somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মেয়েদের কথা; লজ্জা পুরুষের ভূষণ-৬

০৮ ই ডিসেম্বর, ২০০৮ ভোর ৪:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



জটলার ভিতর থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে প্রমীলা আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলো, তারপর চোখ নাচিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, কি রে, খবর কি? প্রত্যুত্তরে আমিও মিষ্টি করে হাসলাম।
দুজনের হাসি বিনিময়ে এ আমার প্রথম মনে হলো আমরা মুহূর্তে অনেক কাছাকাছি চলে এসেছি।
জটলা থেকে কাছে সরে এসে প্রমীলা জিঞ্চাসা করলো, একটা ভয়েস চেঞ্জ নিয়ে খুব কনফিউশনে পড়ে গেছি রে!
ভাবছিলাম, হয়তো দু-চারটে রোমান্টিক কথাবার্তা হওয়ার সুযোগ এল বুঝি! মর্মাহত এবং আশাহত হলাম।
বললাম, কিসের কনফিউশন?
'হু আর ইউ' এর প্যাসিভ ভয়েস কি 'বাই হুম আর ইউ' নাকি 'হুম আর বাই ইউ' হবে?
আমার মেজাজ বিগড়ে গেল। আজ বাংলা প্রথম পত্রের পরীক্ষা, বাংলার পরিবর্তে অলক্ষণে মেয়েটা ইংরেজি বিষয়ের একটা বিদ্‌ঘুটে প্রশ্ন নিয়ে হাজির। নিশ্চয়ই এখন এটার উত্তর বের করা নিয়ে মেয়েগুলোর মধ্যে তুমুল বাক-বিতণ্ডা চলছে, একেকজনে একেকটা বলছে এবং প্রত্যেকেই নিজ নিজ সমাধানকে সঠিক প্রমাণিত করার প্রাণান্ত চেষ্টা চালাচ্ছে। পরীক্ষার ঠিক আগের মূহূর্তে এসব আজেবাজে প্রশ্ন করার কোন মানে হয়? তা-ও আবার প্রশ্ন করার ধরণটা দেখুন না - প্রশ্ন করবি তো সোজা একটা প্রশ্ন কর। প্রশ্নের সাথে আবার দুটি উত্তর জুড়ে দিয়ে উত্তরদাতার মাথাটাকে আউলা করে দিচ্ছে। পিলার বানানে কি একটা 'এল' বসে, না দুটো 'এল' বসে? এই প্রশ্নের পরিবর্তে সোজা জিঞ্চাসা করলেই হয়, পিলার বানান কি? তারপর জেনে নাও পিলার শক্ত হওয়ার জন্য কয়টা 'এল' বসানো হয়।

আমি প্রমীলাকে বললাম, 'হু আর ইউ' দিয়ে কখনো পরীক্ষায় ভয়েস চেঞ্জ আসবে না।
কিন্তু প্রমীলা আমার সঙ্গে তর্ক জুড়ে দিল। বললো, তুই দেখি কিছুই জানিস না! 'হু আর ইউ' এবার অবশ্যই আসবে। এবারের জন্য এটা খুবই ইম্পর্টেন্ট।
আমি বললাম, তাহলে মাফ কর্‌, উৎপলেন্দু স্যারের কাছে যা, ভয়েস চেঞ্জের ওপর নাকি তাঁর পি.এইচ.ডি করা আছে।
প্রমীলা রূঢ় স্বরে বললো, তুই না পারবি তো না পারবি, কার কাছ থেকে জানতে হবে সেটা কি তোর কাছ থেকে জানতে হবে?
আমার প্রথম সকালটা বিরক্তিতে ভরে গেল। এমনটি চাইনি। এত আগে সকুলে এসেছি, সবার সাথে দেখা করার জন্য, মনটা ভালো করার জন্য এবং মেজাজটা প্রফুল্ল রাখার জন্য। প্রমীলা মেয়েটা এমন কেন? দিল তো মেজাটা গরম করে। আপনা আপনি আমার মুখ থেকে একটা শব্দ বেরিয়ে এল - 'অপদার্থ'। মুহূর্তে আমি নিজেকে সামলে নিলাম। ভাগ্যিস, প্রমীলা ততক্ষণে দূরে সরে গেছে। আমি অল্পের জন্য আরেকটি সম্ভাব্য প্রলয়কাণ্ড থেকে বেঁচে গেলাম।

সীমাহীন ধইর্য্য আর অধ্যবসায়ের মধ্য দিয়ে বাংলা-ইংরেজির উভয় পত্র মিলিয়ে তিনটি পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল। আমার পরীক্ষা আশাতিরিক্ত ভালো হলো। ভালো হলো শেরখানেরও। সে তো ঘোষণাই দিয়ে ফেললো, এবার সে নির্ঘাত স্টার মাক্র্‌স মেরে দিবে। ১৯২৭ সালে মালিকান্দা মেঘুলা হাইস্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অদূর কিংবা সুদূর অতীতে এ স্কুল থেকে কেউ স্টার মাক্র্‌স পাওয়ার গৌরব অর্জন করতে পেরেছিলেন বলে আমরা বর্তমান ছাত্র-শিক্ষক কেউ শুনিনি। এবার সবাই খুব আশাবাদী যে নাহিদ নামক গোবেচারাটি (যে কিনা স্বয়ং আমি) একটা ছোট খাট কিংবা প্রকাণ্ড স্ট্যান্ড করে ফেলতে পারে। এর সাথে শেরখান স্টার মাক্র্‌স পেলে আরো কয়েকজন এই সম্ভাব্য তালিকায় অন্তর্ভুক্তি পাবার দাবি রাখে, যেমন কবির উদ্দিন, ইমরান, জাহিদ এবং এমনকি প্রমীলাও। তাহলে এক সঙ্গে গোটা চারেক ছাত্র-ছাত্রী স্টার মাক্র্‌স পেয়ে যাবে! রীতিমত হইচই পড়ে যাবে দেখছি!

স্টার মাক্র্‌স পাওয়ার ঘোষণা দেয়ার পাশাপাশি প্রজাপতি দেখার লোভও শেরখানের বেড়ে চলেছে। আজ পরীক্ষা শেষে একটি মেয়েকে পেছন থেকে দেখে লাফিয়ে উঠেছে শেরখান, মেয়েটির মাথার ক্লিপ দেখে ওর মনে হয়েছে যে এই সেই প্রজাপতিদের একজন।
আমার বিসময়, পঁচিশ গজ দূরের ছাদে ঘূর্ণায়মান (!) প্রজাপতিদের মাথার ক্লিপ কিভাবে শেরখান মনে রাখতে পারলো? ওর দৃষ্টি ও সমৃতিশক্তি এতই প্রখর?

ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষার দিন। পরীক্ষার হলে, পরীক্ষা শুরু হবার ঠিক আগে আগে, জাহিদ চুপি চুপি আমাকে বললো, তোর জন্য একটা দারুণ খবর আছে। আমি পুলকিত হয়ে জিঞ্চাসা করলাম, দারুণ খবরটা কি? জাহিদ আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বললো, ঝর্ণা তোকে যেতে বলেছে। আমি ভীষণ অবাক হলাম, কোন একটা মেয়ে যে আমাকে কখনো যেতে বলবে এটা আমার কাছে একটা মহাবিস্ময়ের ব্যাপার। আমি কত ভেবেছি, কিন্তু বাস্তবে কেউ কোনদিন যেতে বলেনি। জাহিদের কথা শুনে মুহূর্তে আমার মন রোমাঞ্চে ভরে উঠলো। কিন্তু ঝর্ণা মেয়েটি কে? আমি জাহিদকে জিঞ্চাসা করলাম।
জাহিদ ভর্ৎসনা করে বলে উঠলো, পা-গ-ল! ঝর্ণাকে তুই চিনিস না? আমাদের সাথে একই বাসায় ঐ যে দুটো মেয়ে থাকে, ওদের মধ্যে সবচাইতে সুন্দরী মেয়েটির নামই হলো ঝর্ণা।

ঝর্ণা আমাকে কেন যেতে বলেছে তা জানার জন্য আমার মন উতলা হয়ে উঠলো। কিন্তু জাহিদ কিছুই খুলে বলছে না। শুধু মুচ্‌কি মুচ্‌কি হাসছে আর বারবার একই কথা বলছে, ঝর্ণা তোকে যেতে বলেছে। কি যে রহস্য তার কোনই কূল কিনারা পেলাম না।
নিগূঢ় মনে ঝর্ণার কথা যখন ভাবছিলাম তখনই প্রশ্নপত্র হাতে পেলাম। একটি মেয়ে আমাকে যেতে বলেছে, আমার জন্য এর চেয়ে রোমাঞ্চকর আর কোন খবর হতে পারে না। দারুণ খোশ মেজাজে পরীক্ষা শেষ করলাম। এবং আজ অনেক ভালো লিখেছি বলেই মনে হলো।

এরপর অংক পরীক্ষা এবং তার আগে চারদিন ছুটি। আনন্দ ফূর্তি করার জন্য যথেষ্ট সময় বটে। আমার জন্য তো আবার সোনায় সোহাগা, ঝর্ণা নামের একটা মেয়ে আমাকে যেতে বলেছে।
ঝর্ণার সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে যখন বিকেলে ঘর থেকে বেরিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম, তখন আমার উড়ে যেতে ইচ্ছে করছিল। হাঁটছিলাম খুব দ্রুত, কিন্তু মন বলছিল, এখনো আমি ওদের মাঝে গিয়ে হাজির হতে পারিনি কেন?
হাঁটছিলাম আর ভাবছিলাম, ভিন গাঁয়ের অজানা অচেনা একটি মেয়ে, যার নাম জীবনে আজ প্রথম শুনলাম, কিছুদিন আগে দূর থেকে কেবল ছায়ার মত দেখতে পেয়েছিলাম যাকে, এমন কি কারণ থাকতে পারে যে সেই মেয়েটি আমাকে যেতে বলবে?
আমি আপন মনেই হেসে উঠলাম। নিজেকে গালি দিলাম, ওরে নির্বোধ, তোর নিজের সম্পর্কে তো দেখছি তোর নিজেরই কোন ঞ্চান নেই। তুই যে কি অমূল্য একটা রত্ন, তা তুই নিজে না জানলেও আট-দশ গ্রামের মানুষেরা, বিশেষ করে তরুণী মেয়েগুলো কি আর না জানে?

মনে পড়লো, তাই তো, অত্র এলাকায় ইতোমধ্যেই আমি কি একটা অতি পরিচিত নক্ষত্র হয়ে ওঠিনি? মাত্র তো কিছুদিন হলো, এই জয়পাড়া হাইস্কুইলের মাঠে আন্তঃসকুল সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। সেই প্রতিযোগিতায় আমি কি অসাধারণ কৃতিত্বই না দেখিয়েছিলাম! একে তো স্কুলের সেরা ছাত্র, তার ওপরে বিতর্ক প্রতিযোগিতা, উপস্থিত বক্তৃতা, কবিতা আবৃত্তি, ইত্যাদি শিল্পকলায় আমার পারদর্শিতা আমাকে সমধিক খ্যাতি ও পরিচিতি এনে দিয়েছিল। বিতর্ক প্রতিযোগিতার কথাই ধরুন না। আমার মুখে যেন খই ফুটেছিল, আমার বাগ্মীতার তোড়ে প্রতিপক্ষ দলের মেয়েগুলো তুলোধুনো হয়ে গেল - আমি সেরা বক্তা হলাম। আর উপসিহত বক্তৃতার কথা শুনতে চাচ্ছেন? যে ছেলেটি দ্বিতীয় সহান পেল, সে আমার চেয়ে পাক্কা দশটি নম্বর কম পেয়েছিল। সব চাইতে মজার ঘটনাটি ঘটলো কবিতা আবৃত্তি প্রতিযোগিতার দিন। নির্ধারিত কবিতাটি ছিল জসীম উদ্‌দীনের জ্ঞকবরঞ্চ এবং প্রতিযোগিতার জন্য প্রথম সতবক নির্ধারিত করে দেয়া ছিল। প্রতিযোগীর সংখ্যা সব মিলিয়ে পঞ্চাশ জনের মত। একেকজন প্রতিযোগী মাইক্রোফোন ধরে দু-তিন লাইন পর্যন্ত পড়লেই হায়াৎ আলী স্যার ধম্‌কে বসিয়ে দিচ্ছেন, ওই, এইডা কোন আবৃত্তি অইলো? থাম, জাগায় যা। নে....ক্স...ট...
এভাবে প্রায় বিশ-পঁচিশ জনের আবৃত্তি শেষ হলো, যাদের মধ্যে বেগম আয়েশা পাইলট গার্ল্‌স হাইস্কুলের একটি মেয়ে এবং মকসুদপুর হাইসকুলের একটা ছেলে যথাযোগ্য সাফল্যের সাথে পুরো প্রথম স্স্তবক আবৃত্তি করার সুযোগ পেল।
এরপর যথাসময়ে আমার ডাক পড়লো। আশ্চর্য, আমার নাম উপস্থাপকের মুখে উচ্চারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে সমবেত ছাত্র-ছাত্রীরা হাততালি দিয়ে উঠলো।
আমি যেই মাত্র মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়ালাম, অমনি হায়াৎ আলী স্যার ডাকলেন, ও--ই, এদিকে আয়।
আমি স্যারের কাছে গেলাম।
স্যার বললেন, তোর আবৃত্তি আর কত শুনুম? (মাবুদ স্যার ও হায়াৎ আলী স্যারকে আমি এর আগে তিনবার পুরো 'কবর' কবিতা আবৃত্তি করে শুনিয়েছি।) আইজ তুই নজরুলের 'আমি সইনিক' প্রবন্ধটা পাঠ কর্‌। বলেই 'আমি সইনিক' প্রবন্ধটি বের করে আমার হাতে বইটি তুলে দিলেন।

'আমি সইনিক'চ পাঠ করার সময় হলঘর ভর্তি ছাত্র-ছাত্রীরা তন্ময় হয়ে গেল। একেবারে পিন-পতন নীরবতার মধ্য দিয়ে যখন পাঠ শেষ করলাম তখন সবার করতালিতে পুরো হলঘরটা গমগম করে উঠেছিল।
ঐ প্রতিযোগিতায় অবশ্য হায়াৎ আলী স্যার আমাকে কোন পুরসকার দেননি, তিনি বলেছিলেন, তোরে আমি অন্য একটা জিনিস দিমু।
আমি ঝর্নার সাথে দেখা করতে যাচ্ছি আর মনে মনে ভাবছি, আমার এত সব কৃতিত্বের কথা কি দোহারের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েনি? মেয়েরা আমার নাম শোনামাত্রই কি আমার সঙ্গে দু-একটা কথা বলার জন্য, কিংবা মাত্র এক নজর দেখার জন্য আকুল হয়ে ওঠেনি? আমি ভাবলাম, সইয়দ সুজন আলী আর জাহিদ তো প্রতিদিনই মেয়েগুলোর সঙ্গে কত গল্প গুজব করে, মেয়েগুলো নিশ্চয়ই প্রতিদিনই আমার কথা ওদের কাছে জিঞ্চাসা করে। কিন্তু ওরা আমাকে ও-কথা বলে না। বলবে কেন, ওরা যে আমার প্রতি ভীষণ ঈর্ষাণ্বিত! ঐ যে আরেকজন আছে না, সইয়দ সুজন আলী, তার তো আবার সব মেয়েদের সাথেই ভালোবাসা করা চাই। ঝর্ণার সাথেও তার অবশ্যই ভালোবাসা করা চাই। সে কি আর আমাকে এসে বলবে যে, ঝর্ণা আমাকে যেতে বলেছে? যাহোক, আমাকে এই দারুণ খবরটা দেয়ার জন্য আমি মনে মনে জাহিদের প্রতি ভীষণ কৃতঞ্চতা প্রকাশ করলাম।

যেতে যেতে আমার মনের মধ্যে অবশ্য সংকোচ ও ভয়েরও সঞ্চার হলো। আমি মেয়েটার সাথে (কিংবা দুটো মেয়ের সাথেই) ঠিকমত কথা বলতে পারবো তো? চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারবো তো? আমার মনের মধ্যে কোথা থেকে যেন অদম্য সাহসের সঞ্চার হতে থাকলো। হ্যাঁ, মেয়েরা তো আর সত্যিকারের বাঘ না যে হালুম বলে খেয়ে ফেলবে, ওরা বাঘের ছায়া মাত্র। ওদেরকে এত ভয় করার কি আছে? ওদেরকে ভয় করলে বরং ভয় আরো বাড়ে। বুকে সাহস রাখতে হবে, চোখের লজ্জাটাকে ছাই দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। আর যখন পা কাঁপতে থাকবে তখন পায়ের আঙ্গুল দিয়ে শক্ত করে মাটি চেপে ধরতে হবে, হাঁটু শক্ত ও সরল রাখতে হবে। তা ছাড়া ঝর্ণা-ই তো একমাত্র মেয়ে নয় যে জীবনে প্রথম বারের মত কথা বলতে যাচ্ছি। আমাদের ক্লাসের সবকটা মেয়ের সাথেই আমি কথা বলেছি, প্রমীলার সাথে তো প্রায় প্রতিদিনই কথা হতো, যদিও সমূহ সম্ভবনা থাকা সত্ত্বেও ওর সাথে কোনদিন আমার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারলো না।

আমার মনে হলো আমি একটা বীরপুরুষ, নিশ্চিত জয় জেনে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে ধাবিত হচ্ছি। (আমি সংসপ্তক নই, এখানে আমার পরাজয় কিংবা নিশ্চিত মৃত্যুর কোনই সম্ভাবনা নেই)। চারদিকের বাতাসে কেমন ফুরফুরে ভাব, আমার মনেও। সেই সুন্দর বিকেল, অনির্বচনীয় মোহময়তা সবদিকে।
সইয়দ সুজন আলী আর জাহিদ বারান্দার পূবদিকে সুপারি তলায় দাঁড়িয়ে কি নিয়ে যেন হাসাহাসি করছিল। আমি নিশ্চিত, ওদের হাসাহাসির বিষয় মেয়ে ছাড়া অন্য কোন কিছু হতে পারে না।
আমাকে দেখেই দুজনে খলখলিয়ে উঠলো। সুজন বললো, জানিস, রাণী তোর কথা প্রতিদিনই বলে?
কি বলে রে দোস্‌? আমি জানতে চাই।
সুজন আর জাহিদ হাসতে থাকে। আমি আবার জিঞ্চাসা করি, রাণী কোন্‌টার নাম?
ও-দুটোর মধ্যে সবচাইতে সুন্দরী মেয়েটার নামই হলো রাণী। সুজন বললো।
আমার মাথায় গোলমাল লেগে গেল। জাহিদ বলেছিল যে সবচাইতে সুন্দরী মেয়েটার নাম ঝর্ণা, আর সুজন বলছে রাণী। কোন্‌টা ঠিক? কার কথা সত্য? পরে ভাবলাম, দুটোই ঠিক হতে পারে; হতে পারে দুজনেই সত্য কথা বলেছে। একেক জনের চোখে একেক জনকে বেশি সুন্দরী মনে হতে পারে। যেমন সুজনের চোখে রাণী, আর জাহিদের চোখে ঝর্ণা। সে যাক গে, আমার চোখে যাকে বেশি ভালো লাগবে সেই হলো প্রকৃত সুন্দরী।

জাহিদ বললো, যাক এসেছিস, খুব ভালো করেছিস। তোকে একটু কষ্ট করতে হবে রে দোস্‌।
কিসের কষ্ট? আমি জিঞ্চাসা করলাম।
জাহিদ বললো, ঝর্ণা অংক নিয়ে একটু সমস্যায় আছে।
সমস্যাটা কি? আমি জানতে চাই।
ঝর্ণা লগারিদম-এ খুব কাঁচা, ভালো বোঝে না। অংকে যে তুই খুব তুখোড় এটা ও শুনেছে। ও তোর কাছে লগারিদম শিখতে চায়। তোর কি সময় হবে?
আমি বললাম, শুধু লগারিদমেই কাঁচা?
জাহিদ বললো, একটু দাঁড়া, আমি দেখে আসছি। বলেই এক দৌড়ে গিয়ে সে ঘরের ভিতরে ঢুকলো। মিনিট দুয়েক পরই বেরিয়ে এসে বললো, দোস্‌, তুই এসেছিস শুনে ঝর্ণা কি যে খুশি হয়েছে! সকালে যখন স্কুলে যাই বলেছিল তোকে যেন আজ আসতে বলি। তাড়াতাড়ি ভিতরে যা, ঝর্ণা তোর জন্য অপেক্ষা করছে।
আমি জিঞ্চাসা করলাম, কোন্‌ অংকটা কষতে হবে রে?
জাহিদ বললো, অনেকগুলো। সবগুলো চ্যাপ্টার থেকে বেছে বেছে ইম্পর্টেন্ট অংকগুলো কষে দিবি, যাতে হান্ড্রেড পার্সেন্ট কমন পড়ে।
আমি মনে মনে বললাম, অংক শেখানোর মত এমন ইন্টারেষ্টিং বিষয় খুব কমই আছে। বইয়ের ভিতর এমন একটা অংকও কেউ খুঁজে বের করতে পারবে না যেটি সমাধান করতে এই নাহিদ ব্যর্থ হবে। ঝর্ণার মত মেয়েদেরকে অংক শেখানোর মত যোগ্য শিক্ষক আমার চেয়ে দ্বিতীয়টি আর কে আছে?
জাহিদ আমাকে ঠেলা দিয়ে বললো, আরে যা না, ঝর্ণা তো তোর জন্য অপেক্ষা করছে।
এমন রোমাঞ্চকর অভিযানে জীবনে এর আগে আর কখনো পা বাড়াইনি। আজ বাড়ালাম, সগর্বে। আমার জয় হবে নিশ্চয়, আমি জানি, আমার এতখানি আত্মবিশ্বাস আছে।

ঘরের দরজা সামান্য ভেজানো ছিল। আস্তে ঠেলা দিতেই খুলে গেল আর সঙ্গে সঙ্গে অপর পার্শ্বের খোলা দরজা দিয়ে ভিতর বাড়ির উঠোনে গিয়ে আমার চোখ পড়লো - সেখানে ও-বাড়ির দুজন তরুণী বধূ এলোমেলো পোশাকে চৌকিতে বসে একে অপরের মাথায় তেল মেখে চুলে বেণী করে দিচ্ছিলেন। তাঁদের সাথে আমার আচমকা চোখাচোখি হলো এবং তাঁরা লজ্জা পেয়ে ঘোমটা টেনে স্থান বদল করে আড়ালে চলে গেলেন।
আমি ততক্ষণে পুরো শরীরে ঘরের ভিতরে ঢুকে গেছি। দেখি, ঘরের দু-কোণায় দু-জোড়া চেয়ার টেবিলে দুটি অতিশয় রূপবতী ও আকর্ষণীয়া মেয়ে খাতাপত্র নিয়ে লেখালেখি করছে।
তারা আমাকে দেখে একটু অপ্রস্তুত হলো। তারপর লেখা বন্ধ করে অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো, ওদের চেহারায় দুর্বোধ্য হাসির ছটা।
আমি দোটানায় পড়ে গেলাম। কোন্‌টা ঝর্ণা আর কোন্‌টা রাণী, কিভাবে বুঝি?
বোঝাবুঝির নিকুচি করি। আমি বাম পার্শ্বের মেয়েটির দিকে এগিয়ে গেলাম। আমার ভাবভঙ্গী দেখে মনে হলো মেয়ে দুটি বেশ মজা পাচ্ছে। কিন্তু আমি বিস্মিত হচ্ছি, আমি ঝর্ণার আমন্ত্রণে এবং ঝর্ণারই প্রয়োজনে এখানে ছুটে এসেছি, অথচ সেই ঝর্ণারই কোন উৎসাহ নেই কেন? আমাকে সাদর সম্ভাষণ জানাবে না? এতটুকু সৌজন্য কি ঝর্ণা শিখেনি?
আমার সামনের মেয়েটি কৌতুকপূর্ণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। পেছনের মেয়েটিও যে একই ঢঙে হাসছে তা সহজেই অনুমেয়।
সামনের মেয়েটি হঠাৎ জিঞ্চাসা করলো, কিছু চাচ্ছেন?
আমি আমার ভুল বুঝতে পারলাম, ভুল জায়গাতে চলে এসেছি। এটা রাণী, ও-পাশের জনই তাহলে ঝর্ণা।
আমি উল্টো ঘুরে ঝর্ণার কাছে গেলাম। পশ্চিম দিকে মুখ করে টেবিলের নিচে নিজের দু-পা পাকিয়ে রেখে আরাম কেদারায় পিঠ ঠেকিয়ে আরাম করে অপূর্ব মোহনীয় ভঙ্গীতে বসে আছে ঝর্ণা! ওর উল্টোদিকে টেবিলের ও-পাশে আরেকটি চেয়ার। আমার দিকে তাকিয়ে ঝর্ণা মিটিমিটি হাসছে।
আমি ঝর্ণার সামনের চেয়ারে বসে পড়ে বললাম, একটা অংকও কি পারছেন না?
ঝর্ণা কপালে চোখ তুলে জিঞ্চাসা করলো, কি বলছেন?
কোন্‌ অংকগুলো কষতে পারছেন না? আমি জিঞ্চাসা করলাম।
আপনার কথা বুঝতে পারছি না। কে আপনি? এ বাড়ির কেউ?
আমি হেসে দিয়ে বললাম, বাঃ, আমাকে খবর দিয়ে আনলেন, এখন আবার না চেনার ভান করছেন? রসিকতা তো দেখি ভালোই করতে পারেন।
ঝর্ণা বললো, আপনি পরিস্কার করে খুলে বলুন কি চান, কেন এসেছেন। বলা নেই, কওয়া নেই, আপনি হুট করে একটা মেয়েদের ঘরে ঢুকে পড়েছেন, এটা চরম অভদ্রতা এবং অসভ্যতা।
আমি বললাম, আমার নাম নাহিদ।
তো?
আমি মালিকান্দা হাইস্কুল থেকে ----
এসেছেন তো কি?
বইয়ের সবগুলো অংকের উত্তর আমার নখদর্পনে, এমন একটা অংকও আপনি আমাকে দেখাতে পারবেন না যেটা আমি পারি না।
এসব আমাকে শোনাচ্ছেন কেন?
আমার নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন?
আপনি নিশ্চয়ই এমন কোন বিখ্যাত ব্যক্তি নন যে সবার মুখে মুখে সব সময় আপনার নাম উচ্চারিত হয়। স্যরি মিষ্টার ----
আমি ভাবলাম ঝর্ণা আমাকে একটু ঝালিয়ে নিচ্ছে আর কি। হেসে দিয়ে বললাম, ফাজলামো রাখেন তো। আপনার হাতের বইটা দিন।
কেন? ঝর্ণা জিঞ্চাসা করে।
হাতে সময় খুবই কম, আমি বলি, বেছে বেছে কয়েকটি অংক দেখিয়ে দিই, দেখবেন কমন পড়ে গেছে।
ঝর্ণা এবার রেগে উঠলো। বললো, কেন অযথা ডিস্টার্ব করতে এসেছেন? কেউ কি আপনাকে আসতে বলেছে? আমরা কেউ বলেছি? মেয়ে দেখলে বুঝি আর হুঁশ থাকে না, না? যান, বেরোন।
আমি হেসে দিয়ে বললাম, অভিনয় তো দেখি ভালোই -----
শাট আপ, ঝর্ণা অগ্নিমূর্তি হয়ে উঠলো, আর একটা কথা যদি বলেন তবে পা থেকে জুতা খুলে গালে মারবো। ইডিয়ট। গেট আউট -----
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। দেখি, শোরগোল শুনে অন্দর বাড়ির মহিলারা দরজার কাছে এসে ভিড় করে দাঁড়িয়েছে। আমি লজ্জায় মিইয়ে গেলাম। আমার ইচ্ছে করলো এই মুহূর্তে আমি মাটির সাথে মিশে যাই, যেন এই মুখ আর অন্য কাউকে দেখাতে না হয়।
চেয়ার ছেড়ে উঠে বেরোতে উদ্যত হলাম, তখন ঝর্ণা ডাকলো, শুনুন মিষ্টার, আপনি যে-ই হোন না কেন, এ বাড়িতে দ্বিতীয়বার কখনো পা মাড়ালে ঝাঁটা-পিটা করে গলায় জুতার মালা ঝুলিয়ে বের করে দেব। ননসেন্স কোথাকার! নাও গেট লষ্ট!

আমি বের হয়ে এলাম। আমার চারপাশের কোন কিছুই আমার নজরে পড়লো না, কিন্তু তথাপি মনে হলো অনেকগুলো চোখ বিদ্রূপমাখা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার চোখ ফেটে অশ্রু বেরিয়ে পড়লো। এই অপমান আমি কিভাবে ঢাকবো? চারদিকে কি এই কাহিনী রাষ্ট্র না হয়ে যাবে? আমার বুকের ভিতরে দাউ দাউ করে যন্ত্রণার আগুন জ্বলতে থাকলো, অপমান, অপমান। আমি কি করে এ জ্বালা জুড়াবো?

অন্তরবাসিনী, উপন্যাস, প্রকাশকাল একুশে বইমেলা ২০০৪

পর্ব-১
পর্ব-২
পর্ব-৩
পর্ব-৪
পর্ব-৫
পর্ব-৬
পর্ব-৭
পর্ব-৮
পর্ব-৯
পর্ব-১০
পর্ব-১১
পর্ব-১২
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:০৮
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×