somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নাগরপুর জমিদার বাড়ি - টাঙ্গাইল (বাংলার জমিদার বাড়ী - পর্ব ২২)

২৬ শে অক্টোবর, ২০২৩ দুপুর ১২:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



টাঙ্গাইল জেলাস্থ নাগরপুরকে নাগরপুর থানা ঘোষণা করা হয় ১৯০৬ সালে এবং উপজেলা ঘোষণা করা হয় ১৯৮৩ সালে। এই নাগরপুরের পূর্বে ধলেশ্বরী এবং পশ্চিম পাশ ঘেঁষে বয়ে গেছে যমুনা নদী; আর এই কারণে নদীপথে নাগরপুর এলাকার সাথে সরাসরি কলকাতার দৈনন্দিন ব্যবসায়িক কাজে যোগাযোগ ছিল। যার ফলস্বরূপ ঊনবিংশ শতাব্দীতে নদী তীরবর্তী এলাকা হওয়ার কারণে নাগরপুরে গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন ধরণের ব্যবসা কেন্দ্র। যার ফলশ্রুতিতে নাগরপুরের সাথে রাজধানী কলকাতার একটি বাণিজ্যিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। ঠিক সেই সময়ে সুবিদ্ধা খাঁ এর হাত ধরে নাগরপুরের বিখ্যাত ‘চৌধুরী’ বংশের আর্বিভাব ঘটে। এই চৌধুরী বংশের প্রথম পুরুষ ছিলেন যদুনাথ চৌধুরী যিনি প্রায় ৫৪ একর জমির উপর জমিদারী প্রতিষ্ঠা করেন। এই যদুনাথ চৌধুরীর ছিলো তিন ছেলেঃ উপেন্দ্র মোহন চৌধুরী, জগদীন্দ্র মোহন চৌধুরী, শশাঙ্ক মোহন চৌধুরী। বৃটিশ সরকার এর সময়কালে এই তিন ছেলের মধ্যে উপেন্দ্র মোহন চৌধুরীর বড় ছেলে সতীশ চন্দ্র রায় চৌধুরী সাধারণ জনগোষ্ঠীর জন্যে বিভিন্ন মুখীন সেবামূলক কাজ করে আলোচিত হন এবং পুরস্কার স্বরূপ বৃটিশ সরকার তাকে রায় বাহাদুর খেতাবে ভূষিত করে। এই উপেন্দ্র মোহন চৌধুরীর ছোট ছেলে সুরেশ চন্দ্র রায় চৌধুরী ছিলেন অপেক্ষাকৃত পাশ্চাত্য সংস্কৃতিঘেষা, সৌখিন প্রকৃতির মানুষ এবং ভীষণ ক্রীড়ামোদী। উপ-মহাদেশের বিখ্যাত ফুটবল দল ইষ্ট বেঙ্গল ক্লাবের তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারী। তার হাত ধরেই নাগরপুর জমিদার বাড়ী পূর্ণতা পায় নান্দনিক নির্মানশৈলী আর পরিমিত সৌন্দর্য্যবোধ এর মিশেলে।





সুরেশ চৌধুরীকে নাগরপুরে রেখে সম্পূর্ণ রাজধানী কলকাতার আদলে নাগরপুরকে সাজানোর পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। পাশ্চত্য এবং মোঘল সংস্কৃতির মিশ্রনে এক অপূর্ব নান্দনিক সৌন্দর্যে নির্মিত এই বৈঠকখানা বিল্ডিং এর উপরে ছিল নহবতখানা। সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়া প্রতিদিন ভোর সকালে সানাই-এর ভৈরবী ধ্বনীতে চৌধুরী বংশের তথা এলাকার প্রজাবৃন্দের ঘুম ভাঙ্গত। চৌধুরী বাড়ীর রঙ্গমহলের পাশে এক সুদৃশ্য চিড়িয়াখানা ছিল। সেখানে শোভা পেত- ময়ূর, কাকাতোয়া, হরিণ, ময়না আর শেষ দিকে সৌখিন সুরেশ চৌধুরীর ইচ্ছায় চিড়িয়াখানায় স্থান করে নিল বাঘ (কেতকী) এবং সিংহ(দ্যুতি)।






এর বাইরে এই চৌধুরী বাড়ীতে ছিলো একটা ঝুলন দালান। প্রাচীন ভারতে বিভিন্ন শিল্প কর্মে মন্ডিত চৌধুরী বংশের নিত্যদিনের পূজা অনুষ্ঠান হত এই ঝুলন দালানে। বিশেষ করে বছরে শ্রাবনের জ্যোৎস্না তিথিতে সেখানে ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের নাটক, যাত্রা মঞ্চায়িত হত। এখানেই চৌধুরী বংশের শেষ প্রতিনিধি মিলন দেবী (মিলন কর্ত্রী) স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে চৌধুরীদের উপাসনা বিগ্রহ ‘‘বৃন্দাবন বিগ্রহ’’ -এর নিরাপত্তা দিতে গিয়ে দুষ্কৃতকারীদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন। এছাড়া ছিলো ঘোড়ার দালান, জমিদারী পরিচালনা এবং বাবসায়িক প্রয়োজনে চৌধুরীবাড়ীতে সুঠাম সুদৃশ্য ঘোড়া পোষা হত। আর এই ঘোড়া এবং তার তদারকীতে নিয়োজিতদের থাকার জন্য নির্মাণ করা হয় শৈল্পিক কারুকাজ খচিত এই স্থাপনা। যা জমিদারদের ঘোড়ার দালান হিসাবে পরিচিত।




১৯৪৭ এর দেশ বিভক্তির পর একসময় তদানিন্তন সরকার চৌধুরী বাড়ীর সকল সম্পদ অধিগ্রহণ করে। অট্টালিকাটির অভ্যন্তরের পুরো কাজটি সুদৃশ্য শ্বেত পাথরে গড়া। বর্তমানে চৌধুরী বাড়ীর এই মুল ভবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নাগরপুর মহিলা ডিগ্রী কলেজ।





গত সেপ্টেম্বরের প্রথম শুক্রবার ভ্রমণ বন্ধু আবার ছোট ভাইও বলা যায়, আনজামুল হক আকাশ আর আমি তার গাড়ী নিয়ে বের হয়েছিলাম সারাদিনের জন্য টাঙ্গাইলের পথ ধরে। সারাদিনে নানান প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা আর প্রাকৃতিক নৈসর্গিক সৌন্দর্যের মাঝে চমৎকার সারাটি দিন কাটিয়েছিলাম। আর সেদিনের সেই যাত্রায় গিয়েছিলাম এই নাগরপুর জমিদার বাড়ী দেখতে। ছুটির দিন হওয়া স্বত্বেও মূল ভবন যেখানে এখন কলেজ সেখানে প্রবেশ করতে পারি নাই কারন কোন একটা সরকারী চাকুরী বা এই জাতীয় পরীক্ষা চলছিলো তখন। মূল ভবনের পেছনে থাকা আদি স্থাপনার অনেকগুলো ভগ্নাবশেষ দেখতে পেলাম। সেগুলোর পাশে নতুন ভবন তৈরী করা হচ্ছে কলেজ এর জন্য, তখন মূল জমিদার বাড়ী থেকে কলেজ সরিয়ে পেছনে নিয়ে যাওয়া হবে। হয়তো তখন সংস্কার করে এই জমিদার বাড়ী হেরিটেজ স্থাপনা হিসেবে সংরক্ষণ করা হবে।





জমিদার বাড়ি নিয়ে ধারাবাহিক লেখা শুরু করার পর এই বিষয় নিয়ে অল্পবিস্তর ঘাঁটাঘাঁটি করে দুঃখ হয়, কিভাবে অবহেলায় এসব নিদর্শন হারিয়ে যাচ্ছে। উন্নতবিশ্বে যে সকল স্থাপনা হেরিটেজ হিসেবে সংরক্ষিত হয়, আমাদের দেশে সেইসকল স্থাপনা পড়ে থাকে অবহেলায়, ক্ষয়ে যায় অস্থি-মজ্জা সকল, ঘুণে ধরে বিচূর্ণ হয় ইতিহাসের পাতা। অপূর্ব সকল স্থাপনা আর নির্মাণশৈলী নিয়ে আমাদের বাংলাদেশের আনাচে কানাচেতে পড়ে আছে অসংখ্য জমিদার বাড়ি, রাজবাড়ীসহ আরও কত স্থাপনা। আর এই সব স্থাপনার কিছু কথা এই বোকা মানুষটার ছেঁড়া খাতায় লিখে রাখার প্রয়াস হল এই “বাংলার জমিদার বাড়ী” সিরিজ।



"বাংলার জমিদার বাড়ী" সিরিজের আগের পোস্টগুলোঃ

বালিয়াটি জমিদার বাড়ি - (বাংলার জমিদার বাড়ী - পর্ব ০১)
পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি -বাংলার জমিদার বাড়ী - পর্ব ০২)
মহেড়া জমিদার বাড়ি - (বাংলার জমিদার বাড়ী - পর্ব ০৩)
লাখুটিয়া জমিদার বাড়ি - (বাংলার জমিদার বাড়ী - পর্ব ০৪)
দুবলহাটি জমিদার বাড়ি - (বাংলার জমিদার বাড়ী - পর্ব ০৫)
ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর রাজবাড়ি - (বাংলার জমিদার বাড়ী - পর্ব ০৬ )
তেওতা জমিদার বাড়ী - (বাংলার জমিদার বাড়ী - পর্ব ০৭)
দালাল বাজার জমিদার বাড়ী - (বাংলার জমিদার বাড়ী - পর্ব ০৮ )
দত্তপাড়া জমিদার বাড়ীর খোঁজে - (বাংলার জমিদার বাড়ী - পর্ব ০৯ )
ভৌতিক সন্ধ্যায় কামানখোলা জমিদার বাড়ী প্রাঙ্গনে - (বাংলার জমিদার বাড়ী - পর্ব ১০ )
কালের সাক্ষী - শ্রীফলতলী জমিদার বাড়ী (বাংলার জমিদার বাড়ী - পর্ব ১১)
খুঁজে পেলাম 'ইসহাক জমিদার বাড়ী' - (বাংলার জমিদার বাড়ী - পর্ব ১২)
বলিয়াদি জমিদার বাড়ী - চারশত বছরের ইতিহাস (বাংলার জমিদার বাড়ী - পর্ব ১৩)
ভুলে যাওয়ার পথে কাশিমপুর জমিদার বাড়ী - (বাংলার জমিদার বাড়ী - পর্ব ১৪)
করটিয়া জমিদার বাড়ী (টাঙ্গাইল) (বাংলার জমিদার বাড়ী - পর্ব ১৫)
কোকিলপেয়ারী জমিদার বাড়ির খোঁজে (বাংলার জমিদার বাড়ি - পর্ব ১৬)
মুরাপাড়া জমিদার বাড়ীর আঙ্গিনায় (বাংলার জমিদার বাড়ি - পর্ব ১৭)
"ভাগ্যকুল জমিদার বাড়ী" যেখানে যেতে যেতে রাত হয়ে যায় ;) (বাংলার জমিদার বাড়ী - পর্ব ১৮)
হাবড়া জমিদার বাড়ী - (বাংলার জমিদার বাড়ী - পর্ব ১৯)
ঘুঘুডাঙ্গা জমিদার বাড়ী - (বাংলার জমিদার বাড়ী - পর্ব ২০)
সদাসদী জমিদার বাড়ী - গোপালদী, আড়াইহাজার, নারায়ণগঞ্জ (বাংলার জমিদার বাড়ী - পর্ব ২১)
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে অক্টোবর, ২০২৩ দুপুর ১২:১৬
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শোকের উচ্চারণ।

লিখেছেন মনিরা সুলতানা, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ সকাল ১০:১৬

নিত্যদিনের জেগে উঠা ঢাকা - সমস্তরাত ভারী যানবাহন টানা কিছুটা ক্লান্ত রাজপথ, ফজরের আজান, বসবাস অযোগ্য শহরের তকমা পাওয়া প্রতিদিনের ভোর। এই শ্রাবণেও ময়লা ভেপে উঠা দুর্গন্ধ নিয়ে জেগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

যা হচ্ছে বা হলো তা কি উপকারে লাগলো?

লিখেছেন রানার ব্লগ, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ দুপুর ১:২৮

৫ হাজার মৃত্যু গুজব ছড়াচ্ছে কারা?

মানুষ মারা গিয়েছে বলা ভুল হবে হত্যা করা হয়েছে। করলো কারা? দেশে এখন দুই পক্ষ! একে অপর কে দোষ দিচ্ছে! কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

আন্দোলনের নামে উগ্রতা কাম্য নয় | সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যবাদকে না বলুন

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ বিকাল ৫:২৭



প্রথমেই বলে নেয়া প্রয়োজন "বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার সমস্ত অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে" ধীরে ধীরে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসছে। ছাত্রদের কোটা আন্দোলনের উপর ভর করে বা ছাত্রদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

কোন প্রশ্নের কি উত্তর? আপনাদের মতামত।

লিখেছেন নয়া পাঠক, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৬

এখানে মাত্র ৫টি প্রশ্ন রয়েছে আপনাদের নিকট। আপনারা মানে যত মুক্তিযোদ্ধা বা অতিজ্ঞানী, অতিবুদ্ধিমান ব্লগার রয়েছেন এই ব্লগে প্রশ্নটা তাদের নিকট-ই, যদি তারা এর উত্তর না দিতে পারেন, তবে সাধারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাকুরী সৃষ্টির ব্যাপারে আমাদের সরকার-প্রধানরা শুরু থেকেই অজ্ঞ ছিলেন

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ রাত ৯:০৭



আমার বাবা চাষী ছিলেন; তখন(১৯৫৭-১৯৬৪ সাল ) চাষ করা খুবই কষ্টকর পেশা ছিলো; আমাদের এলাকাটি চট্টগ্রাম অন্চলের মাঝে মোটামুটি একটু নীচু এলাকা, বর্ষায় পানি জমে থাকতো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×