সোশ্যাল মিডিয়া ভিত্তিক আরবান ক্যাম্পেইন অথবা মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার প্রেশার অথবা অন্য কোন ইস্যুকে চাপা দেয়ার রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেই হউক না কেন, সরকার বেশ তড়িঘড়ি করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন (২০০০ সালের ৮ নং আইন) এর ৯ ধারার সংশোধনী এনে ধর্ষনের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডকে (যাবজ্জীবন কারাদন্ডের পাশাপাশি) অন্তর্ভুক্ত করে নতুন গেজেট পাবলিশ করে ১৩ অক্টোবর, ২০২০। আমার এই লেখার উদ্দেশ্য আইনকে সমালোচনা করা নয় (ইতোমধ্যে অনেক কিছু লেখা হয়েছে), বরং আইনজ্ঞদের অতিউৎসাহের ফলে ন্যায়বিচার কিভাবে অনিশ্চিত পথে যাত্রা করে তার ছোট একটা উদাহরন তুলে ধরা।
ঐতিহাসিকভাবেই আমরা ব্রিটিশ কমন ল’ সিস্টেম অনুসরণ (যেখানে বিচারকদের ভুমিকা অগ্রগণ্য) করে আসছি। আমাদের সিভিল (দেওয়ানি) এবং ক্রিমিনাল (ফৌজদারি) জাস্টিস সিস্টেম কলোনিয়াল লিগ্যাসিকেই রিপ্রেজেন্ট করছে এখন পর্যন্ত। ফৌজদারি আইনের খুব কমন একটা প্রিন্সিপল হচ্ছে যেই আইনটাকে তৈরি করা হচ্ছে সেই আইনটি ঠিক সেই মুহুর্ত (অর্থাৎ যেই তারিখ উল্লেখ করা থাকবে গেজেটে) থেকে কার্যকর হবে। যদি আইনে বলা হয় যে উল্লেখিত আইনের মাধ্যমে পুর্বে/ অতীতে সংঘটিত অপরাধের বিচার করা যাবে অথবা পুর্বে সংঘটিত অপরাধের অধিক মাত্রার শাস্তি নতুন আইনের অধীনে দেয়া যাবে তাহলে আমরা বলি সেই আইন অথবা আইনের ধারাকে রেট্রোস্পেক্টিভ ইফেক্ট (পুর্ববর্তী প্রভাব) দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৫(১) অনুচ্ছেদ বলা হচ্ছে ‘অপরাধের দায়যুক্ত কার্যসংঘটনকালে বলবৎ ছিল, এইরূপ আইন ভঙ্গ করিবার অপরাধ ব্যতীত কোন ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করা যাইবে না এবং অপরাধ-সংঘটনকালে বলবৎ সেই আইনবলে যে দণ্ড দেওয়া যাইতে পারিত, তাঁহাকে তাহার অধিক বা তাহা হইতে ভিন্ন দণ্ড দেওয়া যাইবে না’। এই অনুচ্ছেদের ব্যতিক্রম করা হয়েছে কেবল ৪৭(৩) অনুচ্ছেদে যেখানে “….. গণহত্যাজনিত অপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধ এবং আন্তর্জাতিক আইনের অধীন অন্যান্য অপরাধের জন্য কোন সশস্ত্র বাহিনী বা প্রতিরক্ষা বাহিনী বা সহায়ক বাহিনীর সদস্য বা অন্য কোন ব্যক্তি, ব্যক্তি সমষ্টি বা সংগঠন]কিংবা যুদ্ধবন্দীকে আটক, ফৌজদারীতে সোপর্দ কিংবা দন্ডদান ….” এর ক্ষেত্রে কেবল ৩৫(১) অনুচ্ছেদের ব্যতিক্রম করা যাবে বলা হয়েছে। এই সংশোধনীর মুল উদ্দেশ্য ছিলো রাজাকার এবং তাদের দোসরদের বিচারের সম্মুখীন করানো। এছাড়া সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত আইনে ১৯৭৩ এর ২১ ধারা সংশোধনীর মাধ্যমেও আইনের রেট্রোস্পেক্টিভ ইফেক্ট দিয়েছিলো যার অধীনে সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগ মানবতাবিরোধী অপরাধে কাদের মোল্লার ফাসির আদেশ প্রদান করেন। সরকার খুব ব্যতিক্রম ছাড়া ফৌজদারি আইনের ক্ষেত্রে রেট্রোস্পেক্টিভ ইফেক্ট দেন না। অধিকাংশ ফৌজদারি আইনে দেয়া হয় ইমেডিয়েট ইফেক্ট (মানে যখন আইন কার্যকরি হচ্ছে, তখন থেকেই কেবল সেই আইনের অধীনে অপরাধ সংঘটনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার অথবা অতিরিক্ত শাস্তি দেয়া যাবে)।
প্রথম উদাহরন হিসেবে ধরা যাক, আজকে (২১ অক্টোবর ২০২০) একটি নতুন ফৌজদারি আইন কার্যকর করে বলা হলো ঢাকা শহরে ডিপ টিউবওয়েল বসানো একটি ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে যার জন্য ৩ মাস সশ্রম কারাদন্ড দেয়া হবে। এখন এই আইনে ‘অন্য কিছু’ (পুর্বে সংঘটিত অপরাধের বিচারের কথা অথবা রেট্রোস্পেক্টিভ ইফেক্ট) যদি বলা না থাকে তাহলে যিনি গতকাল (২০ অক্টোবর ২০২০) এ ডিপ টিউবওয়েল বসিয়েছেন তার কোন বিচার করা যাবে না। বিচারযোগ্য হবে কেবল সেইটি যখন কেউ ২১ তারিখ থেকে সেই আইনকে অমান্য করেছেন। এখন এই আইনে যদি আমাদের সেই পুর্বে সংঘটিত অপরাধের বিচারের ব্যবস্থাটি থাকতো তাহলে ২০ তারিখে যিনি ডিপ টিউবওয়েল বসিয়েছেন তাকে আমরা বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে পারতাম। দ্বিতীয় আরেকটি উদাহরন হিসেবে ধরা যাক, প্রথম উদাহরনের আইনে সংশোধনী এনে বলা হলো ১লা জানুয়ারি ২০২১ থেকে এই আইনের অধীনে ৩ মাসের সশ্রম কারাদন্ডের পরিবর্তে ১ বছর কারাদন্ড ও আর্থিক জরিমানা থাকবে। এখন কেউ যদি ২১ তারিখে ডিপ টিউবওয়েল বসানোর অপরাধ করে থাকেন, তাহলে ১০ জানুয়ারি তার বিরুদ্ধে রায় দেয়ার সময় তাকে সংশোধিত আইনের অধীনে দন্ডিত করা যাবে না। তার মানে ২১ তারিখে করা অপরাধের বিচার ২১ তারিখে বিদ্যমান আইনের অধীনেই করতে হবে যদি না সংশোধিত আইনে রেট্রোস্পেক্টিভ ইফেক্ট দেয়া হয়।
এখন আমরা যদি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের সংশোধিত গেজেটের দিকে যাই সেখানে বলা হয়েছে আশু ব্যবস্থা (ইমেডিয়েট মিজার/ ইফেক্ট) গ্রহনের কথা। তার মানে সংশোধিত আইনের ধারাটি কার্যকরি হচ্ছে ১৩ অক্টোবর ২০২০ থেকে (যেইদিন গেজেট প্রকাশিত হয়েছে)। যেহেতু এখানে দেয়া হয়েছে ইমেডিয়েট ইফেক্ট, সংশোধিত ৯ ধারায় বিচার করে মৃত্যুদন্ড কেবল তখনই দেয়া যাবে যদি ধর্ষনের অপরাধটি ১৩ অক্টোবর অথবা তারপরে যে কোন একদিন ঘটে থাকে। আমাদের সংশোধিত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে রেট্রোস্পেক্টিভ ইফেক্ট দেয়া হয়নি। টাংগাইলের যে মামলাটিতে মৃত্যুদন্ডের রায় দেয়া হয়েছে সেই মামলাটি রুজু/দায়ের করা হয়েছিল ২০১২ সালে। যেহেতু আমাদের সংশোধিত আইনে রেট্রোস্পেক্টিভ ইফেক্ট দেয়া হয় নি, সেহেতু টাঙ্গাইলের উল্লেখিত ধর্ষণ মামলায় মৃত্যুদন্ডাদেশ উচ্চ আদালতের শুনানীতে টিকবে না বলে আমার সীমিত আইনের জ্ঞানের বিশ্বাস। যেহেতু সাব জুডিস ম্যাটার (আদালতে বিচারাধীন এই অর্থে যে অপরাধীরা আপিল করার জন্য হাইকোর্ট ডিভিশনে যেতে পারবে ৬০ দিনের মধ্যে), সেহেতু আমজনতার অংশ হিসেবে চট করে সিদ্ধান্তে আসার অর্থ হচ্ছে আদালত অবমাননার দায়ে ফেঁসে যাওয়া। তথাপি সংশোধিত আইনের অধীনে অভিযুক্তদের ফাসি দেয়া একইসাথে আমাদের সংবিধানেরই গুরুতর লংঘন, আইনের অনুশাসনের বিচ্যুতি, নিম্ন আদালতের রায়ের সাসটেইনিবিলিটি এবং বিচারকদের প্রজ্ঞা উচ্চ আদালতে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেয়া এবং একই সাথে দায়ী অপরাধীদের ফৌজদারি আইনি সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত করা। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি ধর্ষকদের কঠোর শাস্তির প্রয়োজন আছে, কিন্তু সেই প্রক্রিয়াতে তাড়াহুড়া করলে অথবা কাউকে খুশী করার প্রয়াস থাকলে সেটা আর ন্যায়বিচার হয় না। এইজন্যই হয়তো উইলিয়াম গ্ল্যাডস্টোন সখেদে বলেছিলেন ‘Justice delayed is justice denied, justice hurried is justice buried’ ।
কৃতজ্ঞতাঃ ব্লগার, শিক্ষক এবং চারুশিল্পী শাহ আজিজ স্যারকে যার একটি পোস্টে মন্তব্যের উপর ভিত্তি করে এই লেখাটির ধারনাটি মাথায় এসেছিলো।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে অক্টোবর, ২০২০ ভোর ৪:২৬