসুরের মা ভালই আছে।

বিকেল বেলা ছোট পিসির বাড়ির থেকে বিদায় নিয়ে যখন বেরিয়ে আসি তখন পিসি বলল---চল আমিও যাই। তোকে একটু এগিয়েও দেয়া হবে আর মনসুরের মায়ের সাথে তোর দেখাও করানো যাবে।
আমরা বেরিয়ে আস্তে আস্তে মনসুরের মায়ের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম। বাড়ির সামনেটার অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। আগের মত আর খোলা মেলা নেই। পিসি বাড়ির গেট খুলে ডাকলো---কইগো হামিদাদি বাড়ি আছ? আমি রিক্তা। একটু সময় নিয়ে দরজাটা খুললেন যিনি তিনিই মনসুরের মা। আমি একবার দেখেই চিনে ফেললাম। এবারই জানলাম ওনার নাম হামিদা। । পিসি আমাকে নিয়ে সরাসরি ওনার বসার ঘরে ঢুকে পড়ল। মনসুরের মায়ের গলায় অভিমান। রিক্তা পিসিকে বললেন---খুব তো দিদি দিদি করো---যাওয়া আসার পথে একবার খোঁজও নেও না। পিসি বলল---ওইসব কথা পরে হবে, দেখতো এই ছেলেটাকে চিনতে পার কি না । এরমধ্যে দুএকবার মনসুরের মা আমাকে আড়চোখে দেখে নিয়েছেন। পিসির এই প্রশ্নের পর হাসি মুখে আবার একটু ভালো করে দেখলেন। বললেন---কই না তো, চিনতে পারতাছি না । উনি কেডা গো। আমি এই উত্তর শুনে হাসছি আর ভাবছি---সত্যিই তো কীভাবেই বা চিনবেন---তেইশ বছর পর ! কত সময় পার হয়ে গেছে! আগে যখন দেখেছেন তখন আমি হাফ প্যান্ট পরি। তাঁর বাড়ির সামনে দিয়ে রোজ ইশকুলে যাতায়াত করি। ক্লাস সিক্সের ছাত্র।
পিসি মিটি মিটি হাসছিল মনসুরের মায়ের কথা শুনে । এবার বলল মনে করে দেখতো বড়দির বিয়ের আগের সময় একটা ছেলে আমাদের বাসা থেকে পড়াশোনা করত---মাঝে মাঝে তোমার বাড়িতেও এটা সেটা দিতে আসত। এই কথা শুনে হঠাৎই যেন মনে পড়ে গেল মনসুরের মায়ের। বললেন—আচ্ছা আচ্ছা ছোট্ট একটা ছেলে, তোমরার কী রকম ভাতিজা হইত না?---হ হ মনে পড়ছে, তোমরার ভাতিজাই হইত। তোমরারে পিসি ডাকত। তা ইনি কী সেই ছেলে?
রিক্তা পিসি তখনও মিটি মিটি হেসেই যাচ্ছে। একসময় বলল---চিনতে কইলাম পারো নাই। আসলে সেই ছোটবেলার মুখটা আর নাই। আমিও প্রথমে ধন্দে পড়ে গিছলাম।
এইবার প্রায় পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে মনসুরের মা আমার দিকে তাকালেন। তাঁর বয়সের ছাপ পড়েছে মুখে। তবু চোখের মায়া তখনো অম্লান। জিজ্ঞেস করলেন---শুনছিলাম তুমিও নাকি ইণ্ডিয়ায় চলে গেছিলা, আহা কত বড় হইয়া গেছ, পরিচয় না করাইয়া দিলে কিবায় চিনবাম কও। কত বছরের কথা ! তা তুমি কি অহন একবারেই এই-পাড়ে চইলা আসছ বাপ? আমি হাসলাম। বললাম, না পিসি একবারে আসি নাই। এই সবাইরে একবার দেখে গেলাম। আপনার কথা আমার খুব মনে ছিল । তাই রিক্তা পিসিকে বলছিলাম।
---কী ভালো কথা---আমার কথা তোমার মনে আছিল শুইন্যা প্রাণডা জুড়াইয়া গেল। ওইখানে এখন কী কর? বিয়া শাদী অইছে তো তোমার?
---ওইখানে মানে শিলিগুড়িতে থাকি তো। চাকরি করি একটা।
এরমধ্যে রিক্তা পিসি বলে উঠলো আমরার ভাতিজা তো বিয়াও করছে। একটা ছোট্ট মাইয়াও আছে। এই কথা শুনে মনসুরের মা হেসে উঠলেন, ওমা হাছাই নাকি---তয় বউ মাইয়ারে আনলানা ক্যান বাপ?
---আনব। পরে যখন আসব নিয়ে আসব।
---আর পরে! একবার আসতেই এতডি বছর লাগল, এই যে তোমার বড় পিসি; সেই যে সে গেল তো গেলই, আর আইল কই? একটা চিঠি দিয়াও সে আমার খোঁজ খবর নি নেয়! আমি তো রিক্তার কাছে তার খবর পাওয়ার লাইগ্যা বইয়া থাহি। তোমার লগে দেখা অইলে একটু কইও বাবা। কইও যে আমি তারে একটুকও ভুলি নাই।
এই কথা শুনে বললাম, আমি তো জানতামই না যে বড় পিসিও ওই পাড়ে চলে গেছেন। এবারই এসে শুনলাম। রিক্তা পিসির কাছ থেকে ঠিকানা নিলাম। উনি তো কলকাতার দিকে থাকেন। শিলিগুড়ির থেকে অনেকটাই দূর। দেখি ফিরে গিয়ে একবার দেখা করার চেষ্টা করব। আপনার কথা তো অবশ্যই বলব।
আহা কি দিনকাল ছিল আমরার, তুমিও তো দেখছ ছোটবেলায়। আস্তে আস্তে কী অইয়া গেল দেশটার, এই নিউ টাউনের কত মানুষ চইলা গেল। কেন গেলগা তারা! ছোট বেলায় তেমন বুঝি নাই। অহন বয়স অইছে, একটু একটু বুঝি। খুবই দুঃখের কথা। বুঝে উঠতে পারিনা ক্যান হিন্দুদের তাড়াইল এইভাবে। হিন্দুরা কী খারাপ আছিল? তারা কীই বা করছিল। শুনছি দেশ জুইড়াই নাকি এরম অইছে। দলে দলে মানুষরে কাইট্যা মাইরা ঘরবাড়ি জ্বালাইয়া তাড়াইছে, কী দোষ আছিল কও তো?
এই বলতে বলতে মনসুরের মায়ের চোখ ছল ছল করে উঠলো। বলতে লাগলেন, মানুষের জীবন তো দুই দিনের, দেখতেই দেখতেই তো শেষ। মনে দুঃখ দিয়া ঘরের কাছের এই সব মানুষ গুলানরে খেদায়া তরার কী লাভ অইল! তরা কি ধনী অইছস, নাকি রাজা বাদশা অইছস? এই নিউটাউনের কত শিক্ষিত ভদ্র মানুষ মাথা নিচু কইরা, রাইতে রাইতে চইলা গেল । বাবা তুমি মনে কিছু নিও না । অনেক কথা কইয়া ফেললাম। এই সব দুঃখের কথা আর কারে কই! মনে কিছু কইর না ।
--- না না পিসি, মনে করার কিছু নাই। দুঃখ পাইয়েন না। কথাগুলো সবই তো ন্যায্য কথা। চেষ্টা করব আরেকবার তাড়াতাড়ি আসার।
---হ হ আরেকবার আইও। আরেকবার ক্যান, বার বার আসবা। সময় পাইলেই আসবা, এই দেশ মাটি তো তোমারও----। আচ্ছা বাবা তোমারে কিছু খাইতে দেই? তোমারে বসাইয়া রাইখ্যা খালি আমি কথাই কইতাছি। কী খাবা কও?
---পিসি খাওয়ার অবস্থা তো নেই। এইতো একটু আগে ভাত খাইয়া আফনের এইখানে আসলাম।
---না না তা অয় না বাবা, হালকা কিছু খাও।
এই বলে আর সময় না দিয়ে পিসি উঠে চলে গেলেন ঘরের ভেতরে।
পিসির কথাবার্তা শুনে আমি আর রিক্তা পিসি চুপচাপ বসে থাকলাম। এত হৃদয়-জাত কথা তিনি যে ভাবে বললেন তাতে আমরাও প্রায় সংক্রামিত। কিছুক্ষণ পর হামিদা পিসি এক প্লেটে করে কিছু ফল কেটে নিয়ে এলেন। এনে বললেন---খাও বাবা। এখন তো একাই থাকি বাড়িতে। তোমার ফুফারও ইন্তেকাল হয়ে গেছে প্রায় দশ বছর। দুই মেয়ের বিয়া দিছি। একমাত্র ছেলে চাকরি করে রাজশাহীতে। মাসে এক দুইবার আসে। একটা কাজের মেয়ে নিয়ে এখন থাকি। আর পুরানো দিনের কথাই ভাবি। তুমি যে আমারে মনে রাইখ্যা আইছ আমার লগে দেখা করতে এতে যে আমি কী খুশি অইছি তা বইলা বোঝাতে পারব না। দোয়া করি বাবা বউ বাচ্চা নিয়া তুমি সুখে জীবন কাটাও।
যাওয়ার আগে আমি উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে প্রণাম করতে গেলাম । তিনি বললেন প্রণাম করবা? করো। আমাকে তুমি তোমার এই পিসিদের মতই যে একজন পিসি মনে করছ সেটা আমি বুঝতে পারছি। আমার অন্তর থেকে তোমার জন্য আমার আজীবন দোয়া থাকবে বাবা। আল্লাহ তায়ালার কাছে তোমার জন্য দোয়া করবো।
এই পর্যন্ত কথাগুলো কোনোমতে বলে তিনি মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদতে লাগলেন। রিক্তা পিসি উঠে গিয়ে তার হামিদাদিকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিতে লাগল।

মনসুরের মা তথা হামিদা পিসি পৃথিবীর জটিলতার পাঠ কখনো নেননি। তিনি সবসময়ই ছোট ছোট পৃথিবী নিয়ে থেকেছেন। তাঁর সেই সব ছোট ছোট পৃথিবীগুলোতে মানুষ ফুলের মত জন্ম নেয় আর চলতে চলতে একদিন শুকিয়ে ঝরে যায় । মাঝের পথটুকু শুধু আনন্দের উপকরণে সাজানো। শৈশব, কৈশোর যৌবন পর্যন্ত তাঁর এভাবেই কেটেছিল। তাঁর বিশুদ্ধ আত্নায় আনন্দের অভাব ছিল না। সেখানে মানুষে মানুষে সদ্ভাবের কথাই তিনি শুনেছেন। এইসব কথা শুনেই তিনি মানুষে মানুষে সম্পর্কের উপর খুব গুরুত্ব দিতেন। আর এই দিতে দিতেই ১৯৬৪ সনে হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে সঙ্গে তার জীবনও পৃথিবীর জটিলতার মুখটা দেখে ফেলল। যখন সব সম্পর্ক মুছে ফেলে শুধু ধর্মের সম্পর্ককেই একমাত্র সম্পর্ক বলে এই দেশ রাষ্ট্র স্বীকৃতি দিতে লাগলো। তিনি ইতিহাস পড়েননি। দূরাঞ্চলের খবরও রাখেননি কোনোদিন। দেশ কীভাবে স্বাধীন হলো তার সুলুক সন্ধানও তার কাছে নাই। তিনি শুধু দেখলেন তাঁর প্রাণের সই সহ অনেক মানুষই কেমন বিনা ভূমিকায় চিরকালের মত নীরবে দেশ ছেড়ে চলে গেলেন। উনি যেন মুখে অদৃশ্য চাবুকের আঘাত পেলেন। ক্রমে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়তে লাগলেন। অনেক অনেক প্রশ্ন যেন তখন তাঁর চারপাশে ভিড় করে এলো। তিনি উত্তর জানেন না। উত্তরের জন্য হাতড়াতে লাগলেন। আসলে এই সাম্প্রদায়িক অসুখের কারণ হয়তো তিনি শেষদিন পর্যন্ত খুঁজে যাবেন আর মনে মনে প্রাণের সইয়ের উদ্দেশ্যে অভিমানহত কথাগুলো বলে যাবেন।
আমি বাড়ির গেট খুলে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলাম। ফিরে আর তাঁদের দিকে আমার ভিজে ওঠা চোখ নিয়ে তাকালাম না। আমিও কি আর তেমন শক্ত মানুষ যে এত দুঃখ বিচ্ছেদের ভার সইতে পারব?
তবু মনে মনে বললাম বেঁচে থাক মনসুরের মা, কষ্ট পেওনা। আমরা অভিশপ্ত । আমাদের শাপমোচন কবে হবে জানি না।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৪০
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পাকিস্তান কেন বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৮ ই জুলাই, ২০২৫ বিকাল ৩:১৬


(চুলকানী থাকলে এড়িয়ে চলুন / ট্যাগ লাগানোর আগে ভাবুন/ভাবতে শিখুন।)


নেকেই "পাকিস্তান কেন বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে" এই শিরোনাম দেখেই লুঙ্গী খুলে ধুতি পড়া শুরু করবেন। ওয়েট ওয়েট একটু অপেক্ষা করুন... ...বাকিটুকু পড়ুন

কানাডায় বাংলাদেশী এসাইলাম সিকারদের মিথ্যা মামলা - বাংলাদেশ সরকারকে ব্যাবস্থা নিতে হবে

লিখেছেন সত্যপথিক শাইয়্যান, ০৮ ই জুলাই, ২০২৫ বিকাল ৪:০৪

আমার নিজের একটি অভিজ্ঞতা দিয়ে ঘটনা শুরু করছি। কয়েক মাস আগে, আমি বিদেশে আরেকটি মাস্টার্স করার জন্যে ইউনিভার্সিটি এজেন্ট খোজা শুরু করেছি। হঠাৎ একদিন দেখি, একজন এজেন্ট আমার কাছে ম্যাসেজ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়: স্থানীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট।

লিখেছেন রবিন.হুড, ০৮ ই জুলাই, ২০২৫ বিকাল ৪:৩৭


বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার একটি দীর্ঘ ও ঐতিহ্যবাহী ইতিহাস রয়েছে। অতি প্রাচীন কাল থেকে উপমহাদেশে স্থানীয় সরকারের অস্তিত্ব খুজে পাওয়া যায়। সাধারণত স্থানীয় সরকার বলতে এমন জনসংগঠনকে বুঝায় যা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ঝড়ে উড়ে যাবে বাংলাদেশ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৮ ই জুলাই, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:০০


অনেকদিন পর বাংলাদেশের মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীরা একসাথে একটি বড় ইস্যুতে সাড়া দিয়েছে। মিডিয়া আর জনগণ সমানতালে অন্তর্বর্তী সরকারের ডাউনফল নিয়ে রসিকতা করছে। আসলে বাঙালির স্বভাবই এমন ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার 'নতুন নকিব'-কে ব্লগে দেখছি না!

লিখেছেন সত্যপথিক শাইয়্যান, ০৯ ই জুলাই, ২০২৫ সকাল ৮:০৯

আজ প্রায় ৬ দিন হতে চললো ব্লগের ইসলামী ঘরানার পরিচিত মুখ 'নতুন নকিব'-কে দেখা যাচ্ছে না! তিনি ভালো আছেন তো?

আমি যখন আমার সিভি কিভাবে সাজাবো তা ভেবে কুল কিনারা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×