রাজনীতির মাঠে সমান ক্ষমতা বা জনসমর্থনযুক্ত একাধিক দল না থাকলে ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টি হয় না। কোনো দল নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হলে সরকার গঠন করা মাত্রই তা স্বৈরশাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, যা আমরা ২০১৩ সাল থেকে ০৫ আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারে দেখেছি। বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকার দেশ চালাচ্ছে। শেখ হাসিনা প্রধান মন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ফেলে ভারতে পালিয়ে গেছেন এবং জানা মতে এখনো সেখানেই অবস্থান করছেন। আওয়ামী লীগের শাসন আমলে দলের নেতা কর্মীরা মানুষের উপর যারপরনাই জুলুম ও অত্যাচার করায় এবং দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতির ডালপালা ছড়িয়ে দেয়ায় আওয়ামী লীগের উপর মানুষের ক্ষোভ এখন চরমে। ফলে, বাংলাদেশে বর্তমানে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম ও পদচারণা নাই বললেই চলে। এ অবস্থায় আগামী ৩ মাসের মধ্যে দেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দেশের অনেক স্থানেই বাঁধাপ্রাপ্ত হবেন, এতে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ হয়ে যেতে পারে নাম মাত্র অংশগ্রহণ। ফলে, একটা সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপি, জামাত, জাতীয় পার্টি - এ ৩টা দলই ক্ষমতা ভাগাভাগি করবে ও সরকার গঠন করবে।
অনেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলন দ্বারা নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের কথা বলছেন। তাদের দ্বারা দল গঠন করা হলেও গ্রাসরুট লেভেল পর্যন্ত তারা স্বল্প সময়ের মধ্যে, এমনকি ২-৪-৫ বছরের মধ্যেও সংগঠিত হয়ে নির্বাচনে জয়ী হতে পারবে বলে মনে হয় না। সাম্প্রতিক আন্দোলনে যে গণ-জোয়ার দেখা গেল, তাতে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য সব দলেরই ছাত্র, নেতাকর্মী ছিলেন। কাজেই, এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক দল গঠন করলে গণজোয়ারের সবাই সেই দলের সমর্থক হবেন বা সেই দলে যোগ দেবেন।
আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো একে অন্যের পিঠ; তা সত্ত্বেও আমরা যদি খুব সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করি, তাহলে সব দলের মধ্য থেকে কোনো কোনো দলকে অন্য দলের চাইতে ভয়ঙ্কর, কোনো কোনো দলকে অন্য দলের চাইতে একটু মডারেট বা নমনীয় দেখতে পাব। ১৯৮১ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষ ৯ (১৯৮১-১৯৯০-এরশাদ) ও ১১ (২০১৩-২০২৪-শেখ হাসিনা) বছরের দুইটা স্বৈরশাসন দেখলো। আমার মনে হয়, সাম্প্রতিক স্বৈরশাসনের মতো আগের স্বৈরশাসন এত ভয়ঙ্কর ও একরোখা ছিল না। অন্য দিকে, জনরোষের কবলে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার দেশ থেকে পলায়নে দেশের ইতিহাসে এক কলঙ্কময় অধ্যায় রচিত হলো, আগামীর শাসক ও স্বৈরশাসকগণ, আশা করি, এ থেকে কিছুটা হলেও শিক্ষা নেবেন এবং সতর্ক থাকবেন (যদিও ইতিহাসের শিক্ষা হলো কেউ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না - প্রোভার্ব)।
এখন ধরুন আগামী ৩ মাস, বা ৬ মাসের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো, যাতে বিএনপি, জামাত, জাতীয় পার্টি ব্যাপক ভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ পেল, এবং কোণঠাসা হয়ে পড়া আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ হলো খুবই সীমিত। তাই যদি হয়, তাহলে (উপরেই লিখেছি) যারা ক্ষমতায় আসবেন তারা আমাদের চিরচেনা আগের মুখগুলোই, এবং তারা যে অসীম ক্ষমতা পেয়ে বিগত শেখ হাসিনা সরকারের মতো অচিরেই স্বৈরতন্ত্র কায়েমে উন্মত্ত হয়ে উঠবেন না, তা কি বুকে টোকা দিয়ে কেউ বলতে পারবেন?
১/১১-তে আর্মি ব্যাক্ড সরকার ২ বছর সময় পেয়েছিল। আমার মতে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ আগের বারের চাইতে একটু বেশি হওয়াই ভালো হবে (ছাত্র আন্দোলন ৩-৬ বছরের প্রস্তাব দিয়েছে)। এতে বিএনপি, জামাত যেমন ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে সরকারে এসে অতি দ্রুত স্বৈরচারী মনোভাবপুষ্ট হবার সুযোগ পাবে না, অন্যদিকে সদ্য পরাজিত আওয়ামী লীগ ধীরে ধীরে রাজনীতির মাঠে পদচারণা করতে পারবে। রাজনীতির মাঠে সমান সমান দলের বিরাজ ক্ষমতায় একটা ভারসাম্য সৃষ্টি করে। সবগুলো দলের অংশগ্রহণে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করা গেলে আশা করি জনতার কাতার থেকে যোগ্য প্রার্থীরা উঠে আসবে। একটা সুষ্ঠু নির্বাচনই সকল নৈরাজ্য ও দুর্নীতি দূর করতে সক্ষম।
অন্তর্বর্তী সরকার ৩-৫ বছরের একটা সময় পেলে জনগণের প্রত্যাশা ও দাবি অনুযায়ী রাষ্ট্রের অনেকগুলো সংস্কারকার্য সম্পন্ন করতে পারবে। রাজনৈতিক দলগুলোও সাম্প্রতিক ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে অনুধাবন করতে পারবে যে, সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব ছাড়া দেশ ও জনগণের মঙ্গল করা সম্ভব নয়। দলগুলোর কমান্ড এশলনেরও একটা তাগিদ থাকবে যে, দলের জন্য ত্যাগী ও যোগ্য নেতৃত্ব বাছাই করার কোনো বিকল্প নাই।
৩-৫ বছর পর সবগুলো দলের অংশগ্রহণে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করা গেলে সব দল থেকেই যোগ্য নেতারা উঠে আসতে পারবেন বলে আমার ধারণা। সবগুলো বড়ো দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ সংখ্যক সাংসদ নির্বাচিত হলে দেশে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা হবে। তখন তারেক জিয়া, সজীব ওয়াজেদ, কিংবা শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়া ক্ষমতা হাতে পেয়েই ক্ষমতার দম্ভ প্রকাশ করে হুংকার ছাড়তে পারবেন না।
দেশের শান্তি চাই, সমৃদ্ধি যাই হোক না কেন।
১১ আগস্ট ২০২৪
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই আগস্ট, ২০২৪ রাত ৯:৫৬