গতকাল রাতে… না, বিবেক নয়; হৃদয় আমার স্বপ্নহীন নির্ঘুম এক রাতে, নিজের ভুবনেই যেন ফিরিয়ে নিয়ে গেল। প্রায়ই ইনসমনিয়া আক্রান্ত এই আমি শেষ রাত পর্যন্ত জেগে থাকি। গতকাল রাতটি ছিল এমনই এক রাত। মোবাইলে সোশ্যাল নেটওয়ার্ক এ ঘোরাঘুরি আর নানান গেমস খেলে যখন নিউরন এর গুদামঘরখানি ক্লান্ত; কিন্তু চোখ এর দরজা বন্ধ হতে নারাজ; তখন কি মনে করে সামুর আঙ্গিনায় ঢুঁ মেরে নিজের পুরানো লেখাগুলো পড়তে চাইলাম। স্ক্রল করতে করতে হঠাৎ থামলাম নিজের লেখা একটি গল্প ব্যাড বেঞ্চারস এ। ২০১৫ সালে লেখা এই গল্পটি আমার নিজের দেখা সকল ব্যাড বেঞ্চারস বন্ধুদের নানান ঘটনাক্রম এর স্মৃতি হাতরে একত্রিত করে লেখা কাল্পনিক এক ছোট গল্প। কিন্তু গল্পটি পড়তে গিয়ে মনে হলে গল্পের প্রতিটি চরিত্রই বুঝি আমার কথাই বলছে। সুবল, মিজান, জাহিদ আর দিদার যেন জীবন্ত হয়ে আমার অন্ধকার ঘরের মাঝে পায়চারি করতে লাগলো। এক সময় ভেবে অবাক হলাম; এই গল্পটি আমার লেখা! হ্যাঁ, এই ভালো লাগার অনুভূতি পাওয়ার কথা ভেবেই কিন্তু আমার ব্লগে লেখালেখি করা। মূলত, আমি ব্লগে লিখেছি, নিজের জন্য সবসময়। আগত দিনে নিজের লেখাগুলো পড়ে নস্টালজিক হব, হব আবেগী এই আশাতেই কিন্তু লেখা। আর এই কারনেই হয়ত বাস্তব জীবনে প্রচন্ড সংবেদনশীল এই আমি, ব্লগে কখনো কোন বিষয়ে কোন লেখাতেই কখনো সংবেদনশীল আচরণ এর ধারে কাছে ছিলাম না। নো ক্যাচাল, নো বিতর্ক, এক সাতপাঁচে না থাকা নিপাট ভদ্র ছেলে হয়েই কেটে গেল ব্লগীয় জীবন। ঠিক যেন ক্লাসের ফ্রন্ট বেঞ্চের সুবোধ বালকটি। নিজের জন্য লিখি বলেই হয়তো আমার লেখার ভালমন্দ দিক নিয়ে আমার তেমন মাথা ব্যাথা থাকে না। লিখতে মন চায় লিখে যাই, যদিও লিখি না অনেকদিন। তো গতরাতে মনে হল আজ সামুতে কিছু একটা লিখতে হবে। মজার ব্যাপার আজ সামুতে ঢুকে লগইন করতেই বাম দিকে চোখ গেল, দেখি লেখাঃ “ব্লগ লিখেছিঃ ৮ বছর ২ দিন”!!!
মনে হল, এই তো সেইদিন, এক বন্ধু আমার ব্লগস্পট সাইট দেখে পরামর্শ দিল সামহোয়্যার ইন ব্লগে লেখার জন্য। ১৩ ই জানুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৩:০৫ মিনিটে প্রথম পোস্ট করা সামু ব্লগে। তারপর ২০১৬ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত নিয়মিত লেখালেখি করেছি সামু ব্লগে। ২০১৩-১৪ সালের দিকে তো অফিসে বসে অফিসের কাজের মাঝে কাজ ফাঁকি দিয়েও ব্লগ লিখেছি । কিভাবে আটটি বছর পার হয়ে গেল…
ভেবেছিলাম নিজের লেখাগুলো ভবিষ্যতে পড়ে নস্টালজিক হওয়ার বিষয়টি নিয়ে আজ কোন পোস্ট লিখবো; কিন্তু এখন লিখতে বসেছি বর্ষপূর্তি পোস্ট! মজার বিষয় বৈকি।
সামু ব্লগে যাত্রা শুরু করতে না করতেই মাস খানেকের মধ্যে শুরু হয়ে গেল শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ হতে রাজাকারদের ফাঁসির আন্দোলন। এর রেশে তখন রাজাকার, ছাগু, ছুপা রাজাকার সন্ধান অভিযান চলছে সামু ব্লগ সহ সারা বাংলা অনলাইন জগতে। তখনই ঘটলো একটি বিশেষ ঘটনা; ২০১৩ সালের পহেলা বৈশাখ এ। পহেলা বৈশাখে ফেসবুক আর ব্লগে লেখা পড়ে দিন কাটাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি প্রথম বাংলা সার্চ ইঞ্জিন “পিপীলিকা” নাকি বিটিআরসি বন্ধ করেছে। তাড়াতাড়ি দেখার ইচ্ছা হল ঘটনা কি? ওয়েব এড্রেস বারে পিপিলিকার ওয়েব এড্রেস দিতে দেখি কোথায় কি? সব গুজব অথবা ফান।
কি সার্চ করব প্রথম বাংলা সার্চ ইঞ্জিনে? দিলাম আমার এই সামু নিকের সার্চ। অনেকগুলো রেজাল্ট এলো। চেক করতে করতে একটা ধাক্কা খেলাম। দেখি প্রায় দুই মাস আগে জনৈক সুখোই-৩৫ নামক ব্লগার একটা পোস্ট দিছেন, লিষ্ট বানানি শুরু করলাম যেখানে সে জামাত-শিবির-ছাগুদের একটা লিস্ট করেছে, তাতে আমার নাম লিংক এড্রেস সহ। আমি হাসবো নাকি কাঁদবো বুঝতে পারলাম না। সে কিসের ভিত্তিতে আমাকে এই লিস্টে নিল খোদাই জানে। তার পোস্টে সাথে সাথে কমেন্ট দিলাম কারন জানতে, কিন্তু এত পুরানো লেখায় কেই বা রিপ্লাই দেয়? যাই হোক শকড হলাম এই ভেবে যে ব্লগের বিশাল পোস্টের সমুদ্রে কে কোথায় আমাকে আপনাকে কোন লিস্টে ফেলছে, কোন অপবাদ দিচ্ছে, কোন বিপদে ফেলছে আমরা কি তা জানতে পারছি?
সেই ঘটনার জেরেই কি না জানি না; এরপর কেন যেন সমসাময়িক বিষয় বা রাজনৈতিক মতাদর্শ, অথবা কোন সামাজিক বা ধর্মীয় দর্শন নিয়ে লেখার আগ্রহটাই হারিয়ে ফেললাম। শুরু হল আমার পছন্দের বিষয় ভ্রমণ নিয়ে লেখালেখি। প্রথম বছরেই সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে বর্ষপূর্তিতে শততম পোস্ট করেছিলামঃ বর্ষ শেষের ঝরা পাতা (বর্ষপূর্তিতে শততম পোস্ট)
এই গতি এগিয়ে চলল পরের বছরও, পরের বছর পোস্ট করা হল প্রায় ১১৭টি পোস্ট। তারপরের বছর আরও ১০৯ টি পোস্ট। ভালমন্দ যেমনই হোক না কেন, তিন বছরে প্রায় ৩২৫টি পোস্ট নিয়ে খুব ব্যস্ত সময় কাটিয়েছি সামুর আঙ্গিনায়। ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল! কখনো ভাবতে হয় নাই কি লিখছি, কেন লিখছি, পাঠক বা সহব্লগারদের কাছ থেকে কি ধরনের ফিডব্যাক পাচ্ছি। এরপর ২০১৬ সালে এসে ধীরে ধীরে আমার ব্যস্ততা নাকি আগ্রহ হারিয়ে ফেলা জানি না, ব্লগে সময় দেয়াই কমে গেল। ২০১৬ সালে প্রায় অর্ধেকে নেমে এল আমার পোস্ট সংখ্যা, ৫০+ পোস্ট। এর পরে ২০১৭ সালে ২০টি পোস্ট ২০১৮ সালে ১৫টি, ২০১৯ এ এসে ১৩টি, আর গত বছর মাত্র ৩টি। প্রশ্ন কেন এমন হল? আমার ব্যক্তিগত সমস্যা হল, আমি কোন কিছু থেকে দূরে সরে যেতে থাকলে এমন করেই বহু দূরে সরে যেতে থাকি। কিন্তু এবছর আমার নিজের জন্য নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা, আমাকে ব্লগে লিখতে হবে, আরও হাজারো পোস্ট, নতুন উদ্যমে। কেবল ভারত ভ্রমণ নিয়েই আমার প্রায় শ দুয়েক লেখা এখনই লেখা উচিত। কেননা, পেছনের লেখাগুলো আমার নিজের জন্যই আগামীর অনেক বড় প্রেরণা, সম্পদ। পুরোনো লেখাগুলো যখনই পড়তে যাই, হাজারো স্মৃতির দরজা হুট করে খুলে যায়। তাই লিখতে হবে নিজের জন্য, আরও অনেক বেশী।
নিজের লেখাগুলোকে আমি ব্লগের সার্বিক লেখনী এবং এক্টিভিটির উপর ভিত্তি করে নিজেকে ১০ এ ৪/৫ এর বেশী মার্কস দিতে পারছি না। কিন্তু নিজের জন্য বিবেচনায় আমি আমাকে ১০ এ অন্তত ৮/৯ দিতে চাই। আমার মূল দূর্বলতা আমি একটা লেখাকে বেশী সময় দিয়ে লিখতে পারি না,ঘষামাজা করতে পারি না। তা সে গল্প, কবিতা, ফিচার বা ভ্রমণ কাহিনী হোক না কেন। আগামীতে হয়তো কোন একদিন এই দূর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারবো আশা করি।
আরেকটি কথা, ব্লগে ভালো লেখা আর পাওয়া যায় না বলে হা হুতাশ দেখা যায় সব সময়ই। আট বছর আগে যখন সামুতে যাত্রা শুরু তখনো শুনেছি; এখনও শুনতে পাই। আসলে সব হচ্ছে পরিবেশ। আমি কখনই গল্পকার ছিলাম না। কিন্তু ২০১৩-২০১৪ সালের দিকে সিনিয়র ব্লগারদের মাসিক গল্প সংকলনের উৎসাহে; আমার মত অধমও গল্প লিখতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। আর সেই সূত্রেই প্রায় ২৫ পর্বের বিশাল কলেবরে রন্তুর কালো আকাশ নামক ধারাবাহিক উপন্যাস লেখার সাহস করেছিলাম। খুব ইচ্ছে ছিল রন্তুকে নিয়ে ট্রিলজি লেখার। পরের দুই খন্ডর নামও ভেবে রেখেছিলামঃ “রন্তুর দিনরাত্রি” এবং “রন্তুর পথচলা”… ইচ্ছে ছিল, লেখা হয় নাই। যদি বেঁচে থাকি লিখবো কোন একদিন নিশ্চিত। তো যে কথায় ছিলাম, নিজে এক সময় ভ্রমণের ভালবাসায় “মাসিক ভ্রমণ সংকলন” করেছি নিয়মিত প্রায় দুই বছরের বেশী সময় ধরে। তখন ভ্রমণ বিষয়ক লেখাও পেয়েছি প্রচুর। তাহলে, মূল বক্তব্য হচ্ছে পরিবেশ এবং উদ্যোগ। ব্লগে কেউ একজন উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসলে এবং সহব্লগাররা সহযোগীতা করলে ভাল লেখা ব্লগে পাওয়া যাবেই বলে বিশ্বাস করি। মডু ভাইয়া ফেসবুক পেইজ দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছেন; কিন্তু ব্লগের সলুশন ব্লগেই আছে; ফেসবুকে পাওয়া যাবে না। ফেসবুকিয় লেখিয়ে আর ব্লগার কখনো এক হবে না। ব্লগে কেউ জনপ্রিয়তার জন্য লেখে না (বেশীরভাগ এর জন্যই প্রযোজ্য; কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া); লেখে ভালবাসা থেকে। আর ফেসবুকে বেশীর ভাগই সময়ের স্রোতে ভেসে চলা। তাই ব্লগে ব্লগারদের সময় দিতে হবে; ভিন্ন ভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখতে হবে। তবে, গত আট বছরের অভিজ্ঞতায় দেখেছি; ব্লগে পিঠ চাপড়া চাপড়ি’র কিছুটা সঙ্গদোষ আছে। এই প্রবণতার কারনে অনেক ভাল লেখা তেমন পাঠক বা মন্তব্য এবং অন্যান্য মিথস্ক্রিয়া লাভে মুখ থুবড়ে পড়ে। এতে অনেক সময় লেখক তার উৎসাহের জায়গাটি হারিয়ে ফেলে।
অনেকদিন পর ব্লগে এসে অনেক কথা বলে ফেললাম এই বোকা মানুষটি। আজকের দিনে অনেক অনেক সহব্লগারদের নাম মনে পড়েছে; ভদ্রতা থেকে নয়; ভালবাসা থেকে আবারও তাদের স্মরণ করতে চাই। নামের লিস্ট করতে হবে…
প্রথম পোস্টঃ দায়ী নিউটনের ৩য় সুত্র
প্রথম ভ্রমণ পোস্টঃ জোছনায় সুন্দরবনঃ নৈসর্গিক......অপার্থিব......
উল্লেখযোগ্য কিছু সিরিজ লেখাঃ
SOMEWHEREINBLOG’S ব্লগারস ট্রাভেলিং ডায়েরী
বাংলার জমিদার বাড়ী
কম খরচে ভারত ঘোরাঘুরি
মহারাণী
গানগল্প
Never Underestimate Anybody: জীবন থেকে নেয়া একগুচ্ছ প্রেরণার গল্প
ভ্রমণ সাহিত্যে চোখ বুলাই
সব শেষে বলতে চাই, “বোকারা ভাবে তারা চালাক, চালাকরা ভাবে তারা চালাক। আসলে সবাই বোকা। বোকার রাজ্যে আমাদের বসবাস।“ এই কথাটুকু আমার প্রোফাইলে লেখা ছিল একসময়। কিন্তু “বোকা মানুষের কথায় কিই বা আসে যায়”? সবাই ভাল থাকুন সবসময়, প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ। শুভকামনা নিরন্তর।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জানুয়ারি, ২০২১ রাত ১:৪৮