somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মেয়েদের কথা; লজ্জা পুরুষের ভূষণ-১২

২৫ শে এপ্রিল, ২০০৯ সকাল ১০:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


চরের মেয়ে-৫


চরের মেয়ে-১

চরের মেয়ে-২

চরের মেয়ে-৩

চরের মেয়ে-৪

চরের মেয়ে-৫


আমি অবশ্য মনে মনে মা-মেয়ের বয়সের হিসাব কষে ফেললাম। তের বছরের বড়-ছোট এঁরা। ভাবীর বয়স তাহলে ১৭। ভাবীকে জিজ্ঞাসা করলাম, বেগম আয়েশাতে পড়েন?
হ্যাঁ। আপনি জানেন না? ভাবী বললেন।
শাহজাহান আমাকে অবাক করে দিয়ে বললো, তুই জানিস না জয়নব এবার পরীক্ষা দিচ্ছে?
আমি পুরোপুরি বোকা বনে গেলাম। শাহজাহানের কপাল বটে। এমন রোমান্টিক জুটি আমি দেখিনি কোথাও। হয়তো এ জীবনে আর দেখা মিলবেও না।
আমি মনে মনে ভাবলাম, আহা, যদি আমার জীবনে এমনটি হতো, আমি আর আমার বউ এক সঙ্গে এক বাড়িতে থেকে পরীক্ষা দিচ্ছি! আমরা অবশ্য ওদের চেয়ে আরো বেশি রোমান্টিক হতাম। ওরা দুজনে দু-ঘরে বসে পড়াশোনা করে। সর্বদা শাশুড়ির কড়া পাহারায় থাকে। আমি আর আমার বউ এক সঙ্গে এক ঘরেই পড়াশোনা করতাম। একটা মাত্র টেবিল, এপার-ওপার দুটি চেয়ার, আমি আবার ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র তো, আমার বউকে আমি নিজেই পড়াতাম। পড়ানোর সময়ে বউকে বউ নয়, একজন আদর্শ ছাত্রী হিসাবে পড়াতাম। তবে ভুল-ভাট করে পা দিয়ে ওর পা ছুঁয়ে দিতাম, অসাবধানে আঙ্গুলে ঠোকাঠুকি করতাম, উড়নার ওপর দিয়ে বিচ্ছু কিংবা পিঁপড়া হেঁটে গেলে হেঁচকা টানে উড়না ঝেড়ে দিতাম, লাজুক ছাত্রীটি তখন দু-হাতে বুক ঢাকতো।
শাহজাহান আমাকে ঠেলা দিয়ে জিঞ্চাসা করলো, দুনিয়াতে আছিস তো?

আমি বাস্তবে নেমে দেখি খালাম্মা নেই। বললাম, দোস্‌, আমার যাওয়া দরকার।
অসম্ভব। ভাবী বললেন।
শাহজাহান বললো, পেয়ারা খাবি?
পেয়ারা খাওয়ার একটা গল্প আছে। করিমের গল্প।

করিম যে পথে স্কুলে যায়-আসে সে পথে ওর খালার বাড়ি। খালার বাড়ির পাশের বাড়িতে রাস্তার ধারে ছিল প্রচুর পেয়ারা গাছ। সেই গাছের পেয়ারা খাওয়ার লোভ হলো করিমের। চাইলেই কি আর পেয়ারা পাওয়া যায়? চুরি ছাড়া পেয়ারা খাওয়ার কোন পথ নেই। কিন্তু পেয়ারা চুরির কোন সুযোগই সে পাচ্ছে না।
একদিন সে দেখে একটি মেয়ে সেই গাছে। পেয়ারা ছিঁড়ে ছিঁড়ে মেয়েটি তার উড়নার কোঁচড়ে রাখছে। মেয়েটিকে দেখে করিমের মুখ হাঁ হয়ে গেল। সে পেয়ারা খাওয়ার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে মেয়েটাকে দেখতে লাগলো। অমন সময়ে ধপ করে গাছ থেকে মেয়েটি করিমের সামনে নেমে পড়ে। সে চোখ রাঙিয়ে বলে, খোঁচা দিয়ে চোখ একেবারে ছেঁদা করে দিব। তারপর সে হড়হড় করে বাড়ির ভিতরে চলে যায়।
করিমের নাওয়া-খাওয়া এবং পড়ালেখা হারাম হলো। সে কারণে অকারণে পেয়ারা তলায় দাঁড়িয়ে থাকে। অনেক দিন পর আচমকা সেই মেয়েটির সাথে করিমের আবার দেখা হয়ে যায়। মেয়েটি অবশ্য করিমের কথা মনে রেখেছিল কিনা তা করিম জানতে পারেনি।
করিম কাঁপা স্বরে জিঞ্চাসা করে, তোমার নামটি কি, আপামণি?
আপামণি এবার চোখ রাঙালো না। মিষ্টি হেসে জবাব দিল, লিপি। আপনার নাম?
করিম পাগলা।
লিপি খিলখিল করে হেসে উঠে বলে, আপনি কি একটা পাগল?
হ্যাঁ গো আপামণি।
আপনাকে তাহলে ঢিল মারি?
মারো।
কিশোরী লিপি আবারো খিলখিল করে হেসে ওঠে।
করিম বলে, আমাকে দুটি পেয়ারা দিবে?
মুহূর্তে লিপি ক্ষেপে আগুন হয়ে যায়। করিম কিছু বুঝে উঠবার আগেই কেঁদে-কুটে ওর মাকে ডেকে আনে। ওর মা তেড়ে এসে বলেন, এই কুলাঙ্গার ছেলে, তুমি নাকি আমার মেয়েকে খারাপ কথা বলেছ?
করিম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলে, আমি কোন খারাপ কথা বলিনি তো। বলেছি আমাকে দুটি পেয়ারা দিবে?
এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে লিপির মা আরো ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, শুনেছ, শুনেছ বদমাশ ছেলেটা আবারো ঐ কথা বলে?
পেছনে দাঁড়িয়ে লিপি উড়না দিয়ে আরো সযত্নে বুক ঢাকে।
ততক্ষণে করিমের খালা ওখানে চলে আসেন। লিপির মা কানে কানে করিমের খালাকে কি যেন বলেন। খালা এসে করিমের কান টেনে ধরে ওর মাথায় গোটা পাঁচেক থাপ্পড় দিতে দিতে বলেন, বেশরম কোথাকার, বল্‌, আর কোনদিন এমন খারাপ কথা বলবি? বল্‌?
আশ্চর্য, করিম মাত্র দুটি গাছন্ত পেয়ারা চেয়েছিল, আর তাতেই একটা লংকা কাণ্ড বেঁধে গিয়েছিল। করিম ওর বুকে টোকা দিয়ে আমার কাছে বড়াই করে বলেছিল, ঐ ঘটনার ছয় মাসের মধ্যেই লিপি তাকে দুটি তরতাজা প্রকৃত পেয়ারা খেতে দিয়েছিল। তারপর আরো বহুবার।

লিপির বিয়ে হয়ে গেছে। করিমের পেয়ারা খাওয়াও বন্ধ হয়ে গেছে।
আমি শাহজাহানকে জিঞ্চাসা করলাম, তুই কি প্রতিদিনই পেয়ারা খাস?
সুচতুর শাহজাহান আমার এই প্রশ্নটির ইঙ্গিত বুঝতে পারলো না। বললো, না রে দোস্‌, পেয়ারা খাই না অনেক দিন।
পেয়ারা তোর কাছে কেমন লাগে রে?
খুব শক্ত। তবে পেয়ারার কিন্তু অনেক গুন। পেয়ারা হলো বাংলাদেশের আপেল।
আমি মনে মনে শাহজাহানকে একটা গালি দিয়ে বলি, মদন, এ বিষয়ে আমার জেনারেল নলেজ কি তোমার চেয়ে কম নাকি? যা বোঝ না খালি তাই নিয়ে পেঁচাল পারো।
শাহজাহান বললো, তুই বস্‌।
আমাকে বসিয়ে রেখে শাহজাহান বারান্দার কাছ ঘেঁষে দাঁড়ানো বিশাল পেয়ারা গাছটায় তরতর করে উঠে গেল। মগডালে গিয়ে শাহজাহান পেয়ারা ছিঁড়ে নিজেই খাওয়া শুরু করে দিল। দাঁত দিয়ে শক্ত খোসাগুলো চিবিয়ে চুষে খেয়ে ভরভর করে নিচে ছোবড়া ফেলতে লাগলো। এক দণ্ডের জন্যও মুখ তার অবসর নেই। হয় বুলবুল করে পেয়ারা খাচ্ছে, নয় গুনগুন করে গান গাইছে। কখনো সে বানর-দলের মত ডাল ঝাঁকি দিয়ে ওঠে, আমি যেমনটি ছোটবেলায় করতাম। আর কিছুক্ষণ পরপর আনন্দে হেহে শব্দ করে ওঠে। এ হলো আরেকটা পাগল, যদিও সে করিমের মত বদ্ধ পাগল নয়।

ভাবী তলায় গিয়ে শাহজাহানের উদ্দেশ্য বললেন, তুই তো দেখছি দারুণ অভদ্র! নাহিদ ভাইয়ার জন্য কয়েকটা দে না? হ্যাঁ, ঐ যে -- তোর বাম হাতের কাছে --- পাতার নিচে, হ্যাঁ, পেকে হলুদ হয়ে আছে না? ফেল, ফেল ---
শাহজাহান একটা নয়, অনেকগুলো পেয়ারা ছিঁড়ে গপাগপ নিচে ফেলে দিল। ভাবী ওগুলো কুড়িয়ে চোখের পলকে অন্দর বাড়ি থেকে ধুয়ে এনে আমার পাশে বসলেন। আমার হাতে সবচাইতে বড় এবং পাকা পেয়ারাটা গুঁজে দিয়ে নিজে আরেকটা পেয়ারা খেতে শুরু করলেন। রূপার মত সাদা দাঁতগুলো তাঁর কি যে সুন্দর!
ভাবী বললেন, আপনি এত লাজুক কেন নাহিদ ভাইয়া?
আমি লাজুক হেসে বলি, মোটেও না।
তাহলে মেয়েদের সাথে কথা বলতে পারেন না কেন?
পারি তো। আপনার সাথে বলছি না?
শাহজাহান ডাকলো, আরো খাবি নাকি রে?
ভাবী বললেন, আপনি গাছে চড়তে পারেন?
আমি হেসে দিলাম। বললাম, আমি গ্রামের ছেলে।
ভাবী বললেন, উঠুন তো দেখি।

গাছে ওঠা হয় না বহুদিন। শৈশব-কৈশোরের অর্ধেকটা সময় তো আমার গাছে গাছে গেছো-মেছো খেলেই কেটেছে, বাকিটা কেটেছে পুকুর-ডোবা-খালের পানিতে ডুব-সাঁতার খেলে খেলে। সেই মজার দিনগুলো এখন আর নেই, 'সেই যে আমার নানান রঙের দিনগুলি।'
ভাবী খিলখিল করে হেসে উঠে বললেন, আপনি পেয়ারা গাছে চড়তেও ভয় পান?
এ সময়ে সত্তর হাজার শাহজাহানও আমাকে গাছে উঠাতে পারতো না। অন্য কোন পুরুষ মানুষও না। কিন্তু ভাবী আমার শরীরে আগুন জ্বেলে দিয়েছেন, গাছে না উঠতে পারলে তিনি আমাকে নির্ঘাত কাপুরুষ ভাববেন। আমি কাপুরুষ নই। মেয়েদের সাথে আজকাল ভালোই কথাবার্তা বলতে পারি। যারা মেয়েদের সাথে জড়তাহীনভাবে কথা বলতে পারে, তারা বিশ্ব জয় করতে পারে। পারি আমিও। গাছে উঠতে পারা কোন্‌ ছার!
আমি ডাল বেয়ে তরতর করে গাছে উঠে গেলাম।
শাহজাহান বললো, গাছে কি ঠাণ্ডা, দেখছিস? এখন গাছ ভুরভুর করে অক্সিজেন ছেড়ে দিচ্ছে, আর আমরা সুড়সুড় করে সেই অক্সিজেন টেনে নিচ্ছি।
আমি মনে মনে বললাম, মদন!

ভাবী গাছের নিচে এসে দাঁড়িয়েছেন। আমার দিকে তাকিয়ে মুচ্‌কি হাসছেন, আমি আড়চোখে তা লক্ষ্য করতে থাকলাম। আমি কত বড় গেছো তা দেখানোর জন্য একেবারে চিকন একটা ডালে পাড়া দিয়ে আস্তে আস্তে ওটার মাথার দিকে যেতে থাকলাম। ভাবী নিচে থেকে আঁতকে উঠলেন, আল্লাহ্‌, ডাল ভেঙ্গে পড়ে যাবেন তো?
আমি প্রায় ঝুলে গিয়ে একেবারে মগডাল থেকে, যেখান থেকে শাহজাহানের চৌদ্দ গুষ্টিও পেয়ারা পাড়তে পারবে না, আমি সেখান থেকে কয়েকটা পেয়ারা পেড়ে আনলাম। তারপর আরো একটু নিচে নেমে এসে একটা ডালের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে পড়ে পেয়ারা খেতে শুরু করলাম। নিচে দাঁড়িয়ে ভাবী আমার প্রতি অবাক চোখে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগলেন। পেয়ারা গাছ বাইতে আমার বীরত্ব দেখে তিনি মুগ্ধ অভিভূত।
কিছুক্ষণ পর দেখি ভাবীও গাছে উঠে আসছেন। মেয়েদের পক্ষে তো আর এত ওপরে ওঠা সম্ভব না, তাই তিনি নিচের দিকের একটা ডাল থেকে পেয়ারা ছিঁড়ে খেতে লাগলেন।
হঠাৎ দেখি ভাবী আমার ঠিক নিচের ডালটিতে দাঁড়িয়ে। আমার দিকে ডান হাতটি বাড়িয়ে ভাবী বললেন, একটু ধরুন তো।
জীবনে কোন নারীর হাত স্পর্শ করার সৌভাগ্য আমার হয়নি। সহসা সে সুযোগ এভাবে এসে হাজির হবে তা কি কখনো কল্পনা করেছি?
কিন্তু ভাবীর হাত ধরতে আমার ভীষণ সংকোচ হতে লাগলো। পরের বউয়ের হাত ধরা, তা-ও আবার তাঁর স্বামীর চোখের সামনে, কেউ কি কখনো ভেবেছেন? একেবারে নির্জনে, গোপনে হলে তার মধ্যে আলাদা রোমাঞ্চ থাকে - আমি নির্দ্বিধায় এবং অসীম সাহসের সাথে হাত বাড়িয়ে তাঁকে টেনে তুলতে পারতাম।

ভাবী উঁচু করে হাত এগিয়ে ধরে আছেন। বেশি ভাববার সময় নেই, আমি আমার শক্ত হাত বাড়িয়ে ধরলাম - দুটি হাত - একটি পুরুষ, আরেকটি নারীর হাত - একটি হাত কোনদিন বিদ্যুতায়িত হবার সুযোগ পায়নি, কত লালায়িত ছিল, অন্য হাতটি - যে হাত প্রতিদিন প্রিয় পুরুষের হাতে প্রচুর রোমাঞ্চে পিষ্ট হয় - আমার মনে হলো, নারীর হাত ধরার চেয়ে অধিক রোমাঞ্চকর কোন ঘটনা হতে পারে না। এমনটি করে একটি হাত ধরে আমি সারাটি জীবন কাটিয়ে দিতে পারবো।।
ওপরে টেনে তুললাম। ভাবী সামান্য হাঁপিয়ে উঠেছেন। হাঁপাতে হাঁপাতেই ঠিক আমার সামনের অতি কাছের ডালটিতে পা ঝুলিয়ে বসে পড়লেন।

বাতাসে ভাবীর চুল ওড়ে, উড়না সামান্য খসে পড়ে, তিনি সাবধানে বারবার টেনে তোলেন। কিশোরীর মত তাঁর চঞ্চল পা দু-খানি দোলে। মাঝে মাঝে আমার পায়ের সাথে তাঁর পায়ের অতি মৃদু, অতিশয় সূক্ষ্ম ছোঁয়া লাগে, কিংবা ছোঁয়া লেগেছে বলে ভ্রম হয়, অথবা ছোঁয়া লাগে লাগে ভাব হয়। সে সময় আমার দেহে বিদ্যুৎ খেলে যায়। দুঃসহ কষ্ট! আমি সংকুচিত হতে থাকি। কিছু বলা যায় না।
ভাবী বললেন, আপনাকে কষ্ট দিলাম। দুঃখিত।
আমি গাঢ় চোখে তাঁর দিকে তাকাই। তিনি কি বুঝতে পারেন কিছু? টের পান? নারীরা তো পুরুষের সব দশাই টের পায়, এমনকি পুরুষটিরও আগে।
ভাবী বললেন, খুব টায়ার্ড লাগছে?
নাহ্‌।
এত কাঁপছেন যে? মনে হচ্ছে তো পড়েই যাবেন।
মনে মনে বললাম, নারী, তুমি তো ঠিকই জানো আমি কাঁপছি কেন। ওপরে ওপরে অন্যটার সাথে কাটিয়ে দিচ্ছ। আমি মুনি নই, ঋষি নই। আমার শরীর আছে, রক্ত আছে, রক্তে ঝড় ওঠে। সেই ঝড়ে সমস্ত পৃথিবী কেঁপে ওঠে, সব কিছু উলট পালট হয়ে যায়।

কি ভেবে ভাবী খিলখিল করে হেসে উঠলেন। তারপর উঠে একটা ডালের ওপর হাঁটতে লাগলেন। হাঁটতে হাঁটতে সেই ডালটার আগার দিকে চলে গেলেন। ডালটার একেবারে মাথার দিকে টসটসে পাকা একটা পেয়ারা ঝুলে আছে। ভাবী বারবার হাত বাড়িয়ে সেই পেয়ারাটি ধরার চেষ্টা করছেন, কিন্তু ঠিক নাগাল পাচ্ছেন না।
ভাবী ব্যর্থ হয়ে আমার দিকে তাকালেন। আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে আছি দেখতে পেয়ে তিনি লজ্জা পেয়ে গেলেন। হেসে বললেন, আপনি পারবেন?
বললাম, আপনি চলে আসুন। বলেই আমি উঠে ঐ ডালটার দিকে পা বাড়ালাম। ভাবী আরেকটা ডালে সরে দাঁড়ালেন, সেই ডালটি এ-ডালটির একেবারে গা ঘেঁষে আছে। তাঁকে যখন অতিক্রম করে গেলাম, মনে হলো আমার ঘাড়ের ওপর তাঁর একটা গরম নিঃশ্বাস পড়লো। সেই নিঃশ্বাসে যেন ঘাড়ের কাছটা জ্বলে পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেল।
এ কোন অসাধ্য কাজ নয়। আরাধ্য পেয়ারাটিকে মুহূর্তে বৃন্তচ্যূত করে আমার মুঠিতে ভরে নিলাম। ভাবীর সামনে এসে তাঁর হাতে গুঁজে দেয়ার সময় আমি আরেকবার নারী-স্পর্শ পেলাম। আরেকবার আমার দেহে বিদ্যুৎ খেলে গেল।

কিন্তু ভাবী ওটা কিছুতেই নিবেন না। এত কষ্ট করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নরম ডাল থেকে পেয়ারা পেড়ে এনেছি, ওটা আমারই ভোগ করা উচিত। ভাবী এতখানি লোভী আর স্বার্থপর হতে পারেন না। এটা তো তাঁদেরই ফলের গাছ, রোজ তাঁরা এমন হাজারটি পেয়ারা খেয়ে থাকেন। ইত্যাদি।
আমি খেতে খেতে বলি, এ পেয়ারাটা দারুণ মিষ্টি।
শাহজাহান বলে বসলো, হবে না? মেয়েমানুষ ছুঁয়ে দিলে সব কিছুই মিষ্টি লাগে।
ভাবী হেসে ওঠেন। আমি বিব্রত হই। আগের জায়গায় গিয়ে বসে পড়ি। হাসতে হাসতে ভাবীও এসে বসে পড়েন। আমার সামনের ডালে, মুখোমুখী। বাতাসে তেমনি ভাবীর চুল ওড়ে, উড়না খসে পড়ে, হাত দিয়ে বারবার টেনে তোলেন। তাঁর পা দোলে। মাঝে মাঝে আমার পায়ের সাথে তাঁর পায়ের অতিশয় সূক্ষ্ম ছোঁয়া লাগে। আমার দেহে বিদ্যুৎ খেলে যায়। দুঃসহ কষ্ট! এ কষ্টের কথা বলা যায় না।

গলার স্বরটা একটু মৃদু ও অসম্ভব মিষ্টি করে ভাবী আবারো সেই আগের প্রশ্নটা করলেন, আচ্ছা, আপনি এত লাজুক কেন?
কে বলেছে?
তাহলে এত কাঁপছেন কেন? আমি কি আপনাকে খেয়ে ফেলবো নাকি? বলেই হাসির চোটে তাঁর ওপর থেকে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো।
শাহজাহান ফোড়ন কাটলো, সতী পুরুষ তো; তাই মেয়েদের সাথে ঘেঁষা লাগলে শরীর কাঁপে।
শাহজাহানের জ্ঞসতী পুরুষঞ্চ কথাটা আমার কাছে দারুণ লাগলো। সম্পূর্ণ শাহজাহানিক আবিষ্কার। আসলে জ্ঞসতীঞ্চ যে অর্থে ব্যবহৃত হয়, এর পুং লিঙ্গ 'সৎ' কিন্তু সেই অর্থে ব্যবহৃত হয় না। 'সতী নারী' আমরা অহরহ বলে থাকি। 'সতী নারী'র পুং লিঙ্গ 'সতী পুরুষ' হলে মন্দ কি?

কিন্তু মনে মনে আবারো শাহজাহানকে একটা মদন, অর্থ্যাৎ খাঁটি গাধা বলে বকা দিলাম। সতী পুরুষরা আবার ঘষা খেয়ে কাঁপে নাকি? সতী পুরুষদের কি আমার মত এমন টগবগে উদ্দাম যৌবন আছে? থাকলে আর সতী পুরুষ হতো না।
ভাবী বললেন, আপনাকে দেখার খুব শখ ছিল। আপনার বন্ধুর কাছে আপনার কথা অনেক শুনেছি। শুনেছি আপনি নাকি একটা অল-রাউন্ডার, অথচ মেয়েদের সামনে একেবারে বোবা হয়ে যান। সত্যি কিনা তাই একটু যাচাই করে দেখলাম। আপনার বন্ধুর কথাটি অক্ষরে অক্ষরে ঠিক।
আমি মনে মনেই কথা বলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। বললাম, ঠিক নহে গো নারী, বন্ধুর কথাটি ঠিক নহে। আমাকে তুমি চিনতে পারোনি। চিনতে পারোনি ছেলে জাতটাকেও।
ভাবী উঠে পেয়ারা ছিঁড়তে লাগলেন। উড়নায় কোঁচড় বানিয়ে তাতে পুরে রাখতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর কাছে এসে বললেন, এত কি ভাবছেন যে মন খারাপ করে বসে আছেন? পেয়ারা খান। ডান হাতে ডাল ধরে বাম হাতে উড়নার কোঁচড় খুলে ধরে বললেন, নিন খান।

অনেকগুলো পেয়ারার মধ্যে নিশ্চিত কয়েকটি হৃষ্টপুষ্ট পেয়ারা ছিল। আমি মুহূর্তে স্থির করে ফেললাম, একটা দুঃসাহসিক অন্যায় করবো আজ। ভাবীর কোঁচড় থেকে পেয়ারা তুলতে গিয়ে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে আমি অসতর্কতার ভান করবো, এক আঙ্গুলের ডগা দিয়ে আলতো করে বুক ছুঁয়ে দিব।
পেয়ারা তুলতে হাত বাড়িয়েছি, আর তৎক্ষণাৎ কি যেন হয়ে গেল। ভাবীর কোঁচড় গলিয়ে সবগুলো পেয়ারা গড়গড়িয়ে নিচে পড়ে গেল।
শাহজাহান বলে উঠলো, পেয়ারা ফেললি কেন রে?
ভাবী ধূর ছাই বলে বিরক্তি প্রকাশ করলেন।

আমরা গাছ থেকে নেমে এলাম। আমার অন্যায় কাজটি করা হলো না। ভাবলাম, নাই বা হলো, একটা নারীর এতখানি কাছাকাছি হতে পেরেছি তাতেই বা কম কিসে? তাঁর শরীরের ঘ্রাণ নিয়েছি, পায়ে পায়ে মৃদু ঘর্ষণ লেগে বিদ্যুতায়িত হয়েছি, তাঁর হাত ধরেছি, এটা কি কম অন্যায় হয়েছে? আচ্ছা, আমি মনে মনে যেমনটি ভেবেছি, ভাবী কি আমার মতই অমনটি করে ভেবেছেন? তিনিও কি আমারই মত বিদ্যুতায়িত হয়েছেন?

আমি চলে যেতে চাইলাম। শাহজাহান, ভাবী এবং খালাম্মা জোর করে আটকে রাখলেন। আমাকে পোলাও-মাংস খেতে হবেই।
খাওয়া দাওয়া করে যখন বিদায় নিতে উদ্যত হলাম, ভাবী আমার হাত চেপে ধরলেন। শিরি একদিন এমন করে আমার হাত চেপে ধরেছিল।
অদ্ভূত নরম আর মায়াময় কণ্ঠে ভাবী বললেন, নাহিদ ভাইয়া, আবার আসবেন তো?
এই প্রথম আমার মনে হলো, ঠিক এমনটি করে আমার একটি ছোট বোন, যখন ওর শ্বশুর বাড়ি যাব, আসার সময় আমার হাত ধরে কেঁদে উঠবে; বলবে, ভাইয়া, তুই আবার কবে আসবি?

আমি বিদায় নিলাম। মনে মনে বললাম, না রে জয়নব, আমি আর তোদের এখানে আসবো না রে। আমি মানুষ নই। আমি শুধু অন্যায় করি। আমি অসামাজিক। আমি মেয়ে মানুষ দেখলেই ভিতরে ভিতরে জেগে ওঠি আর ভাবি, এই মেয়েটির সাথে একটা অন্যায় করলে কেমন হয়! জয়নব রে, আমাকে ক্ষমা করে দিস। আমি আজ অনেকগুলো অন্যায় করেছি রে!


চরের মেয়ের কাহিনী এখানেই শেষ হলো।

উপন্যাসের বাকি অংশ চলমান...


অন্তরবাসিনী, উপন্যাস, প্রকাশকাল একুশে বইমেলা ২০০৪

পর্ব-১
পর্ব-২
পর্ব-৩
পর্ব-৪
পর্ব-৫
পর্ব-৬
পর্ব-৭
পর্ব-৮
পর্ব-৯
পর্ব-১০
পর্ব-১১
পর্ব-১২
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জানুয়ারি, ২০১২ সন্ধ্যা ৬:৪৬
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×