somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মেমরিস্টর [MEMRISTOR] ; তড়িৎ ব্যাবস্থার [ইলেক্ট্রিকাল সিস্টেম] নতুন সদস্য

২১ শে এপ্রিল, ২০১০ রাত ১:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


মেমরিস্টর [স্মৃতিধারক রোধ] প্রাক-কথনঃ


আপনার অফিসের বস ২৪ বছরের অভিজ্ঞ কোন রোবট - কিংবা আপনাকে ফাইল এগিয়ে দিচ্ছে আপনার ধাতব সহকারী … কল্পকাহিনীতে হরহামেশাই এসব দেখা গেলেও বাস্তবতা হল , আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলেজেন্স এখনো খেলনার পর্যায়েই আছে । অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে পারে এমন কিছু এখনো গবেষকদের কাছে মিথ বা সায়েন্স ফিকশান হয়েই আছে । তবে এ শতাব্দীর একটি আবিষ্কার এই গবেষনাতে নতুন আশার প্রদীপ জ্বালিয়েছে ।

১৯৭১ সাল । এদিকে বাংলাদেশে চলছে স্বাধীনতার যুদ্ধ , ভূমিকম্প , টর্নেডো , মিলিটারি ক্যু সব মিলিয়ে ঝঞ্ঝা – বিক্ষুদ্ধ একটি বছর । এর মাঝে ক্যালিফোর্নিয়া বার্ক’লে ইউনিভার্সিটির Leon Chua [লিও চুয়া] তার পেপারে ভবিষ্যত বানী করলেন তড়িৎ ব্যাবস্থা [ Circuit system] এর নতুন এক সদস্য কে , নাম দিলেন মেমরিস্টর ।

চার্জ (Q) , তড়িৎ প্রবাহ (I) , বিভব (V) , চৌম্বক ফ্লাক্স (F)[এখানে ফ্লাক্স কে গ্রীক ফাই এর পরিবর্তে F দিয়ে প্রকাশ করা হল ] – এই চারটি হল সার্কিট ভেরিয়েবল । বিদ্যুত সম্পর্কিত যেকোন ব্যবস্থাকে এই চারটির মাধ্যমে প্রকাশ করা যায় । আমরা দৈনিন্দন জীবনে যত বৈদ্যুতিক যন্ত্র বা যন্ত্রাংশ ব্যবহার করি , সবগুলো এদের একটি বা একাধিকের ফাংশন হিসেবে কাজ করে । একটি তড়িৎ ব্যবস্থায় থাকতে পারে তিনটি উপাদানঃ রোধ (R) , আবেশক বা Inductor (L) , ধারক বা Capacitor (C) .
বিদ্যুৎ প্রবাহ ও বিভবের ফাংশান হল রোধ , বিভব ও চার্জের ফাংশান হল ধারক বা capacitor ; ফ্লাক্স ও বিদ্যুতের ফাংশান হল আবেশক বা Inductor .

R = V/I ; L = F / I ; C = Q / V ;

লিও চুয়া প্রথম করেন , এখানে চার্জ ও ফ্লাক্স কে সম্পর্কিত করে এমন কোন ফাংশান নেই ।


এজন্যে তিনি নতুন একটি ফাংশন বা সার্কিট উপাদান কল্পনা করেন , যা চার্জ ও ফ্লাক্স কে সম্পর্কিত করবে । এর নাম দিনি দিলেন মেমরিস্টর , M . এর কিছু বৈশিষ্ট্য সম্পর্কেও ধারনা দিলেন । তবে তা আক্ষরিক অর্থেই কাগজে ও কলমে অর্থ্যাৎ কেবলি গাণিতিক ভাবে ।

দীর্ঘ ৩৭ বছর পরে ২০০৮ সালের ৩০শে এপ্রিল HP ল্যাবে মেরিস্টর আবিষ্কার হল । দেখা গেল , এর বৈশিষ্ট প্রায় সবটুকুই মিলে যায় লিও চুয়ার ধারনার সাথে ।


**গাণিতিক বিশ্লেষনঃ

মেমরিস্টরকে বলা হয় , চার্জ নির্ভর ফ্লাক্স পরিবর্তনের হার । যদি M(q) মেমরিস্টেন্স (memeristance) হয় , তাহলে ,

M(q) = dF / dq . . . . . . . (1)
ফ্যারাডের ম্যাগনেটিক ইনডাকশন সূত্র থেকে আমরা জানি ,
V = dF / dt
(1) থেকে , M(q) = [ dF / dt ] / [dq / dt]
= V / I . . . . . . (2)

(2) থেকে বলা যায় , মেমরিস্টর বা মেমরি রেজিস্টান্স হল চার্জ নির্ভর রোধ ।

R(t)= V(t) / I (t) . . . . . . (3)

(2) ও (3) থেকে দেখা যাচ্ছে , যদি M[q(t)] ধ্রুব (constant) হয় তাহলে (2) ও (3) সমতুল্য । তখন (2) বিভব (voltage) ও তড়িৎ প্রবাহের (current) মাঝে সরলরৈখিক সম্পর্ক দেখাবে ।

কিন্তু q(t) সময়ের সাথে পরিবর্তনশীল এবং একই সেজন্যে M[q(t)] । (2) কে লেখা যায় ,

V(t) = M[q(t)] * I(t) . . . . . . (4)

(4) থেকে বলা যায় , মেমরিস্টর ততক্ষন v ও I এর মাঝে linear সম্পর্ক দেখাবে যতক্ষন চার্জ পরিবর্তন হচ্ছে না ।

কিন্তু বিদ্যুত প্রবাহ শূন্য না হলে চার্জের একটি পরিবর্তন থাকবেই । [I = dq / dt] এটাকে সাধারন রোধের সাথে স্মৃতি-রোধের [memristor] এর পার্থক্য বলা যেতে পারে ।


AC (alternating current ) এর ক্ষেত্রে ব্যাপারটি একটু ভিন্ন । মেমরিস্টরের একটি বৈশিষ্ট্য হল , একদিকে চার্জের প্রবাহ এর রোধ বৃদ্ধি করে আর বিপরীত দিকে প্রবাহ এর রোধকে কমিয়ে দেয় । ফলে এটা বলা যায় যে মেমরিস্টর চার্জের প্রবাহকে ‘মনে রাখে’ ।

(4) থেকে দেখি , যখন বিদ্যুত প্রবাহ থেমে যাচ্ছে , তখন M[q(t)] =ধ্রুব । এখান থেকেই একে মেমরী হিসেবে ব্যবহার করার প্রসংগ চলে আসে । কারন যখন পাওয়ার চলে যাচ্ছে , তখন মেমরিস্টর তার শেষ অবস্থা ধরে রাখে ।




মেমরিস্টরের সুবিধাঃ

১) খুব কম জায়গা দখল করে ।
২) একবার পাওয়ার চলে গেলে মেমরিস্টর তার আগের অবস্থা ধরে রাখে ।
৩) খুব কম জায়গাতে অনেক বেশি মেমরি তৈরি করা যায় ।
৪) এর তথ্য প্রবাহের গতি অনেক বেশি বলে RAM হিসবেও ব্যবহার করা যাবে ।



সম্ভবনাঃ

মেমরিস্টর কে কাজে লাগাতে পারলে , দ্রুত bootable , হাইস্পিড , উচ্চধারন ক্ষমতা সম্পন্ন কম্পিউটার তৈরি করা সম্ভব । বর্তমানে কম্পিউটার গুলোতে যে RAM ব্যবহার করা হয় , তাতে প্রতিবার কম্পিউটার অন করলে RAM এ নতুন করে লোড করতে হয় সিস্টেম কে । মেমরিস্টর যেহেতু আগের অবস্থা কে ধরে রাখতে পারে , তাই কম্পিউটার সরাসরি আগের অবস্থায় চলে যাবে । [আমাদের দেশে বিদ্যুতের যে অনস্থা , তাতে এই জিনিস এখনি প্রয়োজন !]


RAM ও Hard-Disk এর বিকল্পঃ

এখন কম্পিউটারে দুই ধরনের মেমরি ব্যবহার করা হয় । বিভিন্ন প্রোগ্রাম বা কাজ করার জন্যে RAM এবং স্থায়ী সংগ্রহে জন্যে হার্ড-ডিস্ক । কোন কাজ করার জন্যে hard-disk থেকে প্রথমে RAM এ আসে অস্থায়ী ভাবে , এর পরে প্রগ্রাম অনুযায়ী কাজ হয় । হার্ড-ডিস্কে তথ্য আদান প্রদান করার কাজটা পর্যাপ্ত দ্রুততার সাথে করা যায় না , অন্যদিকে RAM এর মেমরি যথেষ্ট বেশি নয় – এই দুইটি কারনে দুই ধরনের মেমরি প্রয়োজন হয় ।

মেমরিস্টর এই দুইটিকেই প্রতিস্থাপন করতে সক্ষম । মেমরিস্টর ব্যবহার করে উচ্চ-ঘনত্বের মেমরি তৈরি করা সম্ভব , যার তথ্য প্রবাহের গতি অনেক বেশি । উদাহরন হিসেবে বলা যায় , একক বর্গ সেন্টিমিটারে মেমরিস্টরের ব্যবহারে ১০০GB মেমরি তৈরি করা যায়, যা সর্বশেষ আবিষ্কৃত ফ্লাশ ড্রাইভে 32 GB মাত্র । অচিরেই আমরা কেবল এক ধরনের মেমরির কম্পিউটার দেখতে পাব বলে আশ করা যায় ।



Artificial Intelligence:


মেমরিস্টর আবিষ্কারের ফলে মানব মস্তিষ্কের অনুরূপ কিছু তৈরি করা সম্ভব বলেই গবেষকরা আশা করছেন । বর্তমানে অনেক বড় আর অসম্ভব রকমের প্রোসেসিং পাওয়ার ব্যবহার করে কোডিং বা প্রোগ্রামিং করে যতটুকু অগ্রগতি এসেছে , তা আসলে মানব মস্তিষ্কের অতি নগন্য অংশ মাত্র । আসলে সিমুলেশন প্রোগ্রাম করে মস্তিষ্কের মত কিছু তৈরি করা এখন পর্যন্ত সায়েন্স ফিকশান হয়েই আছে ।

হার্ডওয়্যার-ও যদি সাহায্য করে তবে এই ক্ষেত্রে জটিলতা কমে আসবে । এখানেই আবারো মেমরিস্টর পালন করতে পারে গুরূত্বপূর্ন ভূমিকা । কারন সেই অতীতকে মনে রাখার ক্ষমতা । মেমরিস্টরের ব্যবহার তাই হয়ত কল্পকাহিনী গুলোকে অচিরেই বাস্তবতার পর্যায়ে নিয়ে আসবে ।




অন্যান্যঃ


Signal Processing , Neural Network , Programming Logic , Control System – এসব ক্ষেত্রে মেমরিস্টর ব্যবহার করে এর মাঝেই কিছু পেটেন্ট নেওয়া হয়ে গেছে । আশা করা যাচ্ছে সামনের দিনগুলোতে এই খাত গুলো আরো সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে ।



শেষের কথাঃ



মেমরিস্টরের ধারনা এবং ব্যবহার এখনো শিশুকাল অতিক্রম করেনি । এখনো প্রচুর গবেষনা বাকি । মেমরিস্টর নিয়ে এখনো তেমন সার্কিট ডিজাইন হয় নি , মডেল তৈরি হয় নি । বিভিন্ন কাজে ব্যবহারের জন্যে প্রয়োজনীয় টুলস এখনো তৈরি হয় নি । তবে বিজ্ঞানের এই যুগে এসব সমস্যা মেমরিস্টরের বিশ্ব জয়ে তেমন কোন বাধা হয়ে না দাড়ানোর ই কথা । সেদিন আর খুব দূরে নয় যেদিন মেমরিস্টরের সফল ব্যবহারে গুরূত্বপূর্ণ কাজে সিদ্ধান্ত দিবে কম্পিউটার , নিজের ভুল শুধরে নিবে নিজেই , কাজে লাগাবে অভিজ্ঞতাকে । আমরা পাব instant-bootable হাই-স্পীড কম্পিউটার ; যা আক্ষরিক অর্থেই হয়ে উঠবে আমাদের সহকারী । আমরা সেই দিনের অপেক্ষায় থাকলাম ।




[
নতুন আবিষ্কার কে সহজ ভাবে উপস্থাপনা করাটাই এই লেখাটির উদ্দেশ্য । সেজন্যে কেবল মূল ধারনা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে ।

এই লেখাটি একটি বিজ্ঞান ভিত্তিক ম্যাগাজিনের জন্যে তৈরি করা হয়েছিল । কিন্তু আমরা ম্যাগাজিনটি প্রকাশ করতে পারিনি শেষ পর্যন্ত । মেমরিস্টর সম্পর্কে পোস্টে দেওয়া কোন তথ্য যদি আপডেট হয়ে থাকে তাহলে জানাবার জন্যে বিনীত অনুরোধ করা হচ্ছে । ]


সূত্রঃ

http://en.wikipedia.org/wiki/Memristor এবং IEEE অফিসিয়াল সাইট
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে এপ্রিল, ২০১০ ভোর ৬:১৮
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।

লিখেছেন সাইয়িদ রফিকুল হক, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:১৫



ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।
সাইয়িদ রফিকুল হক

বিএনপি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে দেশে অনুষ্ঠিত “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে”-এ অংশগ্রহণ করেনি। তারা এই নির্বাচনের বহু আগে থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×