শাল বাইম এর বদলে কুঁইচা......
বাইম মাছ খুব সুস্বাদু একটি মাছ। আমাদের দেশে সাধারণত দুই ধরনের বাইম মাছ পাওয়া যায়। একটা তারা বাইম/গুছি বাইম ইংরেজিতে বলে Star Baim। অন্যটার নাম শাল বাইম ইংরেজিতে বলে Tire-track Eel, বা Marbled spiny Eel)- যা দেখতে কিছুটা কুঁইচার মতো। বাজারে বাইম মাছ বেশ দামী মাছ। বড়ো সাইজের তারা বাইম কেজি ৬০০-৯০০ টাকা। আর শাল বাইম সাইজ ভেদে ৯০০--১২০০ টাকার কেজি বিক্রি হয়।

আপনি বাইম মাছ খেতে পছন্দ করেন?
কিছুদিন আগে স্বপরিবারে একটা কাজে রাজধানীর পূর্বাচল গিয়েছিলাম। এখানেই একটা এলাকা "তিনশো ফুট" নামে বহুল পরিচিত। খুব সকাল বেলা ওখানে দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির তাজা মাছের অস্থায়ী হাট বসে। আমরা মাছের হাটে গেলাম। এখানকার বাজারে বিভিন্ন রকম মাছের সাথে কুইচা মাছের আমদানি এবং বিক্রি বেশ ভালো। আমাদের সংগী স্থানীয় একজনের কাছে জানতে চাইলাম- কুইচা মাছ কারা কেনে? জবাবে জানালো- "এইসব হোটেল রেস্তোরায় হরদম কুইচা মাছ বিক্রি করে বাইম মাছ বলে! তা ছারা এই এলাকার কাছাকাছি ময়মনসিংহের গারোরা ছাড়াও অনেক উপজাতির লোকেরা থাকে- তারাই বেশী কেনে।"

শাল বাইম মাছের ছবি।
আমাদের দেশে খাদ্য সামগ্রী মানেই শতভাগ ভেজাল। মাছের বেলাও তার ব্যতিক্রম নয়। চাষ করা মাছ আপনাকে নদীর মাছ বলে গছিয়ে দিবে। শাল বাইমের নামে হোটেল রেস্তোরাঁয় কুঁইচা(Asian swamp Eel)
খাওয়াবে। কারণ, শাল বাইম মাছের কেজি যেখানে গড়ে হাজার টাকা, সেখানে কুঁইচার কেজি দুইশো থেকে আড়াইশো টাকা। বাইম মাছ দুস্পাপ্য হলেও কুঁইচা সহজলভ্য। শাল বাইমের যেভাবে চামড়া ছাড়িয়ে রান্না করা হয়, কুঁইচারও একইভাবে চামড়া ছাড়িয়ে নেওয়া হয়। চামড়া ছাড়ানোর পর শাল বাইম আর কুঁইচার পার্থক্য করা মোটেই সহজ নয়।

তারা বাইম মাছের ছবি।
কুঁইচা সাধারণত মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা খায়না। সাপের মত দেখতে কুঁইচা আঁশ যুক্ত মাছ। কুঁইচার বৈজ্ঞানিক নাম Monopterus cutchia. মিঠা পানি এবং নরম কাদার এই মাছটি পাওয়া যায় উপমহাদেশ সহ বেশ কিছু দেশে। চীন-তাইওয়ান কুঁইচার সবচেয়ে বড় বাজার। তবে দক্ষিন কোরিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, মালেশিয়া, ইন্দোনেশিয়াতেও কুঁইচার ভাল বাজার আছে।
আমাদের দেশে কুঁইচা মূলত 'ট্রাইবেল ফুড' হিসেবে সুপরিচিত। তবে অ-আদিবাসীদের মধ্যেও অনেকে কুঁইচা খেয়ে থাকে। কুঁইচা সুস্বাদু এবং ভিটামিন, মিনারেল সমৃদ্ধ। বেঁচে থাকার জন্য মানব শরীরে যে ছয়টি উপাদান প্রয়োজন, এগুলি হলঃ- প্রোটিন, ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট, ভিটামিন, মিনারেল এবং পানি। এই প্রত্যেকটি উপাদানে ভরপুর কুঁইচা মাছ। এমন গুণধর মাছ সম্ভবত খুব বেশি নেই।
(১) কুঁইচা মাছের মধ্যে থাকা প্রোটিন এবং কার্বোহাইড্রেট থেকে প্রচুর ক্যালরি পাওয়া যায়।
(২) আছে ওমেগা-6 এবং ওমেগা-3 ফ্যাটি এসিড,পলি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট,মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং স্যাচুরেটেড ফ্যাট।
(৩) কোলাইন, প্যান্টোথিনিক এসিড, ভিটামিন বি-12, বি-6, ই, সি, রাইবোফ্লোবিন, নিয়াসিন, ফোলেট নামক ভিটামিন।
(৪) ফসফরাস, পটাসিয়াম, সোডিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন, ক্যালসিয়াম, সেলিনিয়াম,বজিংক এবং ম্যাঙ্গানিজ নামক মিনারেলস।
কুঁইচা মাছ সম্পর্কে হ্যামিলটন নামে একজন বিজ্ঞানী প্রথম আলোকপাত করেন ১৮২২ সালে। পরে এর আরও অনেক গুণাগুণ আবিস্কার হলেও ২০১২ সালে বাংলাদেশ এগ্রিকালচার ইউনিভার্সিটি কুঁইচা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করে। বাংলাদেশে কুঁইচার ব্যাপক ব্রিডিং টেকনোলজি এবং শুকনো করার পদ্ধতি এদেরই গবেষণালব্ধ ফল। বাংলাদেশ থেকে বছরে প্রায় দুইশত শত কোটি টাকার কুঁইচা-কাঁকড়া রপ্তানি হয় বিভিন্ন দেশে। কাকড়া কুচিয়া রপ্তানিতে রপ্তানি কারকদের সরকার ১০% ক্যাশ ইন্টেন্সিভ দিচ্ছে!
কুঁইচার ঔষধি গুণ এবং পুষ্টি গুণ অসাধারন। বিশ্ববিখ্যাত মেডিক্যাল জার্নাল ল্যানসেট প্রচার করেছেঃ-
স্বাস্থ্য উদ্ধার, রোগ প্রতিরোধ, উচ্চ রক্তচাপ কমাতে, কোলেস্ট্রল, ডায়াবিটিস রোধে, আর্থাইটিস, মাসিক স্রাবের যণ্ত্রনায়, কুঁচকে যাওয়া চামড়া এবং স্তন ক্যানসারে কুঁইচা মহৌষধ প্রায়। বিশেষ করে মস্তিষ্কে রক্ত সন্চালন দ্রুত করতে এর জুড়ি নেই।
আমাদের দেশের সকল আদিবাসী/ উপজাতিদের জীবন চর্চার খাদ্য তালিকায় কুঁইচার ব্যবহার শত-শত বছরের পুরানো। তুলনায় বর্তমান বৈজ্ঞানিক আবিস্কার একেবারেই সাম্প্রতিক। আদিবাসী মানুষজন মূলত রক্তাল্পতা এবং স্বাস্থ্য উদ্ধারের প্রয়োজনেই কুঁইচা মাছকে খাদ্য হিসেবে যুগযুগ ধরে ব্যবহার করে থাকেন।
হাজং, মুরং, সাঁওতাল ছাড়াও অনেক আদিবাসী/উপজাতিদের টোটেম বিশ্বাসও এই কুঁইচা মাছ। আবার সাঁওতালদের ঝুমুর গানেও আছে,
"বিহাই খাঞে লে হে
মাছের কোল,
বিহাইনে রাঁইধেছে
কুঁইচার ঝোল।"
(তারা বাইম মাছের ছবি নিয়েছি গুগল থেকে)
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই অক্টোবর, ২০২৪ বিকাল ৫:৪০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




