ওসামা বিন লাদেন নিহত হয়েছেন গত ২ মে পাকিস্তানের আবোতাবাদ শহরে মার্কিন বাহিনীর হামলায়। মৃত্যুর পর তার সৃষ্ট আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন আল কায়েদা ও তার সদস্যদের প্রকাশ্য ও গোপন অসংখ্য ঘটনা ফাঁস হতে থাকে। সময়ের স্রোতে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসতে থাকে আল কায়েদার অভ্যন্তরস্থ কঠোর নিয়ম কানুন ও শাসন পদ্ধতি। কিভাবে ফুঁসলিয়ে কিশোর তরুনদের আল কায়েদার সদস্য বানানো ও তাদেরকে দিয়ে বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালনো হতো সেসব ঘটনার নির্মম ও হৃদয়স্পর্শী চিত্র তুলে ধরছেন বিভিন্ন সংবাদ কর্মীরা। উইকিলিকসের তথ্যেও বেরিয়ে এসেছে আরো ভয়ংকর ঘটনা। স¤প্রতি ফাঁস করা উইকিলিসের তথ্যে জানা যায়, আল কায়েদার সদস্যরা কড়া ডোজের ইনজেকশন নিয়ে যৌন ক্ষমতা নষ্ট করতো। আল কায়েদা কার্যক্রমে স¤পৃক্ত হতে বাধ্য করার জন্য নিরীহ তরুনদেরকে ’সেক্স ব্ল্যাক মেইল’ও করা হতো। জিহাদি কার্যক্রমে বেশী করে মনোানিবেশ করা ও কার্যক্রম জোরে শোরে পরিচালনায় নিজেকে সর্বদা প্রস্তুত রাখা এবং নারী সংসর্গ ও কাম শক্তি বিলোপ করার জন্য আল কায়েদার জঙ্গী সদস্যরা নিয়মিত যৌন ক্ষমতা বিলুপ্তকরন(খোজা করা) ইনজেকশন গ্রহন করতো। ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে ঘনিষ্ট যোগাযোগ ছিল এবং তার সন্ত্রাসী সেলের সিনিয়র সদস্য এমন একজন আল কায়েদা নেতা আবদেল রহিম আল নাসিরি। ২০০২ সালের নভেম্বরে তাকে গ্রেফতার করা হয়। তাকে এতোদিন গুয়ান্তামো বে কারাগারে রাখা হয়েছিল। কারাগারে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র ক্যাম্পে জিঞ্জাসাবাদকালে নাসিরি স¤প্রতি একথা স্বীকার করে। নারী লিপ্সা থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখার জন্য সে অত্যন্ত শক্তিশালী কেমিকেল দিয়ে তৈরী ইনজেকশন নিয়মিত গ্রহন করতো। একজন প্রশ্নকর্তা জানিয়েছেন, গেফতারকৃত ব্যক্তি জিহাদের জন্য এমনই নিবেদিত প্রান ছিল যে যৌন ক্ষমতা যাতে দ্রুত বিলোপ হয় তার জন্য কড়া ডোজের ইনজেকশন সে নিজেতো নিয়মিত নিতোই এবং অন্যদেরকেও তা গ্রহনে পরামর্শ দিত। সাক্ষ্য প্রমান পাওয়া গেছে যে, নারী সংসর্গে সময কাটানোর চেয়ে জিহাদের প্রতি বেশী করে নিবিষ্ট হওয়া ও আরো সময় দেয়ার জন্যই জঙ্গীরা নিজেদের শরীরে যৌন ক্ষমতা বিলুপ্তকরন ইনজেকশন পুশ করতো। উইকিলিকসের বরাত দিয়ে লন্ডনের’ দি টেলিগ্রাফ ’পত্রিকা স¤প্রতি এ খবর প্রকাশ করে। ২০০২ সালে নাসিরিকে আটক করার পর তাকে সিআইএ’র একটি ’ব্ল্যাক সাইট’ কারাগারে রাখা হয়। ২০০০ সালে মার্কিন নৌবাহনীর রনতরী ডেস্ট্রয়ার কোল’এ আত্মঘাতি বোমা হামলায় আল কায়েদার ’সিনিয়ার অপারেটিভ’ অভিযানে নাসিরি অংশগ্রহন করে বলে জানা গেছে। ঐ হামলায় ১৭ মার্কিস সৈন্য নিহত ও কয়েক ডজন আহত হয়। বিন লাদেনের নির্দেশে নাসিরি ২০০২ সালে ফরাসি তেল ট্যাংকার এমভি লিমবার্গ’এ হামলার পরিকল্পনাও করেছিল বলে সে তার স্বীকারোক্তিতে জানায়। এই নাসিরিই ’ওয়াটার বোর্ডিং’ নামে আল কায়েদার একটি ভয়ংকর ডুবুরি দলের অন্যতম সদস্য ছিল। ৩ জন দুর্ধর্ষ ও লড়াকৃ আল কায়েদা সদস্যকে নিয়ে এই দল গঠন করা হয়। আল কায়েদার কার্যক্রম বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে দেয়ার জিহাদি কাজকে পবিত্র ধ্যান জ্ঞান বিবেচনা করেই নাসিরি নিজেকে পুরুষত্বহীন করার জন্য তার পুরুষাঙ্গে কড়া ডোজের ইনজেকশন নিত। গুয়ান্তানামো বে কারাগারে তার এক সহকর্মি অভিযোগ করেছে যে, যৌন ভিডিও দিয়ে তাকে ব্ল্যাক মেইল করা হতো। আব্দাল রহিম আব্দুল রাজা জাঙকো নামে ঐ সহকর্মি তদন্তকারীদেরকে বলেছে ,আল কায়েদায় যোগদানের আগে সে আমিরাতে ইসলামী আইন ও আরবী সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করতো। উইকিলিকসের প্রকাশ করা তথ্য মতে, জাঙকো বলেছে যে প্রিন্স ফয়সাল সুদিদ কাসমী নামে তার এক পরিচিত ব্যক্তি তাকে একদিন কাছাকাছি একটা হোটেলে ডেকে নিয়ে যায়। সে যখন পৌঁছায় হোটেলে তখন নগ্ন নাচ গান হৈ হুল্লোড় বেলেল্লাপনার একেবারে ছড়াছড়ি। সেও ঐ নাচ গানে যোগ দেয়। সে জানায়, কয়েক সপ্তাহ পর কাসমী ঐ হোটেলের নগ্ন নাচ গানের ভিডিও টেপ নিয়ে তার কাছে হাজির হয় এবং তা দেখিয়ে ভয় দেখায় যে তাকে আমিরাতের পক্ষে গুপ্তচরগিরি করতে হবে। নতুবা ভিডিও টেপে ধারন করা তার পর্ন ছবি কোন টিভি ষ্টেশন কিংবা তার পরিবারকে হস্তান্তর করা হবে। জাঙকো অভিযোগ করে যে এভাবে ব্ল্যাক মেইল করার এক পর্যায়ে সে আল কায়েদার কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে আছে ফিলিপিনো সহকর্মীদের ওপর গুপ্তচরবৃত্তি করা এবং তাদেরকে আল কায়েদা কর্মকান্ডে জড়িত করা। আল কায়েদার কাজে পুরোপুরি নিজেকে সম্পৃক্ত করতে ২০০০ সালের প্রথম দিকে আফগানিস্তান পৌঁছার আগ পর্যন্ত সে এই কাজে লিপ্ত ছিল। উল্লেখ্য,বিশ্ব জুড়ে গোয়েন্দা সার্ভিসগুলো বিভিন্ন ঘটনায় মানুষকে ব্ল্যাক মেইল করার জন্য সেক্স কে ব্যবহার করে থাকে। মেডিকেল রিপোর্ট বলছে যে জাঙকোর এখন মানসিক অসুস্থতা দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ভুলে যাওয়া,হতাশা,ব্যক্তিত্ব হীনতা ও আত্মহত্যার প্রবনতা। উল্লেখ্য,গত ১ মে রোববার গভীর রাতে ইসলামাবাদ থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার উত্তরে আব্বোতাবাদ শহরের একটি ভবনে মার্কিন বাহিনীর ৪০ মিনিটের এক হামলায় ওসামা বিন লাদেন নিহত হন। ঐ সময় লাদেন সপরিবারে ভবনের ভেতরে ছিলেন । গোলাগুলির সময় ঘটনাস্থলে আইএসআই-এর সদস্যরাও উপস্থিতি ছিলেন । গোলাগুলি হয় টানা ৪০ মিনিট। এ সময় লাদেনের মাথায় গুলি লাগে। হামলায় লাদেনের এক নারী দেহরক্ষীসহ মারা যায় মোট ৫ জন। এদের মধ্যে লাদেনের এক ছেলে ছিল। ওসামা বিন লাদেনের জন্ম ১৯৫৭ সালে সৌদি আরবের রিয়াদে। তার বাবা মুহাম্মাদ বিন লাদেন ছিলেন ধনবান ব্যক্তি। আবাসন শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। ৫৪ সন্তানর মধ্যে ওসামা বিন লাদেন ছিলেন ১৭তম। ১৯৬৯ সালে এক বিমান দূর্ঘটনায় মুহম্মদ বিন লাদেনের মৃত্যু হয়। এ সময় ওসামার বয়স ছিল মাত্র ১১ বছর। ওই বয়সেই ৮ কোটি ডলার মূল্যের পৈত্রিক সম্পত্তি পান তিনি। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পড়াশোনা করতে জেদ্দায় পাড়ি জমান ওসামা। ওই প্রতিষ্ঠানে মুসলিম ব্রাদারহুেেডর সদস্যরা শিক্ষকতা করতেন। ওসামা তার ১৭ বছর বয়সে সিরিয়ায় তার দুর সম্পর্কের এক বোনকে বিয়ে করেন। এরপর আরো ৪ নারীকে বিয়ে করেন । তার ২৩ জন সন্তান রয়েছে বলে ধারনা করা হচ্ছে। ওসামা বিন লাদেন ও তার আল কায়েদা নেট ওয়ার্কের উথ্বানের পটভুমি হলো আফগানিস্তান । ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত দীর্ঘ এক দশক ধরে চলা সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আফগানদের প্রতিরোধ যুদ্ধই মূলতঃ আল কায়েদার জন্ম দিয়েছে। ঐ সময় আফগান ইসলামী কট্টরপন্থীরা তাদের মাতৃভুমি রক্ষায় একটি ঐক্যবদ্ধ ব্যানারে সমবেত হতে থাকে। মুসলিম জাহানের তরুনরাও সারা বিশ্ব থেকে এসে যোগ দেয় সোভিয়েত বিরোধী জিহাদে। কেউ স্বেচ্ছাসেবী কেউবা যোদ্ধা হিসাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে যুদ্ধে। এসব তরুন মুসলিদের মধ্যে একজনের নাম ছিল ওসামা বিন লাদেন। ২৩ বছর বয়সী ওসামা এসেছিল সউদী আরব থেকে। এক ফিলিস্তিনী ইমাম আব্দুল্লাহ আজ্জামের কাছ থেকে ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহন করেন এবং সাইদ কুতুব নামে এক পীরের মুরিদ হন। আফগানিস্তানে বেশ কয়েকটি সোভিয়েত বিরোধী লড়াইয়ে বিন লাদেন সরাসরি অংশগ্রহন করেন। তিনি সোভিয়েটদের বিরুদ্ধে জিহাদে উদার হস্তে অর্থও সাহায্য করতেন। এভাবেই বিন লাদেনের উচ্চাকাঙ্খা আফগান সীমান্তের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। ক্রমে তিনি একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন গড়ে তোলায় মনোনিবেশ করেন। তিনি ’গোল্ডেন চেইন’ নামে একটি অর্থ সহায়তা নেটওয়ার্কও তৈরী করেন। এই তহবিলের অর্থদাতারা মূলতঃ ছিলো সৌদী আরব ও উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো। এই সুবিশাল অর্থ ভান্ডার নিয়ে বিন লাদেন ও ইমাম আজ্জাম ’ব্যুরো অব সার্ভিসেস ’গঠন করেন। এ সার্ভিসের কাজ ছিল আফগানিস্তানে জিহাদের জন্য সারা বিশ্ব থেকে তরুন ও যুবকদের সংগ্রহ করা। একাজে সৌদী আরব ও যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে মুজাহিদদেরকে গোপনে শত শত কোটি ডলার সাহায্য দিয়েছে। ১৯৮৯ সালের প্রথম দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাবার পর বিন লাদেন ও আজ্জাম সিদ্ধান্ত নেন যে তারা তাদের নতুন সংগঠনটি বিলুপ্ত করবেন না। বরং তারা ভবিষ্যতে জিহাদের জন্য তাদের এই সম্ভাবনাময় সংগঠনটিকে টিকিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। সে মোতাবেক সংগঠনের নাম দেয়া হয় ’আল কায়েদা’। আর এর নেতা হন ওসামা বিন লাদেন নিজেই। আল কায়েদার ভবিষ্যত লক্ষ্য কি হবে তা নিয়ে আজ্জাম সামান্য ভিন্নমত পোষন করেন। আফগানিস্তানে প্রকৃত ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত আজ্জাম যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতি ছিলেন। তবে বিন লাদেন আল কায়েদাকে বিশ্বে যেকোন স্থানে লড়াই করার উপযোগী করে গড়ে তোলার প্রস্তুতি নিতে চেয়েছিলেন। ১৯৮৯ সালে এক হামলায় আজ্জাম নিহত হন। পরে বিন লাদেন পুরোপুরিভাবে আল কায়েদার দায়িত্ব নেন। লাদেন আফগানিস্তান ছেড়ে সৌদি আরব গেলে সৌদি সরকার তাকে বহিস্কার করে। সেখান থেকে বিন লাদেন সুদানে চলে যান। তার সাথে আল কায়েদার ঘাঁটিও স্থানান্তর হয় সুদানে। আর এই সুদানে বসেই বিন লাদেন সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় মুজাহিদ গ্র“প তৈরীর কাজ চালাতে থাকেন। সুদান থেকেই তিনি পশ্চিমা বিরোধী জিহাদের ভিত্তি নির্মান শুরু করেন। ৯/১১ হামলার পর বিশ্বের মোস্ট ওয়ান্টেড সন্ত্রাসী হিসাবে ওসামার মাথার দাম আড়াই কোটি ডলার ঘোষনা করে যুক্তরাষ্ট্র। সেসাথে আল কায়েদা সংগঠন নিষিদ্ধ করে। লাদেনকে হত্যার উদ্দেশ্যে এক দশক ধরে বড় বড় অভিযান চলে। কিন্তু বাঘা বাঘা গোয়েন্দাদের চোখে ধুলো দিতে সক্ষম হন তিনি। অবশেষে পাকিন্তানের আবোতাবাদ শহরে মার্কিন বাহিনীর হামলায় ওসামা বিন লাদেন নিহত হন।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



