(হালিম আব্দুলাহ'র এই লেখাটি ভাববাদ বিষয়ক একটি আলোচনার প্রথম অংশ, ক্রমান্বয়ে বাকি অংশগুলোর পোষ্ট ব্লগে প্রকাশ হবে। এটি কুমিলার সাপ্তাহিক রোহিতগিরি'র প্রথম সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল।)
এক.
‘জগতে আনন্দ যজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ।’
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন। তাঁর সমকালের অস্থির, চিরকালের আনন্দ- বেদনার মিশ্রণ দিয়ে গঠিত পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়ে। রোগ, শোক, জরা, মৃত্যুর অনিবার্য সত্যের মুখে কুলুপ দিয়ে। বলেছিলেন অন্য মহামানবেরাও। অন্য ভাষায়, অন্য ভাবে।
মূলত জগত আনন্দেরই। সাধারণ চোখে যা কিছু নিরানন্দের তার বুকের ভিতরে আনন্দের সুহাস্য বসবাস। কেবল বুকের ভিতর নিয়ে যাওয়ার মত চোখ চাই। চোখ খুলে দেয়ার মত ‘আনন্দ মহাজনের’ সঙ্গ চাই। সেই আনন্দ মহাজন- কত নাম তাঁর! কবি, গুরু, মুর্শিদ, নবী; কখনও কখনও আল্লা, ঈশ্বর, ভগবান।
তবে বাস্তবের জীবন নিরানন্দেরই। আনন্দ যেটুকু তা নিরানন্দের অনুপস্থিতি মাত্র। নিরানন্দের ভিতর দিয়েই কোন রকমে জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া। জন্মের পর থেকেই ক্রমান্বয়ে ঋণের জালে জড়াতে থাকা। নতুন নতুন ব্যক্তি, বস্তু ও ভাবের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে করতেই জীবনের এগিয়ে যাওয়া। তাদের কাছ থেকে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় অনেক কিছু গ্রহণ করা। একদিন শোধের পালাও আসে। শোধ করতে গিয়ে দুঃখ পাওয়া। আরও বেশি করে জালে জড়ানো, আরও বেশি ঋণী হওয়া। শোধ না করলেও অন্য রকম বিপত্তি। ঋণ দাতারা একবাক্যে কোলাহল করতে থাকবে। এ কোলাহলেরই অন্য নাম তিরস্কার, অভিশাপ।
সাধারণের জীবন কাটে এ বৃত্তের পরিধির ভিতরেই। তারপর একদিন যাবার বেলা আসে। পেছনে তাকায়- দেখে অতৃপ্তি, অপূর্ণ সাধের হাহাকার। মনে হয় কী যেন করার ছিল, কিছুই করা হল না। দেখে ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতা কেহই আপনার জন নয়। নিঃসঙ্গ জীবনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কোন সঙ্গী নেই।
কিন্তু যাঁরা রবীন্দ্রনাথ, জীবনের যজ্ঞানুষ্ঠানে যারা আনন্দের আরতি গেয়েছেন- তাঁরা বলেন অন্য কথা। যাবার দিনে তাঁরা কৃতজ্ঞচিত্তে বলেন, আমি পেয়েছি, আমি দেখেছি। বাঙলার এক বাউল- রবীন্দ্রনাথেরই সমগোত্রীয় সে, ধূলিধূসর পায়ে নেচে নেচে, একতারায় সুর তুলে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে গেয়ে উঠতে পারেন সেই প্রাপ্তির গান, ‘আমি পথে পথে যা পেয়েছি তার তুলনা নাই।’ পথ এখানে ভূগোলের নক্শা কাটা নয়, ভূগোলবিহীন দেশের অনন্ত ঠিকানা।
কথা হচ্ছিল ঋণ নিয়ে, সম্পর্ক স্থাপন নিয়ে।
ব্যক্তি সম্পর্ক গড়ে ওঠে অনিবার্যভাবে। সম্পর্কগুলোর কত ধরণের নাম। বাবা-মা, ভাই বোন, বন্ধু-আত্মীয়, স্ত্রী-পূত্র-কন্যা ইত্যাদি-ইত্যাদি। জীবনের পরিসর যত বাড়ে সম্পর্কের ব্যপ্তিও ততো বাড়ে। আছে বস্তুসম্পর্কও। ঘর-বাড়ি, ধন-সম্পদ, ব্যাংক-কারখানা আরও কতো কী! ভাবের ঘরেও সম্পর্ক স্থাপন বাকি থাকে না। মান-সম্মান, আল্লা-ইশ্বর, সুন্দর-অসুন্দর, প্রেম-কাম, ধর্ম-সংস্কৃতি সব থাকে। ব্যক্তি, বস্তু, ভাব সবার কাছ থেকেই মানুষ সুখের প্রত্যাশা করে। কিন্তু প্রত্যাশিত সুখ আসে কালে-ভদ্রে। না আসলে প্রত্যাশা আরো বেড়ে যায়। আরো বেশি করে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা চলে। আরো বেশি দুঃখ উৎপাদিত হয়।
সব সম্পর্কের সুতোই একদিন কাটে। মৃত্যু তার ধারালো ছোড়ায় মারে এক কোপ। সব শেষ। কেউ যায় গোরস্থানে, শ্মশানে কেউ কেউ। তারপরেও কি কিছু আছে! আছে হয়তো, কিংবা নেইও। সে পরের অভিজ্ঞতা ব্যক্তিগত। ওখানে আর সম্পর্ক গড়া চলে না। অথবা সম্পর্কের রীতিনীতি সেখানেও আছে। তবে এপাড়ের মতো নিশ্চয়ই নয়।
মোটের উপর এইতো জীবন। উৎপত্তির সেই অনুমেয় কাল থেকে আজ অবধি। তাহলে জগতে যে আনন্দযজ্ঞের কথা বলা হলো সেটা কোথায়। আছে। চেনা পথের শেষে যে অন্ধকার সেটুকু পেরুলেই আনন্দময় চিরআলোর সেই দেশ। ওখানে সবই সহজ, কিন্তু যাওয়া সহজ নয়। ওই দেশেরও আছে কতো নাম! সিদ্ধার্থ গৌতম বলেন পরম নির্বাণ, মরুসুন্দর মুহম্মদ নাম দিয়েছেন সিরাতুল মুস্তাকিম, বাঙলার মহান সুফী সদর উদ্দিন চিশতী বলেন ‘না’ বা মহাশূন্য অবস্থা। লালন তার মনের মানুষকেও সেই দেশে দেখেছিলেন। সেখানে আঁধার ঘরে বাতি জ্বলে, দিবা-রাত্রির কোন রকম ফের নেই। এসবে কিছুই বুঝা যায় না। কেবল জটিলতা বাড়ে। বাড়বেই। ও হলো ভাবের দেশ। ওখানে ভাষা অচল। ভাষা বড়ো ছোট, বিকৃত প্রকাশের মাধ্যম।
এই যে কোরান, বাইবেল, গীতা, ত্রিপিটক, সদরউদ্দিন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, লালনের ভাষা সেগুলো সেই আনন্দময় দেশের শুকনো মানচিত্র মাত্র। এগুলো তুলিতে আঁকা গোলাপ, বাগানের তরতাজা গোলাপ নয়। আঁকা গোলাপ সুন্দর হলেও গন্ধহীন, আসল গোলাপের গন্ধ নিতে হলে বাগানেই যেতে হয়।
ভাষার এই কারিগরেরা সেই বাগানের তুমুূল গন্ধে মাতোয়ারা হয়েছেন। বাগানের একটা চিত্র এঁকে এনেছেন সকলের জন্য। বেশিরজনেই মজে গেল সেই চিত্রে। আসল বাগানের সন্ধানে গেল না। মুহম্মদকে বন্দি করলো মক্কায়, বুদ্ধকে গয়ায়, কৃষ্ণকে বৃন্দাবনে, সদর উদ্দিনকে মাজারে, লালনকে আখড়ায় আর রবীন্দ্র-নজরুলকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে। অথচ তারা চেয়েছিলেন সেই আনন্দলোকে সকলকে নিয়ে সমবিহার। নিরানন্দ লোকে প্রহরান্তিক পূজার আরতি তাদের মনোবাসনা কিছুতেই ছিলো না। অথচ তাই হলো।
ভাবকেও বস্তু বানিয়ে সম্পর্ক স্থাপন করতে মানুষই পারে।
প্রসঙ্গে ফিরে আসি। জগতের আনন্দ অনুসন্ধান করি।
সেই যে আনন্দের দেশ, পরম না বা নির্বানের জগৎ সে কোথায়? এখানেই। এই ধূলা-মাটির পৃথিবীর প্রাত্যহিক জীবন প্রবাহে। কেবল নির্মাণ করে নিতে হয়। নির্মাণের জন্য জ্ঞান ও ভাবের নিরন্তর সাধনা করতে হয়।
বললামতো সাধনা, সেখানেও আছে কতো রকম ফের। আছে তত্ত্ব, আছে উপদেশ। একদিকে মাথা উঁচু করে শাসনের নিয়ম বাতলাচ্ছে মন্দির, মসজিদ। আছেন গুরু-মুর্শিদ, তাঁদের শত-আচার-বিচার। এই সব দেখে আনন্দ সন্ধানী বাঙলার বাউলের কণ্ঠে আপে, ‘তোমার পথ ঢাইকাছে মন্দিরে-মসজিদে, তোমারে দেখতে দেয়না গুরুতে মুর্শিদে।’ এ গুরু আনন্দ লোকের নিশ্চয়ই নয়, নিরানন্দ দেশের আনন্দ সঙ।
সাধনার কথা হচ্ছিলো। এ সাধনা প্রহরবিহীন, আশ্রমের সীমার বাইরে। শরীরপাত করে, লোক দেখিয়ে এ সাধনা হয় না। এ সাধনা আন্তরলোকের। এখানে নিজের পাঠশালায় নিজেই ছাত্র, নিজেই শিক।
জন্মের পর থেকে জৈবিক কারণেই মানুষকে নানা বস্তুতে, নানা ব্যক্তিতে, নানা ভাবে জড়িয়ে পড়তে হয়। জড়ানোর কি কলাকৌশল তার কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা বা প্রশিণ নেয়া ছাড়াই। ফরাসী দার্শনিক জাঁ পল সাঁর্ত্রে বিষয়টাকে তুলনা করেছেন অভিনয় বা সংলাপ না জানা সে আনাড়ি লোকটার সাথে, যাকে হলভর্তি দর্শকের সামনে এসে মঞ্চে দাঁড়াতে হয়েছে। মন্দ হোক, ভালো হোক একটা কিছু তাকে করতেই হবে। পালিয়ে যাবার সকল দুয়ার তার আপাতত বন্ধ।
সে অভিনয়টা করে। দও হয়ে ওঠে একদিন। দুঃখজনক হলো, এ অভিনয়টা যে একদিন শেষ হবে এ সরল সত্যটুকুও তার বোধের ভিতরে থাকে না। পরিপার্শে¦র অন্যসব অভিনেতা, উপকরণের সাথে নিজেকে একাত্ম করে ফেলে। তারা যদি সুখ দেয় সে সুখী হয়, তারা যদি দুঃখ দেয় সে দুঃখ পায়।
যদিও বলা হয় মানুষ নিজেই তার দুঃখের উৎপাদক। কিন্তু কথাটা গভীর অর্থে, সাধারণ অর্থে নয়। সাধারণভাবে অন্য বস্তু বা ব্যক্তির কারণেই মানুষের জীবনে দুঃখ নেমে আসে। যদি অপরের স্বভাব ধর্মের সাথে নিজেকে মিলিয়ে নেয়া যায় অপরও মিলেমিশে থাকবে। সুখের কারণ হবে। অপরের স্বভাবধর্মের সাথে না মিলতে পারলেই বিবাদ শুরু হয়। দুঃখও নেমে আসে।
কেবল অপরের নয়, নিজের বেলায়ও সেই স্বভাবধর্মের প্রভাব। অপরকে যে দুঃখ দেই সেই আমার স্বভাব ধর্মের সাথে অন্যের বিবাদের ফল।
এই স্বভাবধর্মকেই ভারতীয় দার্শনিকেরা বলেছেন ‘অহম’। অহম বা আমি সত্তাটি যতণ জাগরুক ততণ নিরন্তর আনন্দ বলে জীবনে কিছু থাকতেই পারে না। চিরআনন্দ লোকের প্রথম ও একমাত্র শর্ত আমি বা অহমের মূলোচ্ছেদ করা। সে লোকে প্রবেশের আগে ‘আমি’ এসে বারবার পেছনে টেনে ধরতে চাইবে।
এই যে ‘আমি’, যাকে আনন্দলোকে প্রবেশের প্রধান প্রতিবন্ধক বলা হচ্ছে তা থেকে মুক্তির উপায় বাতলেছেন অনেক মহাজনেরা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ‘আমিই যদি না থাকে তাহলে ব্যক্তির অস্তিত্বটাইতো থাকে না। এ প্রসঙ্গে সাধক জালালুদ্দিন রুমির উপলব্ধি ছিলো তাৎপর্যময়। তিনি বলেছেন, ‘অসময়ের আমি অভিশাপ, সময়ের আমি আশীর্বাদ।’ অসময়ের আমি সাধারণের- যদু মধু রাম শ্যামের। সময়ের আমি নজরুলের, মনসুর হাল্লাজের, বায়েজিদ বোস্তামির।
অসময়ের আমিকে উড়িয়ে সময়ের আমিতে উত্তরণের একটা চমৎকার দাওয়াই দিয়েছেন সুফী সাধক সদর উদ্দিন আহমেদ চিশ্তী। তাঁর দর্শন থেকে একটু আলোচনা হোক।
তিনি বলেন, জাগতিক জীবনে সমস্ত দুঃখের কারণ বস্তুমোহে অবিরামভাবে জড়িয়ে যাওয়া। এমনিতে বস্তু নিরপে। মনোজগতে যখন সে বস্তু বাসা বাঁধে তখন সে স্বমুর্তি হারিয়ে ব্যক্তির সাথে ওতপ্রোত হয়ে যায়। ব্যক্তির বস্তুবাসনা ক্রমাগত বাড়তে থাকে। ফলে অপ্রাপ্ত বস্তুর প্রত্যাশায় ব্যক্তি থাকে উন্মুখ, তৃষ্ণার্ত। শত পানেও সে তৃষ্ণা মিটে না। তিনি বলেন এ বস্তুমোহ ত্যাগ করতে। বস্তুকে পর্যবেণ করে সে বস্তুর ভিতরে মহাবিশ্বের অখণ্ডতাকে অনুভব করতে।
মূলকথা ব্যক্তিও বস্তুর স্বতন্ত্র অবস্থান নির্মাণ করা । বস্তুর গুণকে সারল্যের সীমা অতিক্রম করে মহাজাগতিক দৃষ্টিতে দেখা। তাঁর ভাষায় অনু অনু করে ভেঙ্গে ভেঙ্গে দেখা। তখন দেখা যাবে আমি ও বস্তুর মৌলিক উপাদানগুলো একই। চারদিকে কেবল আমি। আমি আমারই প্রত্যাশা করছি। তখন আমাতে চোখ ফেরে। জেগে ওঠে আমার সেই বিপুল বিশাল আমি। সে আমির সর্বত্র বিচরণ, সর্বত্র অবস্থান। তখনই ক্ষুদ্র ‘আমি’র বাঁধন ভাঙ্গে। উল্লাস করে নজরুলের মতো বলা যায়, ‘আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ।’ তখনই মুক্তি- বাসনা থেকে, মোহ থেকে। আর মুক্তি মানেই আনন্দের চিরসবুজ মাঠ, সে মাঠে ইচ্ছায় বিচরণ।
এ নাতিদীর্ঘ আলোচনায় কিছু বুঝা গেল কি? মনে হয় না। ভাষা বড়ো ব্যাকরণ নির্ভর, ভাব ব্যাকরণের সীমার বাইরে। যে আনন্দের কথা বলা হলো তা ভাবের দেশের, বস্তুনির্ভর ভাষা দিয়ে সে দেশের বর্ণনা সম্ভব নয়। তাই বলি ভাবুকের সঙ্গ করো। তার সাথে প্রেমের সম্পর্ক পাতাও।
(চলবে)

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



