somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

Orhan Pamuk এর My Name is Red(অনুবাদ) ধারাবাহিক

০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০২১ ভোর ৪:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আর কিছু না আমি এখন-শুধুই একটা লাশ,পড়ে আছি একটা কূয়ার গভীরে।যদিও বেশ কদিন ফুরোনো এই শরীরের শ্বাস প্রশ্বাসের শেষ কাহিনীর গল্প-যে খুন করেছে আমাকে,আর কারও জানা নেই কেন এই অবস্থা আমার।সেই দূর্বত্তটা নিশ্চয় আমার হ্রদয়ের স্পন্দনটাও পরখ করে দেখতে ভুলেনি,তার তো জানা দরকার ছিল আমি মৃত কি না,তারপর আমাকে কূয়ার ধারে নিয়ে ফেলে দিল ধাক্কা দিয়ে।পড়ে যাওয়ার পর বড় একটা পাথরের টুকরা
আমার মাথার দিকে লক্ষ্য করে ছুড়ে,মাথার হাড্ডি ভেঙ্গে আরও নিশ্চিত হলো সে,রক্ত মগজ ছিল চারপাশে ছড়ানো ছিটানো।

দিন চারেক ধরে আমি নিখোঁজ,আমার ছেলেমেয়ে,বৌ সবাই হয়তো তন্ন তন্ন করে খুঁজছে আমাকে।আমার ছোট্ট মেয়েটা হয়তো কাঁদতে কাঁদতে ঘরের দরজা দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছে, ‘কখন ফিরে আসবে বাবা’।জানি,সকলের চোখ হয়তো আটকে আছে জানালায়,সবাই ভাবছে এই আমি ফিরে আসছি আচমকা,হয়তো কোন এক অলৌকিক সুরে।

জানিনা যদিও,সত্যিই সত্যিই কি তারা আছে আমার অপেক্ষায়?আমি সে ব্যাপারেও কিছুটা সন্দিহান।এমনও তো হতে পারে আমার অনুপস্থিতিটাও এর মধ্যেও তাদের সহনীয় হয়ে গেছে।পরপারের জীবনটায় পৌঁছে আমরা ভাবি,ওপারের পৃথিবীতে আমাদের অস্তিত্বটা থেকেই যায়।আমার জন্মের আগেও ছিল অফুরন্ত সময়ের আকাশ আর আমার মৃত্যুর পরে সময় থাকবে তার আপন সুরে থমকে দাড়ানো।আমি আটকে আছি দুই অন্ধকারের মাঝে এক আলো আঁধারের রাজ্যে।

আমি সুখী ছিলাম,বেশ সুখী।সুলতানের ছবি আঁকার ঘরটায় যে ভাবে আলোর ব্যাবস্থা করে দিয়েছিলাম সেটা অন্য কারও কাছে ছিল অকল্পনীয়।কাজগুলো আমার একার হাতেই
করা,আমার মাসিক আয় খুব একটা কম ছিল না,প্রায় ৯০০ কুরুস,হয়তো এটাও ছিল অনেকের কাছে অসহনীয়।

আমার কাজ ছিল বইএর পাতা ছবি আর অলঙ্কারে সাজানো,একেকটা পাতা তার নিজের সৌন্দর্যে চমকে ওঠা,পাতাগুলো সাজানো রকমারী গাছের পাতার অলঙ্কারে,ফুল,পাখীর ছবি দিয়ে।বই এর মাঝে ছবিগুলোও এঁকে দেয়ার দায়িত্বটাও ছিল আমার,মেঘ ছুটে যাওয়া পাহাড় পর্বত জঙ্গলে,সেখানে সুলতানের প্রাসাদের অস্তিত্ব নেই,অস্তিত্ব নেই হরিন,শিকারীদের।আমি প্লেটের পেছনের ছবি,আয়নার পেছনের অলঙ্কার,এমন কি বসফরাস নদীর ধারের প্রাসাদের ছবি এঁকে দেয়ার কাজেও ব্যাস্ত থাকতাম।মহামান্য সুলতান এর জন্যে ভাল পরিমানের মোহর উপহার দিতে কোনদিন দ্বিধা করে নি,যদিও এখন সেটা আমার এই মৃতলোকে অপ্রয়োজনীয়,
এই মৃত শরীরটাও জানে টাকাপয়সার প্রয়োজীনতা।

এই মৃত মানুষটার কথায় সবাই বলবে,কি যায় আসে তোমার প্রতিপত্তির কথায়,কি ছিল কি ছিল না।সবাই জানতে চাইবে,মৃত্যুর পরে মানুষের কোন অস্তিত্ব আছে কি না?আত্মার অস্তিত্বটা কি?বেহেশত দোজক কি আছে না নাই,না ওগুলো শুধু কথার কথা?জীবন মৃত্যুর মধ্যে পার্থক্যটা কোথায়?মৃত্যুর পর কোন যন্ত্রনা,ব্যাথা আছে?তুমি ঠিকই বলেছ যারা বেঁচে আছে তাদের প্রচন্ড কৌতুহল,মরণের পরে কি ঘটে জানার জন্যে।হয়তো ঐ মানুষটার গল্প অনেকেরেই জানা মৃত্যু নিয়ে যার কৌতুহল এত বেশী ছিল সে যুদ্ধ ক্ষেত্রে ক্ষ্রেত্রে ঘুরে ঘুরে মৃতদেহ খুঁজে খুঁজে দেখতো।যে মারা গেছে আর যে মারা যাচ্ছে,তাদের কাছে তার জানার কৌতূহল পরপারের পৃথিবীর চেহারাটা।তৈমুর লং এর এক সৈন্যের হাতে মৃত্যু হলো তার কৌতুহলের তলোয়ারের কোপে দু ভাগ হয়ে।

ওগুলো সব বাজে কথা!ঠিক উল্টোটাই সত্যি,আমি বলবো বরং মানুষের আত্মা নানান ভাগে ভাগ হয়ে যায় এক হয় মৃত্যুতে আরেক ভাগ ছড়িয়ে থাকে পৃথিবীতে হতাশায়।ঐ সব অবিশ্বাসীদের কথা একপাশে ছুড়ে ফেলে এটুকু নিঃসন্দেহে বলা যায়,মরনের পরেও একটা জগত আছে,আর তার প্রমান এটাই যে আমি সেখান থেকে কথা বলছি।এটা ঠিক যে আমি মৃত,কিন্ত শেষ হয়ে যায়নি আমার অস্তিত্ব।এটা অবশ্য ঠিক যে আমি দেখিনি এখনও বেহেশতের ফোয়ারা,সবুজ পাতায় ভঁরা বিভিন্ন ধরণের রসাল ফলের গাছ,ছন্দে ছন্দে হেঁটে যাওয়া সুন্দরী হুরপরীরা দলে দলে,যে ভাবে লেখা আছে আমাদের পবিত্র কোরানে।অবশ্য এটা বলতে আমার দ্বিধা নেই একটুকুও যে আমিও সময়ে সময়ে বেহেশতের হুরপরী সুন্দরীদের ছবিটা মনে তুলে নিয়ে আমেজে বেশ কিছুটা স্বপ্ন যে সাজিয়ে নেই নি তা না,তবে দেখা পায়নি এখনও।শুধু তাই না আমি এখনও খুঁজে পাইনি,ভেসে যাওয়া দুধের স্রোতের নদী,মিষ্টি আঙ্গুর রসের ফোয়ারা,মধু যা পবিত্র কোরান ছাড়াও বলা ইবনে আরাবীর লেখায়।তবে এ কথাগুলো বলার এটাই মানে না যে,আমি চেষ্টা করছি বিশ্বাসীদের মন ভেঙ্গে দেয়ার জন্যে,তাদের পরপারের স্বপ্নটা তছনছ করে দিতে,তাই আমি পরিষ্কার করেই বলতে চাই আমার দেখাগুলো শুধু আমার অবস্থান থেকে দেখা ছবিটা,অন্যের ক্ষেত্রে সেটা সত্যি নাও হতে পারে।এমনও হতে পারে,যারা বিশ্বাসী তারা খুব ভাল করেই জানে আমার পরিস্থিতি হয়তো সূযোগ করে দেয়নি বেহেশতের নদীগুলো দেখার,হুরপরীদের সঙ্গ পাওয়ার।

যাকগে,আমি ওস্তাদ এলেগান্ট এফেন্দি হিসেবে পরিচিত,আর আমি এখন একটা লাশ,এখনও কবর দেয়া হয়নি আমাকে,হয়তো তাই আমার আত্মাটা এখনও শরীরেই আটকে আছে,ছেড়ে যেতে পারেনি যথাযথ ওপারের যাত্রায়।এই যে অভাবনীয় পরিস্থিতি হয়তো প্রথম না,তবে আমার অমর আত্মা এক যন্ত্রনার মধ্যে আটকে আছে।যদিও আমি,আমার শরীর,টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া মাথার হাড়,পচে যাওয়া শরীর পানিতে ডুবে আছে যা,আর কোন যোগাযোগ নেই আমার সাথে,তবে ওটাই আটকে রেখেছে আমাকে এই পৃথিবীর মায়ালোকে।

এই আটকে থাকা হয়তো আমি কিছুটা তুলনা করতে সেই মুক্তির সাথে যা মৃত্যুর সময় ছিল আমার অনুভুতিতে।সেই র্দূবৃত্তকে দেখে আমার বুঝতে কষ্ট হয়নি,তার উদ্দেশ্য-যা আমাকে খুন করার।তবুও কেন জানি আমি বিশ্বাস করিনি পাথর দিয়ে সে আমার মাথার হাড়গুলো চুরমার করে দিবে।আমি অনেক চেষ্টা করেছি জীবনটাকে ধরে রাখার জন্যে,দাতের
কামড়ে,তবে ঐ যন্ত্রনার বিবরণ দিয়ে অযথা যন্ত্রনা বাড়ানোর কোন ইচ্ছে নেই আমার।

ঐ ঘটনায় যখন বুঝতে পারলাম এটাই শেষ,অদ্ভুত একটা স্বস্তির সুর ছড়ানো তখন আমার
মনে,পরপারের যাত্রাটা তেমন একটা কষ্টকরও মনে হয়নি,অনেকটা যেন শান্তির ঘুম একটা।

এ অবস্থায় আমার অভিযোগ নেই যে,দাঁতগুলো ভেঙ্গে রক্তাক্ত মুখের মাঝে অনেকটা খাবারের বাদামের মত আঁটকে আছে।অভিযোগ নেই আমার যে চোখমুখের হাড্ডি ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে,অভিযোগ নেই যে কূয়ার পানিতে পড়ে আছি আমি-শুধু এটাই আমার অভিযোগ যে সবাই ভাবছে হয়তো আমি বেঁচে আছি এখনও।আমার যন্রনায় পড়ে থাকা আত্মাটা ভাবছে-আমার আত্মীয়স্বজন,বন্ধুবান্ধব,হ্যা,যারা সময়ে সময়ে ভাবছে হয়তো ইস্তাম্বুলে কোথাও আছি আমি,হয়তো অন্য কোন মেয়ের প্রেমে পড়ে ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছি।আর না!অনেক হয়েছে আমার শরীরটা খুঁজে বের কর,দোয়াদরুদ পড়ে আমাকে কবর দেয়ার বন্দোবস্ত কর।সবচেয়ে বড় অভিযোগ আমার,খুঁজে বের কর আমার খুনীকে।যদিও আমাকে কবর দাও সবচেয়ে সুন্দর কবরে,যতদিন ঐ খুনী ঘুরে বেড়াবে,ততদিন কবরে আমার ক্ষয়ে যাওয়া শরীরটা তোমাদের মাঝে অবিশ্বাসের অভিশাপ ছড়িয়ে ঘুরে বেড়াবে।প্রথমে খুঁজে বের কর ঐ খুনী বেশ্যার ছেলেটাকে,তখন আমি বলতে পারবো তোমাদের মৃত্যুর পরের জীবনের গল্পটা-কিন্ত মনে রাখবে,তাকে ধরার পর অত্যাচার করে অন্তত তার দশ পনেরটা হাড্ডি ভেঙ্গে দেবে,পাজরের হাড্ডি ভেঙ্গে দিলেই ভাল,কোন একটা লোহার টুকরা দিয়ে মাথার চুলগুলো একটা একটা করে তুলবে,যেন প্রতিবার সে যন্ত্রনায় কেঁদে উঠে।

জানিনা,কে এই খুনী?কেনই বা সে অত্যাচারে যন্ত্রনায় এভাবে আমাকে ধুঁকে ধুঁকে মারলো!ভুলে যেওনা জেনে নিতে কেন সে আমাকে খুন করলো?সবাই বলে পৃথিবী ভঁরা অকেজো খুনীর দল,হয়তো আমার খুনী তাদের একজন।তা হলে সাবধান করে দেয়া ভালঃআমার মৃত্যু হয়তো দেখিয়ে দিতে চাচ্ছে আমাদের ধর্মের বিরুদ্ধে চক্রান্তটা,আমাদের ঐতিহ্যে,যে ভাবে আমরা দেখি পৃথিবীকে।চোখটা খুলে দেখ,দেখ কারা তোমার বিশ্বাসের শত্রু,কারা শত্রু ইসলাম ধর্মের,যারা ধ্বংস করেছে আমাকে।জেনে নাও,হয়তো তোমার ক্ষেত্রে হতে পারে এটা একদিন।এরজুরামের নামকরা নাসিরুদ্দীন হোজা যে ভাবে বলে গেছে,ঠিক সে গুলোয় ঘটে যাচ্ছে।ভুলে যাওয়ার এ কথাটা বলে নেই,এই যে অবস্থায় আমরা এখন এটা একটা বই এ বলা আছে।পবিত্র কোরানের হিসাবে আল্লাহ আমাকে মাফ করুক-হয়তো আমাকে অনেকে ভুল বুঝবে,ও ধরণের পবিত্র আর ক্ষমতাশালী বই এর বিশ্লেষণ অনেকটা অসম্ভব।আমার মনে হয় তোমরাও হয়তো কেউ বুঝে উঠতে পারনি।

শোন,যখন আমি শিক্ষার্থী ছিলাম,মনে তখন বেশ ভঁয় থাকলেও,যৌবনের উচ্ছাসে আমিও হাসি ঠাট্টা করতাম,পরকাল বেহেশত দোজখ-ঐ সব ব্যাপার নিয়ে।এই যে কূয়ার মধ্যে আমি পড়ে আছি,মনে রেখ এটা তোমার ক্ষেত্রেও হতে পারে।এখন তো আর কিছুই করার নেই,শুধু এটুকু আশা যে শরীরটা পচে দূর্গন্ধ বেরোলে তখন হয়তো জানতে পারবে আমার অবস্থানটা।আমার আশা যে কোন ভালমানুষ ঐ খুনীকে ধরার পর যথাযথ শাস্তি দিবে।





আমার ফেরা

প্রায়টা বারটা বছর বাইরে কাটানোর পর,অনেকটা যেন ঘুমের ঘোরেই আমি ফিরে গেলাম ইস্তাম্বুলে।পৃথিবী মানুষকে ডেকে নেয় সবাই বলে কারও মৃত্যুর কথায়, “আমার ক্ষেত্রে,যে শহরে জন্ম সেটাই আমাকে ডেকে নিয়ে গেল আমার মৃত্যুতে।যখন ফিরে এলাম,আমার চারপাশটায় ছড়ানো শুধু মৃত্যুর গন্ধ,তারপর খুঁজে পেলাম ভালবাসা।ভালবাসা আমার কাছে তখন হাজার যোজন দুরের একটা স্মৃতি,অনেকটা এই শহরের আমার স্মৃতির মত।বছর বার আগে আমি যখন আমি ইস্তাম্বুলে ছিলাম,তখন চাচাত বোনের ভালবাসায় পাগল ছিলাম আমি।

চার বছর পর ছেড়ে গেলাম ইস্তাম্বুল,অনেক চড়াই উতরাই,বরফ ঢাকা পাহাড়,পারস্যের কটা সুন্দর শহরে কাটালাম ট্যাক্স কালেক্টরের চাকরীতে।ভুলেই গেলাম আমার ছোটবেলার শহর ইস্তাম্বুল,বাল্য প্রেমের কথা।বেশ কবার চেষ্টা করেও মনে করতে পারিনি ভালবাসার পুরোনো মুখটা,হয়তো চেনা মুখগুলোও অচেনা হয়ে যায় সময়ের ধাক্কায়।ইস্তাম্বুল থেকে চলে আসার বছর ছয় হবে,পারস্যের পূর্বদিকের একটা শহরে সেখানকার পাশার পরামর্শদাতা হিসাবে চাকরী আরম্ভ করলাম।ভালবাসার মুখ খুঁজতে গিয়ে এটুকু বুঝতে কষ্ট হয়নি, যে মুখটা আমি খুঁজছিলাম সেটা আমার প্রেমিকার মুখ না,চলার পথের শুধু একটা মুখ হয়তো বা।মনে পড়লো পরে আমার ছয় বছরের হিসেবটা আসলে আমার আট বছরের গল্প।এ ভাবে বার বছর যখন ইস্তাম্বুলে পৌছালাম তখন আমার ভালবাসার মানুষটা অন্য কারও সাথে হারিয়ে গেছে।

অনেক আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব ছেড়ে গেছে পৃথিবী,চলে গেছে মা,চাচা-আমার মা আর চাচার জন্যে কবরস্থানে যেয়ে যথারীতি দোয়া করলাম।কবরের পাশের মাটির গন্ধে অনেক স্মৃতি টেনে আনলো আমার মনের খাতায়।কেউ একজন মায়ের কবরের পাশে একটা ভাঙ্গা মাটির জগ ফেলে রেখেছে,অজানা কোন কারণে।কারণ ছাড়া অকারণেই ঐ ভাঙ্গা মাটির জগ আমাকে কান্নায় দুঃখে অভিভুত করে দিল।জানি না কেন আমি কি কাঁদছিলাম,আমার হারানো প্রিয়জনদের জন্য,নাকি পুরোনো শহরে নতুন জীবন শুরু করার দুঃখে?হয়তো এটাই আমার জীবন যাত্রার শেষ পর্বটা।হাল্কা শুরু বরফ পড়ছিল তখন,বরফের ছন্নছাড়া সুরে আমি এতই হারিয়ে যাওয়া খেয়াল করিনি যে দূরে দাঁড়ানো একটা কাল কুকুর কেন জানি আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

চোখের পানি মুছে,মুছে নিলাম আমার নাকটাও।কালো কুকুরটা বন্ধুত্বের সুরে লেজ নেড়ে নেড়ে যেন আমার দুঃখে সহানুভুতি দেখাচ্ছিল।আমি আমাদের পুরোনো আস্থানার কাছেই থাকার জায়গা ঠিক করলাম,বাবার কজন পুরোনো বন্ধু তখনও সে এলাকায় থাকতো।বাড়ীর মালিকের কাছে আমি যেন সাফাবিদ যুদ্ধে হারানো তার ছেলেটাই,তার অনুগ্রহে রান্নার পর্বটা নিয়েকে আমাকে আর ভাবতে হলো না,কিছু ঝামেলা এড়ানোর সূযোগ হলো,মন্দ কি।

ইস্তাম্বুলের রাস্তা দিয়ে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম,যেন আমি তখন পৃথিবীর অন্যপ্রান্তে আরব দেশের কোন এক শহরে।রাস্তাগুলো বেশ ছোট,অন্তত সেটাই মনে হচ্ছিল আমার,রাস্তাগুলো যেন পাশের বাড়ীগুলোর মাঝ দিয়ে কোন রকমে ছড়ানো।মনে হচ্ছিল,রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় বাড়ীর দেয়াল ঘেষে ঘেষে হেঁটে যেতে হবে।আশেপাশের লোকজন সবাই বেশ ধনী হয়ে গেছে,অন্তত সেটাই মনে হলো।সাজানো একটা ঘোড়ার গাড়ী দেখলাম সাধারণত যেগুলো দেখা যায় পারস্যের ধনী এলাকায়।রাস্তার ধারে ছেঁড়া কাপড়ে অনেক ফকিরও ছিল যাদের শরীর পাশের মুরগী বাজারের গন্ধে ভঁরা,তাদের মধ্যে একজন অন্ধ,তবু সে কেন জানি তুষারপাতের দিকে তাকিয়ে আপন মনে হাসছিল।

কেউ যদি আমাকে বলতো ইস্তাম্বুল আগের চেয়ে একটা গরীব শহর,আমি বিশ্বাস করতাম না,তবে এখন দেখে আমার সেটাই মন হলো।আমার প্রেমিকার বাসায় এখন অন্য কেঊ থাকে,শুনলাম খালাও মারা গেছে বেশ কিছুদিন।প্রেমিকা এনিসি তার বাবার সাথে অন্য কোথাও চলে গেছে।পাড়াপড়শীদের কাছে জানলাম তাদের দূরবস্থার কথা,সময়ে কি নিষ্ঠুরভাবে আমার স্বপ্ন,ভালবাসার দেশটা তছনছ হয়ে গেছে।পুরোনো স্মৃতি নিয়ে আর বেশী কথা বলবো না,তবে পুরোনো বাড়ীর বাতামী লেবুর গাছে বরফের কনায় লুকোনো আমার ফেলে আসা জীবনের একটা অংশ,এখন সেখানে ছড়ানো মরলোকের সুর।

যদিও এনিসি তাব্রিজ পাঠানো চিঠিতে লিখতো তাদের দুরবস্থার কথা আর তার সাথে তার অনুরোধ।আমাদের সুলতানের গোপনীয় ইতিহাস নিয়ে একটা বই লিখছিল সে আর বই এর জন্যে আমার কিছু সাহায্য চেয়ে সে আমাকে ইস্তাম্বুলে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ করছিল।
তাব্রিজে থাকার সময় অটোমান পাশা,রাষ্ট্রীয় নীতি,পরিচালন ব্যাবস্থা নিয়ে আমার লেখার কথা তার জানা ছিল,অনুরোধটা সেখান থেকেই সাজানো।আমার প্রেমের মনটা যা করলো,
অন্যান্য বই এর দেয়া আগামটাকা কিছু পাঠিয়ে দিলাম এনিসির বই এর জন্য,বই এর পাতা অলঙ্কারে সাজানোর জন্যে,ইস্তাম্বুলের কিছু শিল্পীকে-ঐ সব শিল্পীদের অভিযোগের মাত্রার বহর দেখে মনে হচ্ছিল এনিসি যদি আমার ভালবাসার মানুষ না হতো,আমি হয়তো কোনদিনই জড়াতাম না এই অযথার ঝামেলায়।

বাজারের দিকটায়,ঠিক এনিসিদের বাড়ীর পাশাপাশি,সেই পুরোনো নাপিতের দোকানটা এখনও আছে,পুরোনো আয়নাগুলো বদলায়নি,ক্ষুর,পানির বোতল,সবকিছুই সাজানো আগের মতই।তার সাথে একটুঁ চোখাচোখি হলো যদিও,ঠিক বুঝে উঠলাম না,সে আমাকে চিনতে পেরেছে কি না।দেখে কিছুটা মজাই লাগলো চুল ধোয়ার বেসিন যেটা ঝোলানো ছিল ছাদের একটা শেকল দিয়ে,এখনও ঝোলানো ঠিক একই ভাবে।

ছোটবেলার রাস্তা,এলাকাগুলো বেশ বদলে গেছে,অনেক জায়গায় বাড়ীঘর নেই,নেড়ী কুকুর ইচ্ছেমত ঘুরে বেড়াচ্ছে যেখানে সেখানে।মাঝে মাঝে নতুন আকাশ ছুয়ে যাওয়া দালানকোঠা,
তাদের প্রাচুর্যতার চেহারা দেখলে অবাক না হয়ে উপায় নেই।জানালার কাঁচের কারুকাজ,
জানালার পর্দার সৌন্দর্য একেবারে চোখ কেড়ে নেয়ার মত।

টাকাপয়সার দাম বেশ কমে গেছে ইস্তাম্বুলে।আমার যাওয়ার আগে ১০০ ড্রামকা সাইজের রুটি বিক্রি হতো এক রুপোর টাকায়,এখন তার অর্ধেক সাইজের রুটির দামই তার চেয়ে বেশী,আর রুটির স্বাদও আগের মত মুখ ছড়ানো নেই।আমার মৃত মা যদি দেখতো,
এক ডজন মুরগীর ডিমের দাম প্রায় তিনটা রুপোর টাকা,নিঃসন্দেহে তার মন্তব্য হতো, ‘এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পালিয়ে যাওয়া উচিত,না হলে মুরগীরাই আমাদের মাথায় পায়খানা করা আরম্ভ করবে’।আসলে বলার কিইবা আছে,টাকাপয়সার দাম তো পৃথিবীর সবজায়গায়ই কমে গেছে।আবার এটাও শোনা যাচ্ছে ভেনিসের বেশ কিছু ব্যাবসায়ী জাহাজ ভর্তি নকল টাকাপয়সা চালান করার ব্যাবসায় ব্যাস্ত।এক সময় সরকারী খাজাঞ্চীখানায় যেখানে ১০০ ড্রামকায় রুপোতে যেখানে ৫০০ রুপোর মোহর বানানো হতো,এখন পারস্যের সাথে যুদ্ধ আর অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে সেটা দিয়েই হচ্ছে ৮০০ রুপোর মোহর।সৈন্যরা যখন এই রহস্যটা বুঝতে পারলো তারা আমাদের সুলতানের প্রাসাদ ঘেরাও করে বিদ্রোহ করলো।

একজন মোল্লা যার নাম নুসরেত,বায়েজিদ মসজিদের ইমাম,নিজেকে আবার আমাদের পয়গম্বর সম্মানিত মোহাম্মদ(সাঃও)এর উত্তরপুরুষ হিসেবে দাবী যার,এই ঠকানোর সময় বেশ কিছু টাকাপয়সা করে নিতে একটুঁ দ্বিধা করেনি।এই হোজা,ইজুরাম নামের একটা ছোট্ট শহর থেকে এসেছে ইস্তাম্বুলে,তার মতে মানুষজন সবাই ধর্ম,নীতির পথ থেকে সরে গেছে,কেউ পবিত্র কোরানের নিয়মাবলী মেনে চলছে না,তাই সকলেরর এই দুরবস্থা।আর এর জন্যে দায়ী ঐ খৃষ্টানরা যারা মদ বিক্রি করে,নাচ বাজনা করে সমাজকে কলুষিত করে যাচ্ছে।

সবজীর ব্যাবসায়ীর কাছ থেকে ইজুরামের মোল্লার গল্পকথা শোনা আমার-তার কাছেই শুনলাম নতুন পয়সা ডুকাট,নকল পয়সা ফ্লোরিন,ওটোমান সাম্রাজের কম রূপো দিয়ে তৈরী করা মোহর,আর রাস্তাঘাটের বসনিয়ান,আর্মেনিয়ান,জর্জিয়ানের দল আমাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে অধঃপতনে যেখান থেকে উঠে আসা আর সম্ভব হবে না কোনদিন।এটাও শুননাম,কফি চায়ের দোকানে গোলমাল করার লোকজন সবাই জমায়েত হয়ে সারারাত্রি বসে বসে হৈচৈ করে।অদ্ভুত ধরণের লোকজন,মাতাল,আফিমখোর,বেআইনী কালেন্দারী দরবেশের শিষ্যরা,যারা আল্লার পথের নামে দরবেশের বাসায় বসে বসে মদ খায় আর নানান ধরনের যৌনকাজে লিপ্ত থাকে,এমন কি ছোট ছোট ছেলে,কিশোররাও রক্ষা পায় না তাদের হাত থেকে।

আচমকা একটা বাশীর সুর আমাকে টেনে নিয়ে গেল,সবজী ব্যাবসায়ীর মুখরোচক গল্প থেকে অন্যদিকে।এটুকু জানি আমার পচ্ছন্দের শহরটার ভালবাসা,তার বাতাস তুষারের সুর আজও আমাকে টেনে নিয়ে যায় আমার ভালবাসার পুরোনো আকাশটায়।এভাবেই আমি ফারিয়ারের বাজার ছেড়ে সুলেয়মানী মসজিদের দিকে হেঁটে গেলাম।বাড়ীর ছাঁদের তুষারের ছোঁয়ায় বাড়ীগুলোর চেহারা একেবারেই বদলানো।একটা নৌকা তার পালের বাতাসের শব্দে আমাকে অভিনন্দন জানালো,পালের রং মসজিদের সোনালী চেহারা যেন একই সুরে সাজানো।
ঝাউ আর পাইন গাছ,বাড়ীর ছাদ,গোধুলির কান্না,আশেপাশের বাড়ীর চীৎকার,মসজিদের মাঠের ছেলেমেয়েদের হৈচৈ এমন অদ্ভুত একটা সুর ছড়িয়ে দিচ্ছিল আমার মনে,ওর মায়াজাল থেকে বেরিয়ে অন্য কোন শহরে যাওয়া ছিল একেবারেই অসম্ভব।মনে হচ্ছিল হঠাৎ যেন খুঁজে পেলাম আমার প্রেমিকের মুখটা যা অনেকদিন আগে হারিয়ে যাওয়া।

পাহাড়ী রাস্তাটা দিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে গেলাম লোকজনের মাঝে,মাগরেবের নামাজ পড়া শেষ করে,রেস্তোরায় যেয়ে কলিজা আর রুটি দিয়ে খেয়ে নিলাম।বেশ ফাঁকা দোকানটা,মালিক বসে বসে আমার খাওয়ার ধরণটা দেখছিল,যেন একটা বিড়ালকে খাইয়ে দিচ্ছে।তার কাছ থেকে ক্রীতদাস বাজারের যাওয়ার রাস্তাটা জেনে নিয়ে পেছনের গলিটাতে দিয়ে কফির দোকানে গেলাম,রাস্তাঘাট তখন বেশ অন্ধকার।

কফি দোকানটার ভেতরে বেশ কিছু লোকজন জমা হয়ে গল্প গুজব করছে আর উষ্ণতাও ছিল বেশ আরামদায়ক,তাব্রিজে যেমন দেখেছিলাম ঠিক সেভাবে একজন গল্পকথক বেশ উঁচু জায়গায় আসন সাজিয়ে গল্প বলে যাচ্ছিল।পারস্যে ওদের অবশ্য বলে, ‘আহ্বায়ক’।লোকটা লোকজনের সামনে হাতে আঁকা একটা কুকুরের ছবি ঝুলিয়ে আর যেন কুকুরের স্বরে তার গল্প বলে যাচ্ছিল।

০০০০০০

সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০২১ ভোর ৪:৪৬
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হালহকিকত

লিখেছেন স্প্যানকড, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:১২

ছবি নেট ।

মগজে বাস করে অস্পষ্ট কিছু শব্দ
কুয়াসায় ঢাকা ভোর
মাফলারে চায়ের সদ্য লেগে থাকা লালচে দাগ
দু:খ একদম কাছের
অনেকটা রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় ।

প্রেম... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×