somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিশাখা পুরাণ কিংবা বৈশাখের অ-গদ্য

৩০ শে নভেম্বর, ২০১৮ রাত ৮:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

চড়্গুদ্বয় খুলে হাতে নিয়েছি
পাথর ভেঙে ভেঙে তুলে নেই আলোর রেখা
ধমনী ছিঁড়ে যেতে থাকে...

ঘুম ভেঙে দেখলাম দূর হিমালয় থেকে কুয়াশারা উড়ে যায় মহাপৃথিবীর দিকে। বিনিসুঁতোর মতো ধুলোর মালা উড়ছে তো উড়ছেই। বাতাস ছিদ্র করে তারা ঢুকে যেতে থাকে হৃদপি-ে ফুসফুসে। আমরা জেনে যাই, হিমালয়-কন্যার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। এ ঘটনায় শ্বাসকষ্ট হয় গ্রাম কালীয়ানের ঋদ্ধ বটবৃক্ষটিরও। সেই সে বটবৃক্ষ , যে বটবৃক্ষের ডাল পাতা ছিঁড়লে কষ নয়, রক্ত ঝরে। আর এক একটা ডাল কেটে নেয় যে মরদ তার তো রক্ষেই নেই। ভেদবমি হয়ে নির্ঘাত মৃত্যু। তাই স্বামীদের আযুষ্কামনায় বৃক্ষের কাণ্ডে, পাতায় রঙিন সুঁতো বাঁধে বঁধূরা। সন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বালে, বৃক্ষের গোড়ায় জল ঢালে। সেই বটবৃক্ষের শ্বাসকষ্ট হলে ধীরে ধীরে তা বিস্তৃত হয় মন্দির গাত্রে গজিয়ে-ওঠা শ্যাওলার আস্তরণে, মসজিদের খাঁজে হেসে-ওঠা পুদিনা পাতায়, বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃণের আস্তরণে। শ্বাসকষ্ট হয় পদ্ম-মেঘনা-যমুনা-ব্রহ্মপুত্র নদের। কষ্ট হয় কংস-কপোতাক্ষ ও বংশাই নদের। কষ্ট হয় ভাগীরথি- কীর্তনখোলার।


হিমালয়-কন্যার মিহি কান্নার ধ্বনি আছড়ে পড়তে থাকে নগর থেকে নগরীতে, বিপণিবিতান থেকে অফিস পাড়ায়, কাচের দেয়ালে দেয়ালে। আমাদের শিশুরা কেঁদে ওঠে। তরুণী ভার্যারা আতঙ্কে বিহ্বলিত হয়ে প্রিয়তমের বাহু আকাঙ্ক্ষা করে। প্রবীণারা এর মধ্যে পেয়ে যায় আগাম কী এক বার্তা! সমস্ত কাজ ফেলে দ্রুত হাতে তুলে নেয় জপমালা।
এমনতর অবস্থায় আমারও শ্বাসকষ্ট হতে থাকে। আরোগ্যলাভের জন্য হাতের কাছে নিমপাতা- বাসকপাতা কোনো কিছুই খুঁজে পাই না। সখা-টিয়াপাখিটাকে পাঠিয়েছিলাম দূর গজারি বনে। সে ফিরে এসে জানিয়েছে, আরোগ্য লাভের সমুদয় ভেষজ নিঃশেষ হয়ে গেছে। অতঃপর নিজেই নিজের আরোগ্য হয়ে উঠতে চাই। লেখার টেবিলে বসি। অসমাপ্ত লেখাগুলো শেষ করার জন্য আরো কিছুদিন সময় প্রার্থনা করি মহাকালের কাছে।
হায়!
একটি অক্ষরও লিখতে পারি না। সে বলে কেমন করে পারবে, তুমি কি জন্মান্ধ? লেখক হতে হলে যে জন্মান্ধ হতে হয়। লেখক হতে হলে কুকুরের মতো ঘ্রাণশক্তি আর শয়তানের স্মৃতি থাকতে হয়। আমি টের পাই, ওগুলোর কিছুই আমার নেই। নিজের ঘ্রাণশক্তি নিয়ে একসময় যে অহঙ্কার ছিল, তাও আর অবশিষ্ট নেই। যদি আমি ধরে নেই, আমার কুকুরের মতো ঘ্রাণশক্তি আছে কিন' শয়তানের মতো বিচক্ষণ আর স্মৃতির অধিকারী তো আমি নই। অথচ সে বলে, কন্যা কবিতা লিখো। বলে, তোমার যদি কুকুরের মতো ঘ্রাণশক্তি থেকে থাকে তবে স্মৃতির গঠন শৈলিও শক্ত হবে, স্মৃতি দীর্ঘস্থায়ী হবে। মানুষ নাকি চেষ্টা করলে মাতৃজরায়নের স্মৃতিও মনে করতে পারবে।
আমি স্মৃতি নয়, আলো খুঁজি।
আমি আত্ম প্রতারক, আত্ম প্রবঞ্চক নই, আত্মগোপন করতে জানি না।
অথচ কবি হতে হলে তাও প্রয়োজন।
কোথায় পাবো আমি ‘অনন্তযাত্রার মানচিত্র’!
তুমি তো জানো, কবিতা লেখা মানে নিজের জন্য সমাধি খুঁড়ে রাখা, এপিটাফ লিখে রাখা। কবিতা লেখার জন্য নিমজ্জিত হতে হয় পাঁকে-ক্লেদে-পুঁজে-নর্দমায়-ঘামে-নুনে-মদে-বিশ্বাসহীনতায়-বিশ্বাসভঙ্গে। আমি এর কিছুই পারি না। আলো চিনি না, অন্ধকার চিনি না। সংশয় আর দ্বিধায় থাকি। ঘুমের ভেতর জেগে থাকি কিংবা জেগে জেগে ঘুমিয়ে থাকি।

এখন মধ্য বৈশাখ। রোদের তাপে মাটি থেকে ভাঁপ উঠছে । রোদের গন্ধ ঢুকে পড়ছে এপার্টমেন্টের শীতাতপ দেয়াল ভেদ করে। আমি নিজেকে স্থির করতে চাই। যাবতীয় জাগতিক ভাবনা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে চাই। ফেসপাউডার-গানপাউডার, বোমা-বৃষ্টি-বারম্নদ, বকফুল-নাকফুল, হরতাল-করতাল, অবরোধ-নিমরম্নদ, এসআই-আইএস, ফাঁসির দড়ি - হাসির বড়ি, হিজাব-উড়না, ঢিলা-কুলুখ, মিসওয়াক-ক্যাটওয়াক, মাউথওয়াস-ফেসওয়াস, ডিটারজেন্ট, জেট পেস্নন, এরোসোল, এয়ারফ্রেশনার, রিফ্রেশার, উটপাখি-বাজপাখি, চিল-চিতল, নীলতিমি, সাপ, ব্যাঙ, কেঁচো, দালান, বার্ন ইউনিট, ফায়ারসার্ভিস-রম্নমসার্ভিস, মতিঝিল-হাতিরঝিল, ট্যাব, ওয়ালেট, চাবির রিং, আয়না থেকে আমিও বহুদিন পর সরিয়ে নেই হাত-পা-মুখ-জিহ্বা-গিলা-কলিজা-নাক-কানসহ দুই চোখ। দিগন্তের দিকে তাকাই। দৃষ্টিসীমায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে শৈশবের বুড়ির সুঁতো। আমরা জানতাম অনন্ত আকাশ থেকে তার আগমন। আমরা তার পিছু নিতাম। আজো ধরবো কি ধরবো না ভেবে উড়াল দেই ছায়াপথ ধরে। একবার ডানে তাকাই, একবার বামে তাকাই, আহা! প্রকৃতি! চির সুন্দর তুমি! অথচ একদিকে ধ্বংসের তাণ্ডব অন্যদিকে সাজিয়ে রেখেছ অনন্য উপাচার। ‘ ডান হাতে পূর্ণ করো সুধা, বাম হাতে পূর্ণ করো পাত্র, তোমার লীলাক্ষেত্রে মুখরিত করো অট্টবিদ্রুপে।’ আর আমি ভেবে পাই না, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, সোনালু, জারুল এতো রঙ কোথায় পায়!
এতো এতো সুন্দরের পাশে নিজেকে হীন মনে হতে থাকে।

সারা বছর ধরে এই ঋতুটির জন্যই অপেক্ষা করি আমি। বৈশাখ- বিশাখা। হে মহান, যে তুমি এই মাসের এমন সুন্দর নামকরণ করেছেন প্রণতি তোমায়! এতো ফুলের ঘ্রাণ বাতাসে! আমার ঘ্রাণেন্দ্রিয় ফুলের গন্ধগুলো আলাদা আলাদা করে দেখতে চায়, চিনে নিতে চায়। পয়লা বৈশাখের দুপুরে দেখেছিলাম অসম্ভব লাল কৃষ্ণচূড়া আলো করে আছে পথের দু’ধার। শ্রীরাধিকা নাকি কৃষ্ণচূড়ার কলি খুব পছন্দ করতেন। কৃষ্ণ বিরহে তিনি যখন বনফুলের মালা গাঁথতেন তখন কৃষ্ণচূড়ার কলিই থাকত প্রধান। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমিও খোপায় কৃষ্ণচূড়া গুঁজতে ভালো বাসতাম। তুমি কি জানো, কৃষ্ণচূড়ার পাতায় একরকম ঘ্রাণ আর ফুলের মাঝে আরেক রকম। এই দুই ঘ্রাণের সঙ্গেই আমার পরিচয় শৈশবে। তখন ঘর সাজাবার জন্য আলাদা কোনো গাছপালা ছিল না। ঝড়ে কৃষ্ণচূড়ার ডাল ভেঙে গেলে, টগর ফুলের ডাল ভেঙে গেলে আমি তা কুড়িয়ে আনতাম। কালো পিচ ঢালা রাসত্মায় সবাই যখন আম কুড়াতে ব্যস্ত আমি তখন কৃষ্ণচূড়ার ডাল কুড়াতাম। ঘরের সামনে মাটির কলসিতে ডুবিয়ে রাখতাম। আজ আবার সেই ঘ্রাণ আমাকে ডাকে। সুন্দর আমায় ডাকে। বলে, বসো এইখানে। গা এলিয়ে দাও। শিথিল করে দাও সমস্ত স্নায়ুতন্ত্র। গভীরভাবে শ্বাস নাও। দ্যাখো, দূরে শিরীষ ফুল ফুটেছে। মনে আছে তোমার, এবার বসন্তের শেষে তুমি দেখেছিলে সজনে ফুলে তোমার বাড়ির উঠোন কেমন আলো হয়ে আছে? বাড়ির পেছনের আমগাছটায় ঝেঁপে মুকুল এসেছে তুমি দেখেছ? দেখনি? এমন করে স্তব্ধ হয়ে আছো কেন? পরিব্রাজক তুমি।
ওঠো, পথে নামো, শিশুর ছোট্ট মুঠো করা হতের মতো, শিমফুলের কলির মতো করে রোদের দিকে হাত বাড়িয়ে দাও।

আমি আলোর দিকে তাকাতে চাই, পারি না। এতো আলোয় আমার চোখ অন্ধ হয়ে যেতে থাকে। মনে হতে থাকে জমাট অন্ধকারের ভেতর সেঁধিয়ে যাচ্ছি ক্রমশ। অন্ধকারে মৃত্যুকে সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে উপরের দিকে আসতে দেখি। সে আসছে গুটি সুঁটি পায়ে, সে আসছে পা ঘষটে ঘষটে। হাত-পা হিম হয়ে যায়। ভীত আমি হাত নাড়াতে চাই, পা নাড়াতে চাই, মৃত্যুকে প্রতিরোধ করতে চাই। পালাতে চাই। অথচ জমাট সিমেন্টের চাঁই এর মতো ভারি হতে থাকে আমার সমস্ত শরীর।

অতঃপর একসময় ঠিকই সমস্ত পৃথিবীতে জর্জিয়ান অন্ধকার ঘন হয়ে আসে। বৃক্ষ ও মানবের কান্না লেপ্টে থাকে পৃথিবীর জরায়নে। নীল- লাল কালো সাদা পীত বর্ণের রক্ত মিশে যেতে থাকে নদী থেকে সমুদ্রে, সমুদ্র থেকে মহাসমুদ্রে। হাঙরেরা বাসযোগ্য মহাসাগর খুঁজতে থাকে। আর সমুদ্রের তলদেশে কঙ্কালের পর্বত বড়ো হতে থাকে দ্রম্নত।

.. তবে কি আমরাও দরে দলে আত্মহত্যা করবো!

(পুরোনো লেখা: মুক্তগদ্য : লাবণ্য প্রভা/বৈশাখ ১৪২৩)




সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে নভেম্বর, ২০১৮ রাত ৯:০৭
৪টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার কিছু ভুল!

লিখেছেন মোঃ খালিদ সাইফুল্লাহ্‌, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮

১। ফ্লাস্কে চা থাকে। চা খেতে টেবিলে চলে গেলাম। কাপে দুধ-চিনি নিয়ে পাশে থাকা ফ্লাস্ক না নিয়ে জগ নিয়ে পানি ঢেলে দিলাম। ভাবছিলাম এখন কি করতে হবে? হুঁশ ফিরে এল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×