অহনা খুব জ্বালাতন করতো, অর্থাৎ খুব জ্বালাত,
বা বিরক্ত করতো আমাকে, যেমন, হঠাৎ হঠাৎ মাঝরাতে
মোবাইলে কল করে বলতো, ‘তুই যে ঘুমিয়েছিস, ঘুমানোর
আগে কি আমার কথা ভেবেছিস? বল, কতবার ভেবেছিস?
তাহলে একবার কলটি কেন করিস নি আমায়? নিদেনপক্ষে
একটিমাত্র মিস্ডকল!’ তারপর বলতো, ‘আজ রাতে তোকে
ঘুমাতেই দিব না।’ এরপর সে একটানা মিস্ডকল দিতে
থাকতো। পরদিন ঘুম ভাঙলে দেখতাম, মোবাইল স্ক্রিনে
কয়েক হাজার মিস্ডকল নোটিফিকেশন পুষ্পের মতো
ফুটে আছে। এবং বুদ্ধিমতী অহনা আমাকে জিজ্ঞাসা করবে
জেনেই আমি ফুলের সংখ্যাটা মুখস্থ রাখতাম, এবং
কখনো-বা ওর বাহবা পাবার জন্যেই একটা এসএমএস
পাঠিয়ে লিখতাম – ‘আজ তুই উনত্রিশ শ তেইশটা ‘চুমু’
দিয়েছিস, পাখি।’ ও তৎক্ষণাৎ কল করে বহুক্ষণ নিঃশব্দে
কাটিয়ে দিত। আমি বুঝতাম, ওর বুকে তখন ভালোবাসারা
খলবল করে উল্লাস করছে। ঝড়ের বেগে ও বেসামাল,
এবং অধিক বেসামাল হয়ে একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে গেছে।
অহনা আমায় বলতো, ‘দমে দমে তুই আমার নাম জপবি,
বুঝলি, বাবু? তোর রক্তকণিকায় আমি মিশে আছি, তোর
হৃৎপিণ্ডের অলিগলি ঘুলি-ঘুপচিতে আমি খেলা করি। আমাকে
কীভাবে ভুলে থাকবি, সোনাপাখি?’ তারপর বলতো,
‘আচ্ছা শোন, যখনই ঘর হতে বেরোবি, আমায় একটা
মিস্ডকল দিবি, ঘরে ঢুকেও দিবি। খেতে বসবি, দিবি।
খাওয়া শেষ, দিবি। আচ্ছা, আজ তুই কোন গানটা গেয়েছিস?
ঠিক আছে, এখন তুই গলা ফাটিয়ে ‘আমার সোনার বাংলা’
গেয়ে শোনাবি আমাকে। এটা তোর মতো এ বাংলায় আর
কেউ গাইতে পারে না।’ তারপর অহনা নিজেই গুনগুন করে
একমনে গাইতে থাকতো, ‘আজ তোমার মন খারাপ মেয়ে।’
একদিন দুপুরে অকারণে জেদ করলো অহনা। বললো,
‘আজ সারাদিন একটাই কাজ তোর। নিরালায় বসে আমাকে
একটানা মিস্ডকল দিতে থাকবি। বুঝেছিস তো? মিনিটে কম
করে হলেও পাঁচটা। বুঝেছিস না? হ্যাঁ, এই আমি ফোন
কাটলাম, তুই শুরু করবি এখনই। আমায় যে তুই একবারও
মনে করিস না, সেজন্য এটা তোর শাস্তি। বুঝেছিস, সোনা?’
পাঁচ মিনিট পর অহনার ক্ষিপ্ত স্বর- ‘তুই দেখি জন্মের স্লো!
মিনিটে পাঁচটা কল দিতে বলেছি, আর তুই পাঁচ মিনিটে
দিলি পাঁচটা? আচ্ছা স্টুপিড একটা তুই! ওকে, দিস ইস দ্য
লাস্ট চান্স। স্টার্ট।’
দুদিন পর অহনার ফোন। ওর কণ্ঠস্বর খুব ঠান্ডা।
বলছিল অহনা, ‘তুই সত্যিই একটা পাষণ্ড। মন বলে
কিচ্ছু নেই তোর। পাষাণের চাইতেও কাঠিন্যে ভরা দেহ।
আমি ভাবতেও পারছি না, কীভাবে একবারও আমার খোঁজ
না নিয়ে থাকতে পারলি তুই। তোকে বলেছিলাম একটানা
আমাকে মিস্ডকল দিতে, আর তুই কী করলি? কয়েকটা মাত্র
মিস্ডকল দিয়েই হাওয়া হয়ে গেলি? পারলি তুই? পারলি তুই
এতটা নিষ্ঠুর হতে? কষ্ট দিয়েছিস অনেক আমাকে। আমি
ভাবতেও পারি না কী কাঠের তৈরি মন তোর! রাগ করে
বিগত দু'দিন ফোন 'অফ' করে বসেছিলাম। ফোন ‘অন’ করে
একটা এসএমএস পাই নি, না পেয়েছি তোর একটা মিস্ডকল
অ্যালার্ট। কী করে তুই এতটা নির্দয় হতে পারিস?’
তারপর আরো ঠান্ডা হতে থাকে অহনা। স্বগত কথনে
অহনার কণ্ঠে আবেগ কিংবা কান্না ঝরে পড়ে, ‘নাহ্!
আমি বুঝে গেছি, আমায় তুই একটুও ভালোবাসিস নারে বাবুই।
মিছেই আমি খুন হয়েছি ভালোবেসে তোকে। আচ্ছা,
আমাকে বল তো মানিক, কে আছে আমার চাইতেও
অধিক হৃদয়বতী, যে তোকে আমার চাইতেও অধিক
ভালোবাসতে পারে?’
কণ্ঠে আকুতি ঢেলে আমার জবাবের অপেক্ষায় থেকে থেকে
একসময় নিজেই জবাব দিত, ‘নাই রে পাগল, কেউ নাই।’
তারপর আমি দেখেছি, অহনার চাইতে অধিক সত্যিই
কোনো হৃদয়বতী নেই, নেই অন্য-কেউ, যে-কিনা
অহনার চাইতেও অধিক ভালোবাসতে পারে।
তারপর ভালোবাসতে বাসতেই, ভালোবাসার সমস্ত চিহ্ন
চরাচরের পথে পথে ফুটিয়ে রেখে ভোরের পাখির মতো
হাওয়া হয়ে গেল অহনা।
১৪ জুলাই ২০২১