ছিঁচকাঁদুনে....
সেই ছোট্ট বেলাতেই শুনেছি- আমি ছিঁচকাঁদুনে.... কথায় কথায় কাঁদি। আচ্ছা কেউ কখনো শখ করে কাঁদে? কান্নাতো ভেতর থেকে নিজেই ভসভসিয়ে বেরিয়ে আসে...আটকাতে পারিনা। আপনাদের অনেকেই পারেন আটকে রাখতে; কিন্তু যারা আমার দলে তাদের কেঁদেই সুখ।
খুব ছোট থাকতেই ভাই, বোন, কাজীন এমনকি পাশের বাড়ির কাউকে কিম্বা কাজের বুয়ার বাচ্চাকেও সামান্য বকা/ মার খেতে দেখলেই আমার কান্না পেতো। যারা বকা/মার খেয়েছে তারা হয়তো ফুঁপিয়ে কাঁদছে, আমি কিন্তু কাঁদতাম পাড়া মাতিয়ে। এমনকি গরু, ছাগল, কুকুর, বিড়ালকেও আমার সামনে পিটুনি দেওয়া যাবেনা, তাহলে....। একবার মামার বাড়িতে এক ছিঁচকেচোর ধরে বাড়ির গেটের সামনের খুঁটিতে বেঁধে রাখা চোরকে দেখে হাত-পা ছাড়িয়ে রাস্তায় গড়াগড়ি দিয়ে কান্না- 'ওকে ছেড়ে দাও.........'! আমার মরন কান্না থামাতে মামা বাড়ির সবাই তড়িঘড়ি করে চোরের বাঁধন খুলে দিয়ে একটা লুংগী, সুয়েটার আর পাঁচ টাকা দিয়ে চোরকে সসম্মানে বিদায় দিতে বাধ্য হয়েছিলো......
এ তো সামান্য মার কিম্বা বেঁধে রাখা দেখলে, কেউ মারা গেলে কি হত ভেবে নিন! মনে থাকার মতো জীবনে প্রথম মৃত্যু দেখেছি এক প্রতিবেশীর। মুর্দা খাটিয়ায় নিয়ে রওয়ানা দেওয়া মাত্র.......আমাকে ধরে বেঁধে বাড়ি পাঠাতে হয়েছিল। পাড়ার কেউ মারা গেলে আত্মীয় স্বজনের কান্না দেখে ওদের চেয়ে বেশী কাঁদতাম আমি। এমনকি রাস্তায় পড়া পশু পাখির দেহ পড়ে থাকলেও ...
সেই ছেলে বেলায় ছোট চাচার প্রশ্রয়ে আমাদের বাড়ীতে একজন বাউল এসে গান গাইতেন। বাউল শিল্পী যখন দরদী গলায় 'ও তোতা পাখিরে শিকল ছেড়ে উড়িয়ে দেবো- আমার মাকে যদি এনে দাও' গাইতেন তখন প্রথমে আমার চোখ চিকচিক করে উঠতো। তারপর হু হু করে কান্না বেরিয়ে আসতো আমার কারন...... আমি যে ছিঁচকাঁদুনে।
পরিবারের সবার সাথে জীবনে প্রথম সিনেমা দেখতে যাই ৭ বছর বয়েসে। আমি বুবুর হাত ধরে আছি শক্ত করে। শুরুতে পর্দায় ছবি নড়ছে, কথা বলছে দেখে খুব মজা...তারপর বুবুর কোলে মাথা রেখে ঘুম। হঠাৎ গালে গরম পানির ফোঁটা। চোখ মেলে আধো অন্ধকারেও বুঝতে পারি বুবু কাঁদছে। ব্যাস, হলভর্তি দর্শকের মধ্যে বুবু নিজের কান্না সামলাবেন না আমার? ছবির নাম সম্ভবত 'রূপবান'। অনেক গান আছে যা শুনলে, অনেক চলচ্চিত্র আছে যা দেখলে, অনেক নাটক, কবিতা-গল্প-উপন্যাস পড়লে এখনও কান্না চেপে রাখতে পারিনা। ছোটবেলায় কাঁদতাম প্রকাশ্যে, এখন কাঁদি আড়ালে- লুকিয়ে। এইতো, যেদিন আমার প্রিয় পোষা টিয়া পাখিটা মারা গেল, আমার হাতে থাকা অবস্থায়। পারিনি, চোখের পানি আটকাতে... সপ্তাহ খানেক শুধু কেদেছিলাম।
আমাদের ছেলে বেলা কেটেছে বৃহত্তর যৌথ পরিবারে। মেঝো চাচার বদলির চাকরি......চাচাতো ভাই- মোহন আমার চাইতে ৩ বছরের বড় হলেও আমরা দুজন মানিকজোড়। পড়তে বসা, গোসল, খাওয়া, খেলা, গল্প সবই একসাথে। হঠাত মেঝো চাচা ময়মনসিং বদলী হয়ে ওখানকার স্কুলে মোহনকে ভর্তি করে চাচী আর মোহনকে নিয়ে যাওয়ার সময় মোহন একেবারে বাকরুদ্ধ হয়ে যন্ত্রের মতন তার সব জিনিস পত্র গুছিয়ে নিতে নিতে করুন চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছিল...যেন কিছু বলতে চায়, কিন্তু পারছেনা। ঘর থেকে বেড়িয়ে স্টেশনে যাবার মুহুর্তে মরিয়া হয়ে সেই কথাটা বড়ো চাচীকে বলে ফেললো- "বড়ো চাচী, বাবাকে বলোনা আমি এখানেই থাকবো, মন দিয়ে লেখা পড়া করবো দুষ্টুমি করবোনা......"। আমার সহ্য হয়নি, আমি আর ওখানে থাকতে পারিনি........আড়াল চাই.........নীরবে কাঁদার জন্য একটা আড়াল। কারন আমি কাঁদতে না পারলে আমার কষ্ট কমবেনা।
প্রায় ৬৪ বছরে জীবনের অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়েছি, অনেক প্রিয় জনকে হারিয়েছি চিরতরে। পরিবারে রক্তের সম্পর্কীয় আমার চাইতে বড়ো সদস্য আছেন মাত্র একজন। এক এক সময় এমন আঘাতও এসেছে যখন মনে হয়েছে- বেঁচে থাকাটাই অর্থহীন! তবু আজও বহাল তবিয়তে বেঁচে আছি.........ভবিষ্যতের দিকে নিশ্চিন্ততার সঙ্গে এগিয়ে চলেছি। কারন, আমি পাষাণ নই, আমি কাঁদতে পারি, আমি ছিঁচকাঁদুনে; চোখের পানি দিয়ে সব দুঃখকে ধুয়ে ফিকে করে দিতে পারি। আমি কাঁদবো.....
....সাত বছরের নাতনীর পুতুলের হাত ভেংগে যাওয়ায় নাতনীর কান্না দেখে নাতনীর সাথে আমিও কাঁদবো,
যে কারোর দুঃখে কাঁদবো, মৃত্যুতে কাঁদবো, রেগে গিয়ে কাঁদবো, আনন্দে কাঁদবো, ভালোবেসে কাঁদবো..... কাঁদবো লুকিয়ে লুকিয়ে..... বড় হয়েছি না, তাই কান্নাকে সবার সামনে আনা যাবেনা। তারপরও কেউ কাঁদতে দেখে ফেললে বলবো- "না মানে ইয়ে, চোখে মনে হয় কিছু পড়েছে"।
আমি ছিঁচকাঁদুনে থাকবো চিরকাল, আজীবন।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই অক্টোবর, ২০২৪ সকাল ১০:২৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




