সম্রাট অশোক পূত্র কুণাল এবং স্ত্রী তিষ্যরক্ষিতার কাহিনীঃ
প্রায় দুহাজার বছর আগের ঘটনা। ভারতের মৌর্য রাজবংশের তৃতীয় সম্রাট অশোক। সম্রাট অশোকের পাঁচজন পত্নী ছিলেন। ক্রমানুসারে তাদের নামঃ দেবী, কারুবাকি, পদ্মাবতী, অসন্ধিমিত্রা এবং তিষ্যরক্ষিতা। বৌদ্ধ গ্রন্থ ‘মহাবংশ’ এবং ‘দিব্যাবদান’ অবশ্য অশোকের শেষ ‘অগ্রমহিষী’কে ‘তিষ্যরক্ষা’ বলে অভিহিত করেছে। পালি সাহিত্য এই তিষ্যরক্ষার কামকিংবদন্তীতে ভরা। কারণ, তিষ্যরক্ষা/ তিষ্যরক্ষিতা নাকি অতিশয় কামুক ছিলেন। সম্ভবত ইংরাজিতে ওনার বিশিষ্টতা বোঝাতে ‘নিম্ফোম্যানিয়াক’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।
তিষ্যরক্ষিতার সঙ্গে বয়সে সম্রাট অশোকের অনেক ব্যবধান ছিল। বাস্তবে তিষ্যরক্ষিতা, সম্রাটের চতুর্থ পত্নী অসন্ধিমিত্রার পরিচারিকা ছিলেন। ওনার রূপ- যৌবন দেখে অশোক ওনাকে নিজ রানীর স্থান দেন।
অশোকের প্রথম দুই সন্তান মহেন্দ্র এবং সঙ্ঘমিত্রা- যারা বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হয়ে ‘ধর্ম’ প্রচারের জন্য সিংহলে যান। সম্রাটের অন্য দুই পুত্র তীবর এবং জলৌক। তবে সম্রাটের প্রসিদ্ধতম পুত্র ছিলেন কুণাল, তৃতীয়া রানি পদ্মাবতীর সন্তান কুণাল। সর্বাপেক্ষা মেধাবী এবং সুদর্শন পূত্র সন্তান। সম্রাট মনে মনে কুণালকেই নিজের উত্তরাধিকারী হিসাবে চয়ন করে ছিলেন।
কুণালের চোখ দুটো অপরূপ সুন্দর ছিল। ‘কুণাল’ শব্দের অর্থ সুন্দর নেত্রের ব্যক্তি। তিষ্যরক্ষিতা এবং কুণাল ছিলেন সমবয়সী। এক্ষেত্রে এটাই স্বাভাবিক যে কামাতুরা তিষ্যরক্ষিতা কুণালের প্রতি আকৃষ্ট হবে। কিন্তু সম্রাট অশোকের পত্নী হবার ফলে কুণাল তাঁকে ‘মাতা’ সম্বোধন করতেন। কুণালের নিজপত্নী কাঞ্চনমালার সঙ্গেও কুণালের প্রেম ছিল প্রগাঢ়। কিংবদন্তী আছে, তিষ্যরক্ষিতা কুণালের সমক্ষে প্রণয় প্রস্তাব করেন। ইজ দিস টু এবনর্মাল, বাট ইট ওয়াজ রিয়ালিটি! কুণাল সেই প্রস্তাবে অসম্মতি প্রকাশ করেন। মনাহত তিষ্যরক্ষিতা তখন অশোকের সীলমোহর চুরি করে রাজাদেশ জারি করালেন, যে কুণালের চক্ষু উৎপাটিত করা হোক। আদেশ পালিত হল। সম্রাট অশোক প্রকৃত সত্য জানতে পেরে তিষ্যরক্ষিতাকে জীবন্ত অবস্থায় আগুনে পুড়িয়ে মারার নির্দেশ দেন এবং সেই নির্দেশ পালন করা হয়। পবর্তীতে কুণালের পুত্র সম্প্রতি কে পরবর্তী মৌর্য সম্রাট ঘোষণা করা হয়।
কুণাল এবং তিষ্যরক্ষিতার এই কাহিনির অনেক সংস্করণ পাওয়া যায়। অনেক পণ্ডিত এই ব্যাপারে একমত হন, যে সম্রাট অশোক কুণালকে তক্ষশীলার দেখাশোনা করার দায়িত্ব দেন, কিন্তু এই বিষয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে যে কুণাল কি কখনও মৌর্য সাম্রাজ্যের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন? মিথিলার কোশী নদীর তীরে কুণৌলি (পূর্ব নাম কুণাল গ্রাম) নামক গ্রাম আছে এবং গ্রামবাসীরা মনে করেন যে কুণাল একটি সমান্তরাল সাম্রাজ্য স্থাপন করেছিলেন।
তিষ্যরক্ষিতার মৃত্যুর কারণ এবং বিধি নিয়েও অনেক কিংবদন্তী প্রচলিত আছে। কিন্তু যেসব বিষয়বস্তুগুলি নির্বিবাদ, তা হল "তিষ্যরক্ষিতা ছিলেন সম্রাটের সবথেকে যুবা পত্নী, তিনি রাজপুত্র কুণালের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন এবং ওনার চাতুর্যের ফলেই কুণালের চোখ উপড়ে ফেলা হয়।" ইতিহাস যাকে ‘তথ্য’ রূপে স্বীকৃতি দেয়, লোকাপবাদ যাকে ‘কলঙ্ক’ বলে চিনহিত, সাহিত্য তাকেই সংবেদনশীলতা নিয়ে মূল্যায়ন করে। রামকুমার বর্মার একাঙ্ক নাটক ‘চারুমিত্রা’, জয়শঙ্কর প্রসাদের কাহিনি ‘অশোক’ তিষ্যরক্ষিতাকেই মুখ্য চরিত্র হিসাবে তুলে ধরেছে।
শ্রী নরেশ মেহতার একটি অদ্ভুত কাহিনী আছে, ‘তিষ্যরক্ষিতা কি ডায়েরি’। সেখানে কিন্তু তিনি তিষ্যরক্ষিতার পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন। হিন্দি সাহিত্যে অদ্ভুত সহানুভূতি পেলেও বাংলায় সে সুযোগ তিষ্যরক্ষিতা পাননি। কৃষ্ণবিহারী সেনের ‘অশোক চরিত’ নাটকে আবার তিষ্যরক্ষিতা ‘লক্ষ্মীছাড়া’ অভিধা পেয়েছেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর 'কাঞ্চনমালা'তেও ওনার চরিত্রের দিকে আঙুল তোলা হয়নি। অমিত মৈত্রর নাটক 'ধর্মাশোক' এবং সমরেশ মজুমদারের উপন্যাসিকা ‘শরণাগত’তে তিষ্যরক্ষিতাকে অদ্ভুত দোলাচলে এঁকেছেন। মাঝেমধ্যেই ভ্রম হয় তিনি নায়িকা, পরক্ষণেই বুঝি খলনায়িকা। অন্তিমক্ষণও বড় মেদুর করে তুলেছেন। ফাঁসি দিয়ে গ্রীবা ভঙ্গ করার পর রাজকুমার কুণাল অন্তিম দৃশ্যে তিষ্যরক্ষিতার বুকে কান রেখে হৃদস্পন্দন শোনার চেষ্টা করছেন। সে কী তবে প্রেমই ছিল, দুই অভিমুখেরই প্রেম ছিল? অব্যক্ত প্রেম? কামনা ছিল অবদমিত?
মনোবিজ্ঞানগত দিক থেকে তিষ্যরক্ষিতার চরিত্রের তিনটি কথা স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। প্রথমত, নিজের যৌন আকাঙ্ক্ষার অকুন্ঠ স্বীকৃতি। দ্বিতীয়ত, ঈর্ষা এবং প্রতিশোধের সুতীব্র বাসনা। আর তৃতীয়ত, রাজক্ষমতার দোহন করে নিজ স্বার্থ সিদ্ধি। মুন্সী প্রেমচন্দের উপন্যাস ‘নির্মলা’ কিংবা রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস ‘নষ্ট নীড়’-র নায়িকারাও এমন পুরুষের প্রতিই আকৃষ্ট হয়েছিল, যারা বয়সে সমান হওয়া সত্ত্বেও সম্পর্কে পুত্র কিংবা অনুজ সম্বন্ধীয় কেউ ছিল। কিন্তু ‘মাতা’ সম্বোধন করা সত্ত্বেও কুণালের কাছে ওই প্রণয় প্রস্তাব এমনই এক স্পর্ধা প্রদর্শন করেছিল যা ভারতইতিহাসে বিরল। নিজের সুতীব্র যৌন আকাঙ্ক্ষার অমন বহিঃপ্রকাশ দুর্লভ! প্রায় দুহাজার বছর আগের এই রমণীর অভিব্যক্তি প্রকাশের ক্ষমতার কথা ভাবুন। অপবাদকে তিনি ভয় করতেন না। কুণালের ক্ষেত্রে নিশ্চিত সেই মুহূর্ত ‘অয়দিপাস মোমেন্ট’ ছিল। সম্ভবত (!) কোনও দ্বিধা কুণালের মনে না থাকায় তিনি সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। ব্যস, তিষ্যরক্ষিতা ক্রোধে জ্বলে ওঠেন।
প্রণয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার মত বড় অপমান খুব কমই আছে। সম্ভবত নারীদের ক্ষেত্রে এই অপমান আরও বেশি হয়ে থাকে। কিছু সামাজিক এবং মনোবিজ্ঞানভিত্তিক কারণ আছে। নারী প্রণয় প্রস্তাব দিলে কখনওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হবে এটা মেনে নিতে পারে না। ঠিক এই কারনেই তিষ্যরক্ষিতা ধ্বংসযজ্ঞ রচনা করেছিলেন কুণালের জন্য, শেষে বহ্নিপতঙ্গের মত নিজেও জ্বলেপুড়ে চাই হয়ে গিয়েছিলেন।
তিষ্যরক্ষিতা মনে মনে বলেছিল, কুণাল, তোমার দুই চোখ আমার বড় প্রিয়, তুমি আমার না হলেও ওই চোখই আমি চাই। সম্রাটের সিলমোহর চুরি হয়েছিল, কিংবা রাজাদেশ দেওয়ার ক্ষমতা ন্যস্ত ছিল তাঁর উপরেই। সেই ক্ষমতার অনুচিত ব্যবহার হয়েছিল। নিজের আহত সত্তার থাবায় কুণালকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করাই ছিল তাঁর এক এবং অদ্বিতীয় লক্ষ্য। তাতে ওনার রহস্য সবার সামনে আসে। অনেক প্রত্যাখ্যাত পুরুষও কিন্তু ক্ষণিকের জন্য ‘তিষ্যরক্ষিতা’ হতে পারে। হয়েও থাকে। দিকে দিকে অ্যাসিড আক্রমণ তার প্রমাণ।
প্রেম হল আত্মার ইন্ধন, আর কামনা হল জ্বালামুখী। দুইই পরিণাম প্রদান করে। ফলাফল সকলেই জানে। সম্রাট অশোকের হাতে ছিলে ভারতের নিয়তি, কিন্তু ওনার মন আটকা পড়েছিল কলিঙ্গে। সম্রাজ্ঞী তিষ্যরক্ষিতা হতে পারতেন সম্রাট অশোকের নিয়তি, কিন্তু তাঁর মন আটকা পড়েছিল কুণালের চোখে। কুণাল হতে পারতেন এক অভিসারী প্রণয়ী, কিন্তু তিনি আটকা পড়েছিলেন সম্পর্কের জালে।
অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা ছোট গল্পে পড়েছিলাম, জমিদার দ্বিতীয় বিবাহের পর জানলেন তাঁর একমাত্র পুত্র তাঁর বিমাতাকে মনে মনে কামনা করে, আর তাঁকে ভোগ করতে না পেরে দিনে দিনে শুকিয়ে যাচ্ছে। তিনি পুত্রকে বিমাতা গমনে অনুমতি দেন। বিমাতা তাঁর পুত্রের ঔরসে সন্তানসম্ভবা হয়। যেদিন সন্তানের জন্ম হয়, সেদিন জমিদার আত্মহত্যা করেন।
সমাজে এমন অনেক অনেক জটিলতর সম্পর্ক ছিল, আছে এবং থাকবে। কিছুর পরিনতি ঘটে, কিছুর ঘটে না। লালসার রূপ বড় কুৎসিত। একজনের লালসা হয়ত অন্যের প্রেম। কারও প্রেম হয়ত কারও ঘৃণা। আর প্রেমের ঘৃণা ক্রূরতম হয়ে থাকে।
মূল ঘটনা Ashoka: The Search for India’s Lost Emperor by Charles Allen থেকে নেওয়া হয়েছে।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ-
১. প্রিয়দর্শী রাজা অশোক - অমরজ্যোতি মুখোপাধ্যায়।
৩. স্বদেশ সভ্যতা ও বিশ্ব - জীবন মুখোপাধ্যায়।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই অক্টোবর, ২০২৪ দুপুর ১:০৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




