সামনে দিয়ে যাবার সময় মেয়েটা একবার তাকালো, তারপর সোজা হেঁটে চলে গেল। হয়তো সম্ভাব্য খদ্দের হিসেবে মালেক সাহেবকে পছন্দ হয়নি। মালেক সাহেবও মেয়েটির দিকে মনোযোগ দেন না। বেছে বেছে বাদাম চিবুতে থাকেন। সারাদিনের জন্য বিশ টাকার বাদাম বরাদ্দ, কাজেই সময় নিয়ে বাদাম চিবুতে হয়। বাদামের ধর্ম হলো একবার খাওয়া শুরু করলে পুরো ঠোঙ্গা শেষ করতে হয়, ঠোঙ্গায় অবশিষ্ট রেখে চুপচাপ বসে থাকা যায় না। তাই তিনি কখনো বিশ টাকার বাদাম একসাথে ক্রয় করেন না, দশ টাকা দশ টাকা করে দুই বারে ক্রয় করেন। ইদানীং বাদামের দাম বেড়ে যাওয়ায় মাঝে মাঝে তাঁর খুব বিরক্তবোধ হয়। এই মাত্র কিছুদিন আগেও এক টাকা দুই টাকায় একশো গ্রাম বাদাম পাওয়া যেত সেটা এখন বিশ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে।
মেয়েটির দিকে মনোযোগ না দিতে চাইলেও চোখ চলে যায় ওর দিকে। ঠিক রুপসী বলা যায় না তবে আকর্ষণ তো খানিকটা আছেই। সামান্য দূরে কম বয়েসী একটা ছেলের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। অঙ্গভঙ্গি দেখে স্পষ্টই বোঝা যায় সে কী চায়। মাস খানেক ধরে নিয়মিত ভাবে রমনা পার্কে দিন পার করেন মালেক সাহেব। এই সামান্য অভিজ্ঞতায় তিনি এরকম অনেক মেয়েকেই দেখেছেন, কিন্তু এই মেয়েটি অস্বাভাবিক রকমের রোগা। হাড়ের সাথে মাংস আছে বলে মনে হয় না, সরাসরি চামড়া! উনার খুব ইচ্ছে হলো মেয়েটিকে ডেকে দু’চারটা কথা বলেন কিন্তু সাহসে কুলায় না। মেয়েটা হয়তো চূড়ান্ত মাত্রার ফাজিল হতে পারে, হয়তো তিনি কোনো একটা অপ্রয়োজনীয় বিপদে পড়তে পারেন।
বেঞ্চের ফাঁকা অংশে একটা সবুজ পাখি এসে কিচিরকিচির শুরু করলে উনি চোখ ফেরালেন। না, পাখিটা পুরাপুরি সবুজ না। পেটের দিকটা হলুদ রঙ্গের, ঠোঁটটা লাল, ডানার নীচের অংশটা জেব্রার মতো সাদা-কালো ডোরাকাটা। লেজের দিকটা কালো। পাখিটার নাম কী? মালেক সাহেব পাখিটাকে চেনার চেষ্টা করলেন যদিও তিনি পাখি সম্পর্কে একবারেই অজ্ঞ। এটা কি মুনিয়া পাখি? হতে পারে। দীর্ঘদিন শহরে থাকার কারণে কাক ছাড়া অন্য কিছু তো চোখে পড়ে না। কোথায় যেন পাখি মেলা হয় তিনি মনে করতে পারেন না। পাখিদের সাথে সখ্যতা নেই একবারেই। শৈশবে কি ছিল? না, তেমন একটা ছিল না বোধহয়। কেবলমাত্র একঝাঁক টিয়া পাখির কথা মনে পড়ে। ওরা একবার গ্রামে এসেছিল। গ্রামময় ঘুরে বেড়িয়েছিল। স্বপনদের বাড়ির আমড়া গাছটা ভরে গিয়েছিল টিয়া পাখিতে। তখন অনেকেই ফাঁদ পেতেছিল ধরার জন্য যাদের মধ্যে মালেক সাহেব ছিলেন না। তিনি পাখিটার দিকে হাত বাড়ালেন। পাখিটা উড়ে গেল না কিংবা হাতের দিকেও এগোলো না কেবলমাত্র মাথা ঘুরিয়ে পরপর কয়েকবার তাকালো মালেক সাহেবের দিকে। পাখিটার জন্য কয়েকটা বাদাম সম্প্রদান করার কথা ভাবলেন। বললেন, কি রে বাদাম খাবি?
পাখিটা সম্ভবত কথাটা বুঝতে পারলো। কিচিরমিচির করে কিছু একটা বললো।
উনি খানিকটা উৎসাহ বোধ করলেন। একটা বাদাম খোসা ছাড়িয়ে চার টুকরো করে ছড়িয়ে দিলেন পাখিটার সামনে। পাখিটাও বাদামের দিকে এগিয়ে গেল। তিনি বললেন, পুরা চারটাই খাবি। নষ্ট করবি না।
- কিচিরমিচির কিচিরমিচির।
- হুম, দেশের অবস্থা ভালো না। এই সময় খাবার নষ্ট করা উচিত না। কেমন?
পাখিটা ঠোঁকরে ঠোঁকরে বাদাম খেয়ে চললো।
- তুই তো জানিস না, আমার অবস্থাও ভালো না। অনেক কষ্টে আছি। আর্থিক কষ্ট। মানসিক কষ্টও ছিল। সারাজীবনের প্রাপ্তি এক নিমিষেই নাই হয়ে যাচ্ছিল, অনেক সাহস করে বেরিয়ে এসেছি। পানিতে বসবাস করে কুমিরের সাথে যুদ্ধ করা যায় না। তাই পানি থেকে উঠেই এলাম। হা হা হা। কি রে আরো বাদাম খাবি? তোর সঙ্গী নেই? তোর যে বয়স তাতে তো সঙ্গী থাকার কথা। মিলমিশ হয় এমন সঙ্গী বেছে নিবি। একা থাকা ঠিক না। এই যে আমাকে দেখ, সঙ্গী আছে কিন্তু মিলমিশ নাই। সঙ্গী থেকেও বড়ো একা। হা হা হা।
মালেক সাহেব দীর্ঘক্ষণ ধরে পাখির সাথে কথা বললেন। আরো কয়েকটা বাদাম সম্প্রদান করলেন। এর মধ্যে কখন যে রোগা মেয়েটি পাশে এসে দাঁড়িয়েছে তিনি লক্ষ্য করেননি। মেয়েটি হঠাৎ বললো, আপনে কি পাগল? পাখির লগে কথা কন?
তিনি খুবই অপ্রস্তুত হয়ে যান। মেয়েটিকে উপেক্ষা করে পাশে রাখা খবরের কাগজটা তুলে নিলেন হাতে। অর্থনীতির পাতায় চোখ বোলাতে লাগলেন। সারাবিশ্বের অর্থনীতি যখন মন্দায় আক্রান্ত এমন একটা সময় তিনি চাকরি থেকে স্বেচ্ছা অবসর নিলেন, তারচেয়েও বড়ো কথা বিষয়টা তিনি কাউকে জানাতে পারছেন না। আরো বছর পাঁচেক চাকরি অবশিষ্ট ছিল। কিন্তু আপাদমস্তক কালো একটা মাত্র ফাইলের জন্য তিনি এই অসম্ভব সিদ্ধান্তটি নিলেন। কেবলমাত্র চাকরি বাঁচানোর স্বার্থে তাঁকে চাকরিটা ছাড়তে হলো।
ছবি: গুগল মামা।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ দুপুর ২:৪৮