somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঈশ্বর....যেভাবে আসেন ও যে রূপে দেখা দেন !! একটা বাস্তব ঘটনা ।

১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ রাত ১২:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ঈশ্বর......

কয়েক বছর আগের কথা, তখন আমি প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের হাউসস্টাফ। সবে সপ্তাহ খানেক জয়েন করেছি।
ডিপার্টমেন্টে লোক বলতে দুজন স্যার আর আমরা দুজন হাউসস্টাফ। ছোট ডিপার্টমেন্ট, বেড সংখ্যাও খুব কম।
আমাদের ডিপার্টমেন্টে সাধারণত পুড়ে যাওয়া রোগীদের স্কিন গ্রাফটিং বা চামড়া প্রতিস্থাপন করা হতো।
বেশির ভাগ রোগীই ছিল সমাজের নিম্নবিত্ত পরিবারের অংশ।
পুড়ে যাওয়ার কারণ ছিল নানা।
হয় স্বামী ছেড়ে পালিয়েছে বা শ্বশুর বাড়ির লোকজন পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করেছে বা বাপের বাড়ি লোকজন ভুলে গেছে বা পণের চাপে নিজেই আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছে।

ফিমেল ওয়াডে তখন একজন রোগী ছিল।
সায়রা খাতুন।
বয়স ২২।
দক্ষিন ২৪ পরগণার এক দ্বীপ গ্রাম থেকে আসা গরীব মুসলিম পরিবারের মেয়ে। স্বামী দ্বিতীয় বিবাহ করে তাকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করেছিল। আগুন থেকে প্রাণে বাঁচলেও শরীরের প্রায় ৮০ শতাংশই পুড়ে গিয়েছিল। মুখের অবয়ব বলতে কিছুই ছিল না।
বার্ণ ওয়াডে যমরাজের সাথে টানা তিনমাস লড়াই করে আমাদের ওয়াডে আসে চামড়া প্রতিস্থাপনের জন্য।
আমি যখন প্রথম দেখি তখন কিছু টা ভয়ই লেগেছিল।
যেন একটা জীবন্ত কংকাল আর তার উপর সারা শরীর জুড়ে খালি পোড়া চামড়ার প্রলেপ।
বাড়ির লোকজন বলতে বৃদ্ধ বাবা মা আর দুটো ছোট্ট ছেলেমেয়ে।
তারাও চাইতো না যে সে বাঁচুক। সে মারা গেলে বাবা মা দায়মুক্ত হয়, স্বামী আইনের হাত থেকে রক্ষা পায়।
এমনকি ছেলেমেয়ে গুলোও কাছে আসতে চাইতো না। হয়তো মুখের ওই দশার জন্যই।
যাইহোক আমাদের কাজ আমাদের করতেই হবে।
চামড়া প্রতিস্থাপনের জন্য কিছু নিয়ম আছে।
রোগীর পুষ্টি বা নিউট্রিশন ভালো হতে হবে, শরীরে কোন ইনফেকশন থাকা যাবে না, ক্ষতস্থান প্রতিস্থাপনের উপযুক্ত হতে হবে।
কিন্তু ওই রোগীর ক্ষেত্রে এই সব গুলোই ছিল খুব কঠিন।
শুধু হাসপাতালের খাবারে উপযুক্ত পুষ্টি পাওয়া ছিল খুবই কঠিন।
এর সাথে একটা বড় সমস্যা ছিল পুড়ে যাওয়া ক্ষতস্থানের প্রত্যেকদিনের ড্রেসিং। এই ড্রেসিং একদিকে যেমন সময় সাপেক্ষ, অন্যদিকে রোগীর কাছে খুবই যন্ত্রনাদায়ক।

বাড়ির থেকে কেউ আসতো না।

আমরাই ছিলাম ওর বাড়ির লোক।প্রায় তিনমাস প্রত্যেকদিন ড্রেসিং করতে একটা মায়া পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু মায়া দিয়ে সব হয় না। ওর দরকার ছিল মানসিক ও শারীরিক পরিচর্চা। হাজারো রোগীর ভিড়ে আমাদের একার পক্ষে তা সম্ভব ছিল না।

আস্তে আস্তে সে যেন হাল ছেড়ে দিচ্ছিল। যমরাজের কাছে নিজেকে আত্মসর্মপন করে দিচ্ছিল আর আমরা অসহায় দর্শক হিসেবে তার শেষ দিন গুনছিলাম।

তারপর ওই রোগীর পাশের বেডে একদিন একজন বাচ্চা মেয়ে, পূজা যাদব, ভর্তি হল। বিহার থেকে আসা এক শ্রমিক পরিবারের মেয়ে। তার হাতের একটা ছোট্ট ক্ষতে চামড়া প্রতিস্থাপন হবার কথা। মা মেয়ে একসাথে থাকতো।

দিনকয়েকের মধ্যে লক্ষ্য করলাম ওই মা মেয়ে আর আমাদের ভয়ংকর ভাবে পুড়ে যাওয়া রোগীর মধ্যে ভাব হয়ে গেছে। সারাদিন ওরা গল্পগুজব করতো ।আমাদের ওয়াডে আসার পর সায়রাকে প্রথমবার হাসতে দেখি।
সপ্তাখানেক পরে ওয়াডে রাউন্ড দেবার সময় ওই বাচ্চা মেয়ের মা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন " ডাক্তার বাবু আমার একটা অনুরোধ ছিল?"
আমি বললাম " কি?"
বললেন " আমি কি ওর ড্রেসিং করতে পারি??"
আমি কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম " আপনি ড্রেসিং করতে জানেন?? "
উনি বললেন " আপনি শিখিয়ে দিলে পারবো"
আমি কিছুটা ভেবে বললাম " স্যার কে জিজ্ঞেস করে বলবো"

স্যার কে কথা টা বলাতে স্যার বললেন " ড্রেসিং বেশি হলে ক্ষতি কি?
তুই শিখিয়ে দে, হিলিং তাড়াতাড়ি হবে "

পরের তিনমাস ওরা ড্রেসিং করতে থাকলো । বাচ্চামেয়ে টার ছুটি হয়ে যাবার পরেও মেয়েটার বাবা মা পালা পালা করে রোজ ওর ড্রেসিং করতো। বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে এসে দুবেলা খাওয়াতো।

তাদের পরিশ্রম মেয়ে টার শরীরে প্রাণ ফিরিয়ে দিল। আমরা তার চামড়া প্রতিস্থাপন করলাম। মুখ, হাতের শ্রী কিছুটা ফিরলো।
প্রত্যেকদিন ওয়াডে গিয়ে দেখতাম পুড়ে যাওয়া মেয়ে টা আর ওই পরিবার হাসিঠাট্টায় মসগুল। মেয়ে টা যেন নতুন পরিবার, নতুন জীবন ফিরে পেয়েছিল।

তারপর ছট পূজোর ঠিক আগে একদিন ওই পরিবারের লোকজন একদিন আমাদের এসে বললো ডাক্তারবাবু আমরা ওকে ছটপূজার সময় বাড়ি নিয়ে যেতে চাই।
স্যার বললেন এটা করা মুস্কিল। ওর বাড়ির লোক কে জানাতে হবে।
তারপর সুপারের মাধ্যমে মেয়েটির বাড়ির লোক কে ডেকে পাঠানো হোলো।
মেয়েটির বৃদ্ধ বাবা এসে বললেন " ডাক্তার বাবু আমার মেয়ে কে আমি ঘরে নিয়ে যেতে পারবো না। ওর পেট পালার ক্ষমতা আমার নেই। "
স্যার সুপার কে জানালেন ব্যাপারটা।
সুপার বললেন রোগী একজন প্রাপ্তবয়স্ক। তাকে জিজ্ঞেস করে দেখুন, সে যদি রাজি থাকে তাহলে ছেড়ে দেওয়া যাবে।

মেয়েটি কে জিজ্ঞেস করাতে বললো সে রাজি।
আমরা জিজ্ঞেস করলাম অচেনা লোকের সাথে যেতে ভয় লাগবে না।
সে হেসে বললো " এদের ভয় করবো?? এরা না থাকলে তো আমি বাঁচতামই না। এরা আমার দাদা, বৌদি। "
"আর আমার আবার ভয়?? আমার মুখ দেখে আমার নিজের বাচ্চা রা আমার কাছে আসে না। আমার কাছ থেকে কে কি নেবে?? ডাক্তারবাবু এরাই আমার পরিবার। আমি এদের সাথে যেতে চাই।"

ওরা চলে গেল সবাই মজা করতে করতে।
আমরা সে দিন সবাই অবাক হয়ে গিয়েছলাম।
কিছুটা আশংকা ছিল। কিন্তু একটা অদ্ভুত ভালো লাগা ছিল।

তারপর মাঝে বেশ কয়েক বছর কেটে গেছে।

গতবছর পার্কসার্কাস সেভেন পয়েন্ট থেকে অটো ধরবো দাঁড়িয়ে আছি।
হঠাৎ দেখি সামনে থেকে একজন হাসি মুখে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করছেন " ডাক্তার বাবু কেমন আছেন? "
আমি কিছুটা ইততস্থ হয়ে বললাম " ভালো "
ভাবলাম কোন এক পেশেন্ট হবে, আগে দেখেছি।
উনি হেসে বললেন "আমাকে চিনতে পারছেন?"
আমি বললাম " না, মনে করতে পারছি না "
উনি বলতে শুরু করলেন " সেটাই স্বাভাবিক। আপনারা সারাদিন কত পেশেন্ট দেখেন। সবার কথা মনে রাখা সম্ভব না। আপনার সায়রার কথা মনে আছে?? "

মুহূর্তের মধ্যে সব মনে পড়ে গেলো । ইনিই তো সেই ভদ্রলোক যাদের বাড়ি সায়রা গিয়েছিল।
আমি বললাম " হ্যা, হ্যা। সব মনে আছে। সায়রা এখন কোথায়?? "
উনি বললেন " সায়রা এখন আমাদের সাথেই থাকে। ওই দেখুন আসছে।"
পেছন ফিরে দেখি পুজার মা আর সায়রা হাসতে হাসতে এগিয়ে আসছে। তারপর কিছুক্ষন নানা কথা হল।

যাবার আগে পূজার বাবা মানিকলাল বললেন " ডাক্তার বাবু আপনারা আমার কাছে আমার কাছে ভগবান। আপনাদের জন্য আমি বোন পেয়েছি। মায়ের পেটের বোনের থেকেও বড়। আপনাদের যে কি বলে ধন্যবাদ দেবো?? "

কথাগুলো আমার কানে ঢুকছিল না। আমি খালি সায়রার চকচকে চোখ দুটো আর মানিকলাল আর তার বৌ এর হাসি মাখা মুখ টা দেখছিলাম। সে হাসির উজ্জ্বলতা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।

ঈশ্বর মনে হয় এরকমই হয়।

তাদের হাসি মাখা মুখ গুলো দেখতে দেখতে সে দিন ফিরে গেলাম।

আজ চারিদিকে অবিশ্বাসের বিষবাষ্প। বিভেদের প্রাচীর। খালি ঘৃনার চাষ। সমাজ টা যেন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। ভয় হয় আমরা কি ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।

কিন্তু যখন হাসপাতালে যায় আর দেখি মানুষ কে বাঁচাতে ধর্ম নয়, জাত নয়, নেতা নয়, ঘৃনা নয়, এগিয়ে আসে মানুষ।

কখনো সে রক্ত দিতে এগিয়ে আসে, কখনো সে ড্রেসিং করতে এগিয়ে আসে, কখনো সে ভালোবাসা নিয়ে এগিয়ে আসে , কখনো সে নতুন জীবন নিয়ে এগিয়ে আসে ।

পৃথিবী টা বড় সুন্দর।।
আর মানিকলাল, সায়রা রা প্রতি মুহূর্তে একে আরও সুন্দর করে তুলছে।
.
....আমার এক প্রিয় ডাক্তার বন্ধুর(ডঃ অনন্য) কাছে শোনা সত্যি ঘটনা অবলম্বনে লেখা হয়েছে ।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ রাত ১২:৩৫
২৭টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

দুলে উঠে

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৫৬

দুলে উঠে
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

মন খুশিতে দুলে দুলে ‍উঠে
যখনই শুনতে পাই ঈদ শীঘ্রই
আসছে সুখকর করতে দিন, মুহূর্ত
তা প্রায় সবাকে করে আনন্দিত!
নতুন রঙিন পোশাক আনে কিনে
তখন ঐশী বাণী সবাই শুনে।
যদি কারো মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তরে নিয়ে এ ভাবনা

লিখেছেন মৌন পাঠক, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩০

তরে নিয়ে এ ভাবনা,
এর শুরু ঠিক আজ না

সেই কৈশোরে পা দেয়ার দিন
যখন পুরো দুনিয়া রঙীন
দিকে দিকে ফোটে ফুল বসন্ত বিহীন
চেনা সব মানুষগুলো, হয়ে ওঠে অচিন
জীবনের আবর্তে, জীবন নবীন

তোকে দেখেছিলাম,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি পথখাবার খান? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য

লিখেছেন মিশু মিলন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৪

আগে যখন মাঝে মাঝে বিকেল-সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, তখন খাবার নিয়ে আমার জন্য ওরা বেশ বিড়ম্বনায় পড়ত। আমি পথখাবার খাই না। ফলে সোরওয়ার্দী উদ্যানে আড্ডা দিতে দিতে ক্ষিধে পেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

×