পিকাসো-জিলোর প্রেম এবং যৌনতা....
বিংশ শতাব্দির শ্রেষ্ঠ শিল্পী কে? এই প্রশ্ন করা হলে তর্কসাপেক্ষ পাবলো পিকাসোর নামটা আসবে। পুরো নাম- পাবলো রুইজ পিকাসো।
কেউ তাঁকে শ্রেষ্ঠ মানবেন, কিংবা মানবেন না, কিন্তু তর্ক হবে। এই পাবলো পিকাসো, যিনি এমন ধারণাকে নস্যাৎ করে দিয়েছেন যে, শিল্পী তাঁর সমকালে কদর পান না, কিংবা প্রকৃত শিল্পী কোনোদিন ধনকুবের হন না। তাঁর ছবি আঁকার যে অপ্রতিরোধ্য প্যাশন, সেটার উৎস কী? এটা অবশ্যই ঘটনা যে, পিকাসো কোনো প্লেবয় ছিলেন না, নারীর প্রতি কোনোরকম ন্যূনতম অশ্রদ্ধা তাঁর ছবির মধ্যে কোনোদিন দেখা যায়নি, নারীকে তিনি ভয়াবহ রূপে চিত্রায়িত করলেও কোনোভাবে সেই ছবির মধ্যে কোনো ইতরতার সন্ধান পাওয়া যায় না। ‘পিকাসো’ যে তাঁর নাম, সেই নামের উৎস ছিল তাঁর মায়ের নামের শেষাংশ। ১৮৯৬-এ বালকবেলায়, অর্থাৎ পনের বছর বয়সে আঁকা তাঁর ছবি ‘ফার্স্ট কমিউনিয়ন’-এ তাঁর বোন লোলা ছিলেন মডেল।
তাঁর ছবির প্যাশনের প্রধান উৎস ছিল নারীর শরীর, নারীর দেহ। এই যে শরীর আর দেহ- দুটো শব্দ। কিন্তু ‘দেহ’ শব্দটার মধ্যে যে প্যাশনের উদ্ভাস আছে, তা শরীরের নেই। শরীরের অসুখ করে, দেহের জন্য অপেক্ষায় থাকে কেবল সুখ, কেবল পুলক। দেহের অসুখ করে না, দেহের মনখারাপ হয়।
পিকাসো একজন প্রেমিক ছিলেন নারীর দেহের। নারীর পরিপূর্ণ দেহই তাঁর মনখারাপের ঔষধ ছিল। এখানে যদি কোনো বাঙালিনী নাক ছিটকে বলে ওঠেন- ‘এমা! কী বিশ্রী লোক!’- তাহলে কিছু বলার থাকে না। নারীকে দেখার পাপে ইন্দ্রের দেহে এক হাজার চোখ হয়েছিল। নারীকে স্পর্শের তাপে মৃত্যু হয়েছিল মহাভারতের পাণ্ডুর। একবার যদি খাজুরাহোতে যাওয়া যায় তাহলেই বোঝা যায় পিকাসোর নৈতিকতা আমাদের অতীতের সঙ্গে যথেষ্ট সামঞ্জষ্যপূর্ণ। আর আমাদের বর্তমান? সেদিন দেখলাম প্রেমিক প্রেমিকার ঘাড় ও কাঁধে হাত রেখেছেন আর এক বান্ধবী তাদের ছবি তুলে দিচ্ছেন; বান্ধবীটি নির্দেশ দিচ্ছেন- ‘এক্সাইট করার জন্য যেমন কানে হাত বোলায় তেমন করো...”! আমাদের দেশও দ্রুত বদলাচ্ছে।
১৯৪৩-এ ফ্রাঁসোয়া জিলো নাম্নী একুশ বছরের এক নারীর সঙ্গে পিকাসোর পরিচয় হয়। পিকাসোর বয়স তখন বাষট্টি। এই বয়সে আমাদের অনেক পুরুষ বাণপ্রস্থের কথা চিন্তা করেন। মজার ব্যাপার হল, পিকাসোর কথা অনুসারে, জিলোর সঙ্গে দেখা হওয়ার আগেই নাকি তিনি জিলোকে এঁকে ফেলেছিলেন। পরে ফ্রাঁসোয়া জিলোকে স্বচক্ষে দেখার পরে নিজের সেই ছবির মানুষটিকেই তিনি খুঁজে পান। যাই হোক, যেটা পুরুষের রীতি, দেখা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পিকাসোর চিন্তায় এল জিলোর তরুণী দেহ এবং জিলোকে সেক্স করার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু এই রমণীর সঙ্গে শোওয়ার ব্যাপারটা আদৌ সহজ ছিল না। জিলো একজন প্রকৃত বিদুষী নারী। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে তিনি নিজের গুণেই সুপরিচিত। পিকাসোর প্রথম সন্তান পাওলোর চেয়েও এই নারী নয় মাসের ছোট ছিলেন। সর্বোপরি, জিলো তখনও অবধি কারও সঙ্গে সেক্স করেননি। পিকাসো লেগে থাকলেন। অনেক চেষ্টার পর জিলো এলেন শতাব্দির শ্রেষ্ঠ চিত্রশিল্পীর বিছানায়। এই ঘটনা পিকাসোকে নবজীবন দিল। তাঁর ছবি আঁকার আরেকটা নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হল।
এটা ব্যাপার যে, পিকাসোর চিত্রজগতে পর্বের পর পর্বান্তর হয়েছে একের পর নারীর আগমনে ও নির্বাসনে- একজন এসেছেন, আগের জন বিদায় নিয়েছেন। এই ঘটনা আমাদের সমাজে খুবই ন্যক্কারজনক মনে হতে পারে, কিন্তু পিকাসোর জীবনে এ ঘটনা নির্মল আকাশে মেঘের আনাগোনার মতোই স্বচ্ছ আর স্বাভাবিক। ফ্রাঁসোয়া জিলো এলেন, আর চিরতরে ভেঙে পড়লেন পিকাসোর আরেক পূর্ব প্রেমিকা ডোরা মার। ডোরা মার পাগল হয়ে গেলেন, কারণ পিকাসো ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পুরুষকে ডোরা তাঁর শরীরে আর আত্মায় গ্রহণ করেননি।
জিলোকে নিয়ে পিকাসো সময় কাটাতে গেলেন ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে একটি রিসর্টে, যে অঞ্চলের তাপমাত্রা পিকাসোর যৌবনের মতোই চিরনবীন। কিন্তু সেখানে হানা দিলেন পিকাসোর আরেক পূর্বপ্রেমিকা ওলগা। এই দুই নারীর মধ্যে কলহ শুরু হল, মারামারিও শুরু হল
এ ঘটনা পিকাসোকে বিরক্ত করল না। বরং ষাটোর্দ্ধ বয়সেও যে দুই নারী তাঁর দেহের মালিকানা চেয়ে কামড়াকামড়ি করছেন, এ ঘটনা পিকাসোর কাছে তৃপ্তিদায়ক ছিল। সেই তৃপ্তি একজন দাম্ভিক পুরুষের নয়, সে তৃপ্তি এক এমন মানুষের যাঁর যৌন মানসিকতা কোনোদিনই বয়ঃসন্ধিকে অতিক্রম করেনি, এবং তাঁকে সতেজ রেখেছে শিল্পের দরবারে। এই ছেলেমানুষিটুকু বাঁচিয়ে রেখেই হয়ত পিকাসো বৃদ্ধ বয়সেও তুমুল যৌনতাআক্রান্ত একের পর এক এচিং আঁকতে পেরেছিলেন, যেগুলোর মধ্যে নিজের উপভোগক্ষমতাশূন্য যৌনতাকে উদযাপন করছেন এক বৃদ্ধ শিল্পী, এবং যেগুলোর সামনে দাঁড়ালে কিছু দর্শকের কান গরম হয়ে যেতে পারে।
জিনিয়াসের সঙ্গে ঘর করা খুব সুখকর অভিজ্ঞতা প্রায়ই নয়। বিয়ে তাঁরা করলেন না। একত্রে ঘর বেঁধেও জিলোকে সেই দাম সমানভাবেই দিতে হচ্ছিল। কেবল অপরিমেয় সেক্স নয়, পিকাসো চাইতেন রোজ সকালে জিলো তাঁর ঘুম ভাঙ্গাবেন তোয়াজ করে এবং তারপর তাঁর কানে কানে বলবেন পিকাসোই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম শিল্পী। এই উচ্চারণ তাঁর সেদিন শোনা প্রথম কথা হবে। এছাড়া পিকাসো খুবই কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছিলেন। তাঁর নখ যদি কোনো নাপিত কাটে সেটা সংগ্রহ করে কেউ কেউ তাঁর উপরে তুকতাক করতে পারে, তাই নখা কাটার ভার থাকত জিলোর উপর। অন্যদিকে জিলোর ছবি কিনতেও পিকাস শিল্পসংগ্রাহকদের বাধ্য করছেন তখন। ‘নারীপুষ্প’ নামক বিখ্যাত ছবিটি জিলোকে নিয়েই আঁকা। বিশ্ববিশ্রুত ‘গ্যেরনিকা’ ছবিতে যে ক্রন্দনরত নারীমুখ আমরা দেখতে পাই, তিনি আসলে ফ্রাঁসোয়া জিলো।
ফ্রাঁসোয়া জিলো পিকাসোর দুটি সন্তানের জন্ম দেন। ছেলে ক্লদ এবং মেয়ে পালোমা। পিকাসোর যৌনজীবন একসময় জিলো বরদাস্ত করতে পারলেন না। তাঁর মধ্যে দেখা দিল আসন্ন বিচ্ছেদের ইচ্ছা ও দুঃখ। ১৯৪৪ থেকে ১৯৫৩ অবধি ফ্রাঁসোয়া জিলো পিকাসোর সঙ্গে ছিলেন। এই সময়ের মধ্যে তিনি পিকাসোকে কেবল দেহ দেহ দেননি, দিয়েছিলেন অপূর্ব সাহচর্য। সেই সময়ে জিলো পিকাসোর প্রাইভেট সেক্রেটারির মতো সবরকম সহায়তা করেছেন। পিকাসোর হয়ে কথা বলার ভারও তাঁর ছিল। জিলো নিজে একজন ভালো শিল্পী ছিলেন, একজন উত্তম চিত্র সমালোচক ছিলেন। এই যে জিলোর মেধা আর বুদ্ধি, একসময় সেটাই অসহনীয় হয়ে উঠল পিকাসোর পক্ষে। নারীর কাছে কাম্য আত্মনিবেদন তিনি পাচ্ছিলেন না জিলোর কাছ থেকে। অন্য এক নারীর পিপাসা জেগে উঠছিল তাঁর মনে। সেই নারী হয়ে এলেন জ্যাকলিন রোক। বিদায় নিলেন জিলো।
তবে পিকাসোর জিলো-পর্ব সেখানেই শেষ নয়। পিকাসোকে ছেড়ে জিলো বিয়ে করেছিলেন মার্কিন জোনাস সাল্ককে। জোনাস ছিলেন একজন ভ্যাকসিন বিশেষজ্ঞ। যাই হোক, নিজের ৮৪তম জন্মদিনে পিকাসো জানতে পারলেন ফ্রাঁসোয়া জিলো ‘মাই ডেজ উইদ পিকাসো’ নামক একটি বই লিখেছেন, এবং সেই বইয়ে পিকাসোর গুণকীর্তন যেমন আছে, তেমনই তাঁর জীবনের ওই দিনগুলিতে চরম ব্যক্তিগত ও অন্ধকার দিকগুলোও জিলো ফুটিয়ে তুলেছেন খোলাখুলি। তীব্র বেদনা আর যন্ত্রণার স্পর্শ আছে বইটির পাতায় পাতায়। জিলোর কথা অনুসারে পিকাসো নিজে কোনো নারীকে তাঁর জীবনন থেকে সরিয়ে দেননি। নারীরাই সরে গেছেন পিকাসোর থেকে। তারপরেও পিকাসো চেয়েছেন এক ক্ষয়িষ্ণু অন্ধকারের মধ্যে সেইসব বিগত রমণীরা যেন তাঁকে ঘিরে থাকে। জিলোর মতানুসারে এইসব রমণীর দুর্ভাগ্য ও নিয়তিনিপীড়িত জীবনকাহিনির রচয়িতা পিকাসো ছাড়া আর কেউই নন। পিকাসো এই দায় এড়াতে পারেন না।
‘মাই ডেজ উইদ পিকাসো’ যখন প্রকাশিত হয়- পিকাসো তখন সারা পৃথিবীতে একজন নন্দিত মনীষী। তাঁর উক্তি তাঁর মতামতের গুরুত্ব অসীম। তাঁর কথা বিশ্বের মানুষ মন দিয়ে শোনে এবং তা নিয়ে সমস্ত সবুজ গ্রহটিতে আলোচনা ও আলোড়ন হয়। ‘মাই ডেজ উইদ পিকাসো’ যে তাঁর ইমেজের পক্ষে মোটেই ভাল হবে না, এটা পিকাসোকে ঘিরে থাকা বন্ধুবান্ধব এবং বিশেষ করে জ্যাকলিন রোক তাঁকে বোঝালেন।
........... পিকাসো মামলা করলেন এবং মামলায় হেরেও গেলেন। এই পরাজয় একজন শিল্পীর নয়। এই পরাজয় পুরুষের চিরকালীন পতন একজন নারীর সামনে। এতে পিকাসো ছোট নিশ্চয়ই হয়ে যান না, তবে জিলো উঠে আসেন একজন অসম্ভব শক্তিশালিনী রমণী রূপে। যিনি প্রেমে এবং সম্মানের যুদ্ধে পুরুষের কাছে নতি স্বীকার করেন না। মহান পুরুষকেও তিনি বাধ্য করেন স্খলনে।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ ‘মাই ডেজ উইদ পিকাসো’ এর ভাবানুবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে মার্চ, ২০২৩ সকাল ১১:৫৫