somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রম্য : পরীক্ষার খাতা

০৭ ই নভেম্বর, ২০২২ রাত ১১:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ছোটো থেকেই আমার একটা ধারনা ছিলো- পরীক্ষায় কম নম্বর পাওয়া মানেই হলো যে স্যার খাতা দেখেছে, সে বউ এর সাথে ঝগড়া করে খাতা দেখেছে। শুধু আমি একা না, আমরা সব বন্ধুরাও এটাই বিশ্বাস করতাম। পরীক্ষার পর আমাদের কথোপোকথন এরকম হতো:
- কেমন দিলি এক্সাম?
- দিলাম তো ভালোই, এবার স্যার যদি খাতা দেখতে বসে বউ এর সাথে ঝগড়া করে, তালে নম্বর তো কম দেবেই।
আমার বন্ধুরা মাধ্যমিক পরীক্ষা আসার ঠিক আগে মানত করেছিলো- হে ঠাকুর প্রশ্ন যেন কমন আসে।
আর আমি মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরে মানত করি- হে ঠাকুর, আমার খাতা যে স্যারের হাতেই পড়ুক, স্যারকে বউ এর হাত থেকে রক্ষা কোরো প্রভু।
বলা বাহুল্য মানত করার দিন আমিষ খেয়ে ফেলেছিলাম বলেই হয়তো ঠাকুর সেভাবে আমার কথা শোনেনি আর আমি বেধরক্কা খারাপ নম্বর নিয়ে পাশ করি। রেসাল্ট দেখে বাপ জিজ্ঞেস করলো- বাঁদরজাত! এত সোজা প্রশ্ন এসছিলো, তাও এই নম্বর?
বলেছিলাম- কি করবো বাবা, আমি তো ঠিকঠাকই লিখেছিলাম, নিশ্চই খাতা দেখার সময় স্যারের বউ এর সাথে ঝামেলা হয়, স্যারের মুড খারাপ ছিলো।
বাপ বললো- এটা ঠিক, বউ কানের কাছে ভ্যাজর ভ্যাজর করলে মুড তো বিগড়োবেই।
পাশ থেকে মা বলেছিলো- আজ রাতে রান্না বন্ধ!
যাই হোক। আমি ছোটোবেলায় শপথ নিয়েছিলাম আমি যখন মাস্টার হবো, আমার বউ এর সাথে ঝগড়ার প্রভাব আমার খাতা দেখার উপর ফেলতে দেবো না। বউ এর সাথে ঝামেলা আলাদা জায়গায়, ছাত্র ছাত্রীদের ভবিষ্যৎ আলাদা জায়গায়। এটাই ছিলো আমার কাছে আদর্শ শিক্ষকের মাপকাঠি।
তারপর অনেক বছর পেরিয়ে গেছে। আমি শিক্ষক হয়েছি। বিয়েও হয়ে গেছে। স্কুলে ছাত্রদের পরীক্ষা হয়ে গেছে, এবার আমার খাতা দেখার পালা। এই প্রথম বিয়ের পর আমি খাতা দেখবো। বলা যায় এটাও আমার কাছে একটা পরীক্ষার মতোই যে খাতা দেখতে বসে মাথা ঠান্ডা রাখতে পারি কিনা। বউকে বলে দিলাম- এই এক গ্লাস জল দিয়ে যাও আর এখন দু ঘন্টা সামনে আসবে না, আমি খাতা দেখবো। বৌ ওদিক থেকে টোন কাটলো- সামনে আসবো না মানে কি! খাতা দেখবে নাকি প্রেমিকার চিঠি পড়বে লুকিয়ে যে আসা যাবে না! যত্তসব ঢঙ।
বুঝলাম অললেডি মাথা গরম হওয়া শুরু হয়েছে আমার। কিন্তু আমি শপথ নিয়েছি যে বউ এর সাথে ঝগড়ার প্রভাব খাতার ওপর ফেলতে দেবো না। কিছুক্ষণ প্রানায়ামের মতো করে মন শান্ত করে খাতা দেখতে বসলাম।
ইতিহাস পরীক্ষার খাতা। প্রশ্ন করেছি আমিই। সোজা প্রশ্ন। পলাশীর যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত বর্ননা দাও। একজন ছাত্র উত্তর লিখেছে
শুরু করেছে এভাবে- 'পলাশীর যুদ্ধ হয়েছিলো ক্লাইভ আর সিরাজের মধ্যে'
পড়ে ভাবলাম- বাহ, একদম শুরুতেই টু দি পয়েন্ট আনসার। ওদিক থেকে বউ বলছে- জলে কি একটু নুন চিনি দেবো?
- আহ বকিও না যা পারো দাও
- মরণ, খাতা দেখছে তো না যেন সিয়াচেনে যুদ্ধ করছে
ওদিকে ছাত্র লিখছে- পলাশীর যুদ্ধের আগের দিন ক্লাইভ সিরাজের বাড়ি গেছে, দরজায় আওয়াজ করেছে- ঠক ঠক, সিরাজের বউ দরজা খুললো
এটুকু পড়েই ভাবলাম- যাহ কলা! এটা কি লিখলো! এরম তো শালা আমি পড়িনি আগে। ওদিক থেকে বউ বলছে- জলে কি একটু লেবু দেবো? আমি জবাব না দিয়েই ছাত্রের লেখা পড়ে চলেছি-
'দরজা খোলার পর সিরাজের বউ বললো- কে দাদা আপনি? ক্লাইভ বলে- হামি ক্লাইভ আছি। এটা শুনে সিরাজের বেগম বলে- ও মরণ আপনিই সেই ক্লাইভ! আপনার সাথে ঝামেলা করে করেই আমার বরের রাতে ঘুম নেই। আমি আর পারি না। এবার মরেই যাবো। আপনার কাছে বিষ হবে বিষ?'
ওদিক থেকে বউ আবার বলে- কিগো, দেবো একটু লেবু?
আমি খাতা দেখতে দেখতে বলে উঠি- ধুর, বিষ হবে বিষ?
বউ বলে ওঠে- মরণ, খাতা তো দেখছে না, যেন রাজকার্য করছে!
আমি পড়ে চলি- 'ক্লাইভ সিরাজের বেগমকে বলে - বিষ খুব খারাপ চিজ আছে ভাবিজি, বিষের চেয়ে উন্য জিনিষে কাম দেয় বেশি, ঠুমি আমার সাথে পালিয়ে এসো, নেটিভ সিরাজ কুনো কাজের না আছে, হামি ওকে যুদ্ধে হারিয়ে দিবো',
পড়ছি আর পড়তে পড়তে ঘাম দিচ্ছে, ভাবছি মাথা গরম করলে চলবে না। ওদিক থেকে আমার বউ বলে যাচ্ছে- আহা লেখা পড়তে পড়তে ঘামছো কেন, পাখাটা চালাই? জলটা দিয়ে রেখেছি লেবু চিনি দিয়ে খাও এবার।
ওদিকে আমার ছাত্রের লেখা ইতিহাসের নামে রোমান্টিক থ্রিলার পড়তে গিয়ে নাজেহাল অবস্থা। নিজে যা ইতিহাস পড়েছি ভুলে গেছি শুধু না, ছাত্রটির বয়ানে চরিত্রগুলোর কি পরিনতি হবে, এই চিন্তায় মনটা চঞ্চল হয়ে উঠেছে। জলের কথা ভুলে গিয়ে পড়ে চলেছি:
'সিরাজের বউ ক্লাইভকে এরপর বললো- না সাহেব, আমার বরকে হারানো তোমার দ্বারা হবে নাকো। ও হেবি বদমাশ আছে, আগে থেকে সব বুঝে গেলে আমরা ধরা পড়ে যাবো।
ক্লাইভ: আরে ও ঠুমি হামার উপর ছেড়ে দাও ভাবিজি, ঠুমি শুধু বলো ঠুমি হামাকে বিয়া করবে কিনা, সিরাজকে টপকাবার জন্য আমি অন্য প্ল্যান করছি, মীরজাফর আছে, ও হামাদের হেল্প করে দেবে, ঠুমি আজ রাতে ছদ্মবেশ নিয়ে প্রাসাদের বাইরে ওয়েট করবে। আমি ঠোমাকে এসে তুলে নিয়ে যাবো
সিরাজের বৌ: সত্যি সাহেব তুমি আসবে তো?
ক্লাইভ: ভদ্দরলোকের এক কথা আছে বেগমজান। ঠুমি শুধু কুনোরকমে বাইরেটা এসো। বাকি হামি বুঝে লেবো
সিরাজের বউ: আচ্ছা। তাই হবে।'
এই অবধি পড়ে প্রায় ঘেমে উঠেছি, বউ কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়ালই নেই। খাতায় চোখ রেখে দেখি লেখা আছে-
'অবশেষে কি হলো? সিরাজের বৌ কি পারলো রাতের অন্ধকারে সিরাজকে লুকিয়ে বেরিয়ে আসতে? ক্লাইভ কি ওকে নিতে এলো? এরপর ওদের দুজনের প্রেমের পরিনতি জানতে চোখ রাখুন পরবর্তী পার্ট 'বক্সারের যুদ্ধ: ওয়ান ম্যান আর্মি' তে। টু বি কনটিনিউড....'
বউ বলে উঠলো- কিগো, জলটা তো খেলেই না..
আমি 'ধুত্তোর' বলে জলের গ্লাসের সবটা জল বউ এর মাথায় ঢেলে দিলাম।
তারপর কি ঘটলো আমার সাথে, সেটা এখানে বড় কথা না, শুধু এটাই অনুভব করলাম- বউ এর সাথে ঝগড়া করে পরীক্ষার খাতা দেখার সময় মাথা ঠান্ডা রাখা কঠিন। কিন্তু পরীক্ষার খাতা দেখতে দেখতে বউ এর কাছে মাথা ঠান্ডা রাখা আরও বেশি কঠিন।
(পুরোনো লেখা)
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই নভেম্বর, ২০২২ রাত ১১:৪৭
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×