আমি এখন সপ্তম মাত্রার অপরাধী।
না, অবৈধভাবে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীর আর্কাইভঘরে ঢোকার অপরাধে নয়। সেবার ছাড়া পেতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি, লিয়ানা-ই সারা শহর তন্ন তন্ন করে খুজে আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে গেছে। ফেরার পথে সারাটা পথে পাবলিক বার্ভালে আমাকে ধরে কাদতে কাদতে। ওর কান্নায় ভিজে আমার পোশাক গ্রাফোলিনের না হলে পলিমারের হলে নিশ্চিতভাবে শুকোতে তিনদিন লাগতো। বাসায় ফিরেও কেদেছে। আমি বলিনি একটি কথাও। বসে বসে ও'র কান্না দেখেছি। মানুষ পারেও! বিনোদনের জন্য পাবলিক হলোগ্রাফিক চ্যানেলগুলোর মেয়েরা কর্নিয়ার ওপরে ভিট্রিয়াস লোশন লাগিয়ে যেমন কান্নাকাটির অভিনয় করে আরকি, আর সেই পানি নাকি নোনাও হয়!
"তোমার যত অভিনয় আর স্বস্তা কান্না, শুনিও তোমার বিবেক-টাকে সামনে ধরে আয়না"
কোথায় শুনেছি কথাটা ভুলে গেছি। কিন্তু ও'কে শোনাতে ভুলিনি। ফলাফল যা হবার তা-ই, ছাড়াছাড়ি। লিয়ানা ভাবতেও পারে নি এরকমভাবে পরিস্থিতি বদলে যাবে। যেদিন ও'কে খুলে বললাম সবকিছু, জবাব চাইলাম এত বছরের প্রতারণার, কোন উত্তর ও দিতে পারেনি। উত্তর আমি চাইনিও, চলে এসেছি সবরকমের প্রতারণাকে পেছনে ফেলে, জমানো ইউনিট যা ছিল খরচ করে শহরে একটা খুপড়িতে নিজের গবেষণাগার গড়ে তুলেছি। এই অবস্থায় কাজটা সহজ করে দিয়েছে বিপদের দিনের জন্য জমানো ইউনিটগুলো। রাত দিন পড়ে রইলাম গবেষণায়। নিউরাল নেটওয়ার্ক। সেখান থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপরে ত্রিতানের সূত্র। ঘরে বসে গবেষণা এগুনো খুব একটা সুখকর অভিজ্ঞতা হতে পারে না। ফলে যা করতে হলো, একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যুক্ত হয়ে গেলাম শুধু নিউরাল নেটওয়ার্কে এক্সেস পাবার জন্য। এরপর আমাকে পেছনে তাকাতে হয়নি।
সপ্তম মাত্রার অপরাধীদের সেলে বাড়তি নিরাপত্তার জন্য বাইরের জগতের সাথে খুব একটা যোগাযোগের সুবিধা থাকেনা। তারপরেও বাইরের কিছু উত্তেজনা আর কোলাহল কানে আসছিল। আর সেলের আমি ভেতর পা এলিয়ে বসে হলোগ্রাফিক জানালাটার দিকে তাকিয়ে আছি। সাগরের দৃশ্য বদলে গিয়ে একটি বাচ্চা মেয়ের দৃশ্য জানালায় ভেসে উঠলো। লাল ফ্রক পড়া মেয়েটা পুতুল জড়িয়ে দাড়িয়ে আছে খোলা মরুভূমির কোন একটা জনশূন্য বাড়ির সামনে। কালো চোখজোড়ায় কি অসীম বিষণ্ণতা....
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আর মস্তিষ্কের সাথে ইলেক্ট্রনিক যোগাযোগের প্রটোকল নিয়ে পড়াশোনা শেষে আমি আরো অস্থির হয়ে পড়লাম। উদ্ভ্রান্তের মত ঘুরে বেড়ালাম কিছুদিন। এরপরই জীবনের সবচেয়ে বড় ঘটনা টা ঘটল।
রিকিভ শহরের শতবর্ষ পূর্তিতে বিজ্ঞান কাউন্সিলের আয়োজনে সবচেয়ে বড় যে প্রযুক্তি মেলা হয়, ঘটনা ঘটল সেখানেই। বিজ্ঞান কাউন্সিল প্রতিবার সেরা প্রযুক্তি বিচারে যে পুরস্কার দিয়ে থাকে, এবার সেটার জন্য মনোনীত হয়েছে "মেমরি মেইজ"। দেখে কোনভাবেই বোঝার উপায় নেই, কি এর মহিমা। বিদঘুটে হেলমেট মাথায় চড়িয়ে হলোগ্রাফিক স্ক্রীনে মস্তিস্কের নিউরনে ঘুরে বেড়ানো যাবে! প্রাইভেসি রক্ষা করে অবশ্যই। মানে ধরুন হলোগ্রাফিক স্কৃণে আপনার মস্তিষ্ককে দেখাবে গোলকধাধার মত, আর সেখানকার একপ্রান্তে দাড়িয়ে থাকবেন আপনি। কোন একটা স্মৃতির কথা চিন্তা করবেন, আর গোলকধাধা ঘুরিয়ে আপনাকে নিয়ে যাবে মস্তিষ্কের স্মৃতির সেই বিশেষ অংশে! মজার ব্যাপার হল, সেই বিশেষ অংশে যাবার সময় আশেপাশের স্মৃতিগুলোও পড়ে ফেলতে পারে এই মেমরি মেইজ। মানে ধরুন আপনি কোন একটা স্মৃতির কথা মনে করতে পারছেন না, সেই স্মৃতির কাছাকাছি কোন ঘটনার কথা ভাবতে থাকুন, মেমরি মেইজ যদি আপনাকে স্মৃতির সেই অংশে নিয়ে যেতে পারে, তাহলে কাছাকাছি অন্য ঘটনার স্মৃতিগুলো জেনে ফেলতে পারবেন।
বিজ্ঞান কাউন্সিলের মেলায় দেখেই বুঝছিলাম, এই মেমরি মেইজকেই খুজছি আমি। আমার হারানো স্মৃতি খুজে পেতে কেউ যেন আগে থেকেই তৈরি করেছে এই মডিউল! কে সেই আবিষ্কারক?
আমি!
কিভাবে এই স্মৃতি পুনরুদ্ধার করলাম, সেটা আর বলছি না। তবে এতটা সহজ হবে আমি নিজেও ভাবি নি। বিজ্ঞান কাউন্সিলের মেলায় প্রতিটি দিন পরে থেকছি আমি মেমরি মেইজের সামনে। একটু ফাকা পেলেই ছুটে গিয়ে মাথায় পড়েছি সেই বিশেষ যন্ত্র....সহ্য করেছি ইলেক্ট্রডের স্পার্ক, কিন্তু নিজের স্মৃতির চেয়ে মূল্যবান আর কিছু হতে পারে? না। মেমরি মেইজে জেনেছি আমার গ্র্যাজুয়েট , পোস্ট গ্র্যাজুয়েট আর রিসার্চের সব ঘটনা। সবচেয়ে কম বয়সে বিজ্ঞান কাউন্সিলের জন্য মনোনীত হবার কাহিনী। এরপর সহকর্মীদের সাথে মেমরি মেইজের প্রজেক্ট হাতে নেয়া। লিয়ানার সাথে প্রেম থেকে বিয়ে। আমার সব সর্বনাশের হোতা যে এই মেয়ে, সেটা যদি জানতাম! কেন ওকরে মেমরি মেইজে বসিয়ে স্মৃতিগুলো হাতড়ে দেখিনি! বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতেই আমি হানকে দেখতে পারতাম না। ধান্দাবাজ এই ছেলেটি সব কিছুতেই করতো ব্যবসায়িক চিন্তা, প্রতারণা, অবৈধ পেটেন্ট ব্যবসা থেকে শুরু করে এমন কিছু নেই যা সে করেনি। লিয়ানা যেদিন হানকে ছেড়ে আমার কাছে এসে পড়লো, সেদিন লিয়ানাকে বলেছিলাম আজ আমি সবচেয়ে সুখী। হলোগ্রাফিক জানালার বিষণ্ন মেয়েটির আইরিশের রং কালো থেকে সমুদ্রের নীলে বদলে গেল, আর আমার চোখে ভর করলো তার বিষণ্ণতা।
আমি সপ্তম মাত্রার সেলে বসে বাইরের উত্তেজনাটুকু টের পাচ্ছি। আজ আমার বিচার। লিয়ানারও। সেই লিয়ানা, যে আমার কাছে এসেছিল শুধু হানের স্বার্থেই, মেমরি মেইজ প্রজেক্টের পেটেন্ট যাতে আমি বিক্রিকরে দেই হানের কাছে। তার উদ্দেশ্য সফল হয়নি, আমি পেটেন্ট দিতে চাইনি। এরপরই সব হয়ে গেল ওলটপালট। গবেষণাগারে পরিকল্পিত দুর্ঘটনা, সব বিজ্ণানী আর টেকনিশিয়ানদের মৃত্যু, কাকতালীয় ভাবে মস্তিস্কের সিরিয়াস ইনজুরি নিয়ে আমার বেচেযাওয়া। সেই থেকে শুরু হল লিয়ানার প্রতারণার জীবন! কারন ল্যবরেটরীর এক্সিডেন্ট টা পরিকল্পনা মত ঘটলেও বাচতে পারেনি হান, পালানোর সময় লেজার বীমে পুড়ে ভস্ম হয়ে গেছে।
মেমরি মেইজের সৌজন্যে ফিরে পাওয়া স্মৃতি আমার বেচে থাকার প্রশ্নের সমাধান দিতে পারলেও নিয়ে এসেছে আরেক বিপত্তি। মেমরি মেইজের পরীক্ষামূলক দুর্ঘটনায় যে বারো জন বিজ্ঞানী আর টেকনিশিয়ান মারা গিয়েছে, সেটার বিচার প্রক্রিয়া শুরু করেছে স্বয়ংক্রিয় ফেডারেল সিস্টেম। এতবড় দুর্ঘটনা সচরাচর চোখে পড়ে না, তাও খোদ কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান কাউন্সিলের সদস্যরা দুর্ঘটনার শিকার বলে অপরাধের মাত্রা ধেই করে সপ্তমে চলে গিয়েছে। স্বয়ংক্রিয় বিচার ব্যবস্থায় লিয়ানাও অপরাধী। আজ তারও বিচার। আমার সাথেই। যার জন্য পুরো জীবনটাই ওলটপালট হয়ে গিয়েছে আমার। যেখানে আমার থাকার কথা বিজ্ঞান কাউন্সিলের সর্বোচ্চ প্যানেল -
সেখানে আমি আজ সপ্তম মাত্রার অপরাধী!
পরবর্তী পর্বে সমাপ্য
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০০৯ দুপুর ১:২২