somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মুক্তিযোদ্ধে চা-শ্রমিক

০৯ ই জুলাই, ২০০৭ বিকাল ৩:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাঙ্গালী জাতির ইতিহাসের এক গৌরবময় অধ্যায় আমাদের মুক্তিযোদ্ধ। সে যুদ্ধে চা-শ্রমিকদের অবদানও কম নয়। অনেক চা-শ্রমিক অংশ গ্রহণ করেছিলেন যোদ্ধে। সম্মুখ যোদ্ধে অংশ নিয়ে অনেকেই জীবন উৎসর্গ করেছিলেন মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করার জন্য।

যোদ্ধে পাকহানাদার বাহিনীর হাতে অনেক চা-শ্রমিক শহীদ হয়েছিলেন। কিন্তু ইতিহাসে তাদের কোন স্থান হয়নি। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের ভয়াল রাতে বাঙ্গালিদের মতো চা-শ্রমিক জনগোষ্ঠীর উপরও শুরু হলো পাকিস্থানী হানাদার বাহিনীর নির্মম আক্রমণ। সারা দিনের কাজ শেষে গভীর নিদ্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিল চা-শ্রমিকরা। তাদের নিকট কোন অস্ত্র ছিল না। চা-শ্রমিকরা প্রস্তুতও ছিল না এসবের জন্য। কামান, মেশিন গান, ট্যাংকসহ ভারী অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে ঘুমন্ত চা শ্রমিকদের উপর বরবর হামলা চালায় পাক বাহিনী।

সেদিন শত শত নিরস্ত্র চা শ্রমিকদের হত্যা করেছিল পাক সেনারা। তাদের গুলার আগুনে অনেক চা শ্রমিকের ঘর বাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। মায়ের কোলের ছোট্ট শিশু থেকে আবাল বৃদ্ধা বনীতা কেউই সেদিন রা পায়নি পাক হানাদার বাহিনীর হাত থেকে। যা গণহত্যা নামে পরিচিত। তবুও বাঙ্গালি জাতীকে দমানো গেল না। শুরু হলো মুক্তির আন্দোলন। ‘মুক্তিযোদ্ধ’। চা শ্রমিকরাও মুক্তিযোদ্ধে অংশ গ্রহণ করলো সাহসীকতার সাথে। শ্রীমঙ্গল থানার বিভিন্ন বাগানের চা-শ্রমিকরা ভারতের অম্পি নগর ও লোহাবন্দ ৩ এবং ৪ নং সেক্টরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিভিন্ন প্রশিণ কোর্সে ট্রেনিং নেন। ট্রেনিং শেষে মেজর সি আর দত্তের নেতৃত্বে চা শ্রমিকরা মুক্তিযোদ্ধে সম্মুখ সমরে অংশগ্রহণ করেন। বিভিন্ন তথ্য সূত্রে জানা যায়, শ্রীমঙ্গল থানার বিভিন্ন চা বাগানের প্রায় শতাধিক চা-শ্রমিক মুক্তিযোদ্ধে সম্মুখ ভাগে অংশ গ্রহণ করেছিলেন।


রণাঙ্গনে শহীদ হন অনেক চা শ্রমিক মুক্তিযোদ্ধা। ফুশকুরি চা বাগানের বীর মুক্তিযোদ্ধা শম্ভূ সিংহ ভূমিজ মেঘালয় সীমান্তে ক্যাপ্টেন শওকত আলীর অধীনে যুদ্ধ করে প্রায় ৩০ জন পাক সেনাকে হত্যা করেছিলেন। দেশকে শত্রু মুক্ত করার জন্য রাজঘাট চা বাগান, ভাড়াউড়া চা বাগান, সিন্দুরখান চা বাগান, ফুশকুরি চা বাগান, কেজুরীছড়া চা বাগান, বর্মাছড়া চা বাগান, হরিণ ছড়া চা বাগান, উদনা ছড়া চা বাগান, টিপরা ছড়া চা বাগান, শিশেল বাড়ি চা বাগানসহ আরো অনেক চা বাগানের চা শ্রমিকরা মুক্তিযোদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন।

বাঙ্গালির অবিস্মরণীয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে দেশের বীর বাঙ্গালিদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ ভাবে চা শ্রমিকরাও মুক্তিযোদ্ধে অংশ নেয়। এই যোদ্ধে চা শ্রমিকদের অনেক বদ্ধ ভূমি রচিত হয়; লুন্ঠিত হয় অনেক মা বোনের ইজ্জত। চা শ্রমিকরা হারিয়েছিল চা সমাজের অসংখ্য সংগ্রামী ও যোগ্য নেতৃবৃন্দকে। ১৯৭১ সালের ১লা মে ভাড়াউড়া চা বাগানের প্রবেশ মুখে একটি ছড়ার পাড়ে একসাথে ঝড়ে পড়ে ৫৭ জন চা শ্রমিকের তাজা প্রাণ। সেদিন ছিল শুক্রবার। বেলা প্রায় সাড়ে ১২ টার দিকে পাক হানাদার বাহিনীর ১২টি এল এম জি এক সাথে গর্জে উঠেছিল সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা চা শ্রমিকদের উপর।

সেই দিন পাকহানাদার বাহিনীর গুলিতে শহীদ হয়েছিলেন বিশ্বময় হাজরা, গংগা বাড়ৈ, ভোমর চাঁদ, অমৃত হাজরা, রাম চরণ গৌড়, গবিনা গৌড়, কৃষ্ণ চরণ হাজরা, রবিনা গৌড়, হক হাজরা, বংশী মৃধা, শিব মোড়া, মোংরা তুড়িয়া সহ নাম না জানা ৫৭ জন চা শ্রমিক। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে সাতগাঁও (মাকরী ছড়া) চা বাগানে আপনা অলমিকসহ আরো ৬/৭ জন চা-শ্রমিককে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে তৎকালীন পাক হানাদার বাহিনী দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করে যখন বুঝতে পেরেছিল পরাজয়ই তাদের সুনিশ্চিত, তখন গোটা বাঙ্গালি জাতীকে পঙ্গু করে দেওয়ার জন্য শুরু হলো বুদ্ধিজীবী হত্যা। সেই নিষ্পেসিত কালো থাবা থেকেও রেহাই পায়নি চা শ্রমিকরা। ২৯/৩০ ডিসেম্বর চা শ্রমিক সমাজের অগ্রনায়ক, নিপীড়িত নির্যাতিত চা শ্রমিকদের জাগ্রত করায় যার ছিল অগ্রনী ভূমিকা, আপোশকামী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে যিনি ছিলেন বিদ্রুহী বীর, সেই পবন কুমার তাঁতীকেও পাক হানাদার বাহিনী ধরে নিয়ে যায়।


চারদিন বন্দী রেখে অমানবিক নির্যাতন চালানো হয় তার ওপর। কালীঘাট চা বাগানের শিব বাড়ী বস্তির দাশি বাড়ী থেকে ধরে নিয়ে যায় তাকে। চা শ্রমিকদের মধ্যে পবন কুমার তাঁতী ছিলেন প্রথম গ্রøাজুয়েট। ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে রাজঘাট চা বাগানে জন্ম গ্রহণ করেন তিনি। ১৯৬২ সালে মদন মোহন কলেজ থেকে ডিগ্রী পাস করে বাগানে চলে আসেন তিনি। ১৯৭১ সালে ৪ ডিসেম্বর ভোরে পাক বাহিনী নির্মম ভাবে হত্যা করে তাকে। শ্রীমঙ্গল শহরের ওয়াপবদা (তৎকালীন) বর্তমান পল্লী বিদুৎ এর নিকটে একটি ছড়ার মধ্যে পবনের লাশ ফেলে রেখে চলে যায় পাক বাহিনী। রাজঘাট চা বাগানের পঞ্চায়েত সভাপতি বসু তাঁতীকেও পাক বাহিনী ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। মুক্তিযোদ্ধে দেশের বীর বাঙ্গালির সঙ্গে চা শ্রমিকরাও যুদ্ধে অংশ নিয়ে দেশকে শত্রু মুক্ত করলেও, স্বাধীনতার ৩৫ বছর পরও চা শ্রমিকরা মুক্ত হতে পাড়েনি অত্যাচার, অবিচার, শাসন ও শোষনের জাতাকল থেকে।

মুক্তিযোদ্ধে অংশ নিয়ে জয়ী হলেও সিন্দুরখান চা বাগানের সুধীর দাশ, রাজঘাট চা বাগানের পবন খড়িয়া ও কেজুরী ছড়া চা বাগানের চন্দ কাটারের মতো বীর মুক্তিযোদ্ধা চা শ্রমিকরা জীবন যোদ্ধে আজ পরাজিত। আজ কেউই তাদের খোঁজ রাখছেন না। ছাত্র জনতার সঙ্গে সেদিন চা শ্রমিকদের রক্তও একই মোহনায় মিলিত হয়ে অর্জিত হয়েছিল আমাদের স্বাধীনতা। জাতি পেয়েছিল লাল সূর্য খচিত পতাকা। শোষনের অবসান ঘটিয়ে একটি সুখী সমৃদ্ধ শালী বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে চা শ্রমিকরা মুক্তিযোদ্ধে অংশ নিয়েছিল।

কিন্তু আজও চা শ্রমিক জনগোষ্ঠীর বঞ্ছনার ইতিহাসের অবসান হয়নি। মুক্তিযোদ্ধে চা শ্রমিকদের আত্মাহুতির প্রায় ৩ যুগে পদার্পন। এই একবীংশ শতাব্দীর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগেও চা শ্রমিকরা রয়ে সেকালেই। আজোও অত্যাচার ও শোষনের চাকায় পিষ্ট চা শ্রমিকদের জীবন। আজ মুক্তিযোদ্ধা চা শ্রমিক ও যোদ্ধাহত চা শ্রমিকদের জীবন যাপন দেখলে মনে হয়, হয়তো ‘জন্মই তাদের আজন্ম পাপ’।


তবুও মুক্তিযোদ্ধের উত্তাল দিনগুলোতে এদেশের আপামর জনতার সঙ্গে চা শ্রমিকরা যে বীরত্বের ও প্রত্যায়ের দৃঢ় মনোবল দেখিয়েছেন তা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে আমাদের সকলের মাঝে।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুলাই, ২০০৭ বিকাল ৩:২৭
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০২



ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×