একঃ
উঠানে উঠানে খেলে বেড়ায় চান মিয়ার বাচ্চাটা, দেখে চান মিয়ার বুক ভরে উঠতে চায়। বাচ্চাটার বড়ই সখ একটা লাল জামার, চান মিয়া টাকাও জমিয়েছে- এবার হয়তো একটা জামা কিনে দিতে পারবে বাচ্চাটাকে- লাল টুকটুকে একটা জামা। বাচ্চার, বাচ্চার মার কোন আবদারে সে সাড়া দিতে পারেনা সচারচর, এবারে বাচ্চাটাকে একটা জামা হয়তো দিতে পারবে- মনের ভিতরে একটা পুলক বোধ করে। কিন্তু তার এই ভাব বেশিক্ষণ দীর্ঘস্থায়ি হয় না; তার বদলে বাসা বাঁধে রাজ্যের দুশ্চিন্তা। বছর বছর জমি বেঁচতে বেঁচতে একটুকরা জমি এখন তার সম্বল, সেই জমি আর চুকানির একটা জমিতে ইরিধান লাগিয়েছে। সে দিন আর নেই, আগের তুলনায় ফলন বেড়েছে- তার তুলনায় বেড়েছে খরচ, ফসল হওয়ার পর সেটা বেঁচা আরেক ঝক্কি, দাম ওঠে না খরচের- একটাই ফল- ঋণের বোঝা মাথায় ওঠা আর বছর বছর জমি বেঁচা। একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে। উঠানের খেলায় রত গেদুটাকে দেখে বরং দীর্ঘশ্বাসটা আরো দীর্ঘায়িতই হয়, গেদুটার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে শংকা বোধ করে।
চান মিয়ার মাথায় রাজ্যের দুশ্চিন্তা- ফসলের কি গতি হবে, সময়মত মাটি যদি খাবার না পায়? পুরা সপ্তাহ ঘুরে সারের খোঁজ মেলে না কোথাও, সময় চলে যায়, এখনই যে সার দরকার। অবশেষে মিলেছে সার, কষ্টে-সৃষ্টে জোগাড় করতে পেরেছে টিএনওর কার্ড। তাই নিয়ে ছুটে চলে থানা সদরে, সাথে পাশের বাড়ির আজিজ মোল্লা। ভোর থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে দুপুরে গিয়ে মেলে এক বস্তা করে সার; মাথায় যেন বাজ পড়ে- জমি যে খুব ক্ষুধার্ত, এতটুকুন খাবারে কি তার পেট ভরে? আজিজ তার বয়সে মুরুব্বি চান মিয়াকে বড় ভাইয়ের মতই মান্যি করে ও বিশ্বাসও করে- আর বিশ্বাস করে দিয়ে দেয় নিজের সারের বস্তা চান মিয়াকে- বলে, বাড়িতে পৌঁছে দিতে- কেননা সে যাবে একটু হাটে, কিছু বাজার সদাই করবে। হায়রে চান মিয়া, রাজ্যের দুশ্চিন্তা এসে তাকে বিশ্বাসী থাকতে দেয়না, বাড়িতে পৌঁছে জমির দিকে তাকিয়ে, ঋণের বোঝার কথা ভেবে, বাচ্চাটার ভবিষ্যতের কথা ভেবে, ........ আর পারে না, জমিকে দিয়ে দেয় দুবস্তা সার!
আজিজ এসে যখন সার চায়, চান মিয়ার চোখ তখন উদাস, বলে- জমির ক্ষুধারে ভাই, তারে খাওয়ায় দিছি তোরটা সহ, এই নে টাকা- বলে ট্রাংক থেকে টাকা নিয়ে আসে, নিয়ে আসে বাচ্চার লাল জামা কেনার জন্য রাখা টাকা সহ। আজিজ টাকার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে, সহসা উত্তর দিতে পারে না, তারপর ডুকরে কেঁদে ওঠে বলে, টাকা দিয়ে কি করুম- আমারে সার দাও। আজিজের জমিও যে কম ক্ষুধার্ত না, তার ঘাড়েও যে কম ঋণের বোঝা নেই, সেও যে কম দুশ্চিন্তাগ্রস্ত না! চান মিয়া জবাব দিতে পারে না, কেননা সে জানে না কোথায় পাওয়া যায় সার। আজিজ সালিশ ডাকে।
চান মিয়া বোঝে সে চুরি করেছে, বাপ-দাদারা ছিল এলাকায় মান্যিগণ্যি, গরীব হয়ে গেলেও চান মিয়ারেও লোকে ভালো লোক বলেই মানতো; সেই চান মিয়া চোর হয়ে সালিশে যেতে চাইলো না। ফসল ও সার নিয়ে একবুক দুশ্চিন্তা, একগাদা ঋণের বোঝা, আর গেদুটার জন্য অশেষ উত্কন্ঠা ও শংকা নিয়ে চান মিয়া কীটনাশক গেলে।
গেদুটার জন্য লাল জামাটা তার আর কেনা হলো না।
দুইঃ
ময়নার মা চোখ ফেরাতে পারেনা যখন ওই লাল গাড়িটার দিকে চোখ যায়। রংটা টকটকে লাল, আলো পড়লে আলো ঠিকরে বেড়িয়ে আসে- এতই চকচকে। ইউনিফর্ম পরা ড্রইভার এক দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে আছে, পেছনের সিটে বসে আছে এক সাহেব আর এক মেম। তার সাহেবের নাদুস-নুদুস বাবুটা যখন ব্যাটারি ঢুকিয়ে চাবি দিয়ে দেয়, তখন গাড়িটি দারুন একটা আওয়াজ করতে করতে চলা শুরু করে। ময়নার মা তখন অবাক হয়ে গাড়িটির দিকে তাকিয়েই থাকে। মনের গভীরে গাড়িটির জন্য লোভ অনুভব করে, সারাটা দিন একলা কাটে ময়নার সাততলা বস্তিতে। হাড়-জিরজিরে ময়নার মুখে খাবারটাও সবসময় ঠিকভাবে দিতে পারেনা- তারপরও ময়নার হাতে ওই লালগাড়িটা তুলে দেয়ার দুঃসাহসী স্বপ্ন দেখে। অবশেষে, গাড়িটি একদিন তার হাতে আসে, দিতে পারে ময়নাকে- তার আপা মানুষ খুব ভালো, গাড়িটি তাকে দিয়ে দেয়। হোক না, গাড়িটি এখন চলে না, হোকনা তা থেকে শব্দ বের হয়না- তারপরও গাড়িটি পেয়ে ময়নার খুশি আর ধরে না- ময়নার খুশি দেখে ময়নার মার খুশিও আর ধরে না।
একরাতে ঘরে ফিরে বস্তির অনেকের মুখে শুনে যে পরদিন নাকি বস্তি ভেঙ্গে দেয়া হবে। কথাটা অনেকের মত সেও গুজব বলে উড়িয়ে দিতে চায়, আগেও এমন গুজব অনেক শুনেছে তারা, বস্তিতে থাকলে এমন গুজব মাঝে-মধ্যেই শুনতে হয়- গুজবে কান দিতে নাই- কারণ কান দিয়ে করণীয় কি তাও যে তারা জানেনা!
কিন্তু এবার যে গুজব সত্য হয়, সকাল থেকে বস্তি জুরে আহাজারি শুনা যায়, যদিও সে আহাজারি সে কোলাহল উত্পত্তিস্থলেই হারিয়ে যায়, সামান্য পথও সে অতিক্রম করতে পারেনা, নিমেষে গুড়িয়ে যায় লাখো মানুষের মাথা গুজার ঠাঁই। গোছগাছের সময়টুকু পায়না, যতখানি যা পারা যায় শেষসম্বল হিসাবে টিকাতে পারে- তাই নিয়ে দাঁড়ায় খোলা আকাশের নীচে। ময়নার মাও ময়না সহ তার ঘরের যত্সামান্য জিনিসপত্রের মধ্যে আরো সামান্য কিছু নিয়ে খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে ঘরটির মাটির সাথে মিশে যাওয়া। ময়নার হঠাত করে লাল গাড়িটির কথা মনে পাড়ায় সে আনতে চায় গাড়িটি, কিন্তু ততক্ষণে তার গাড়ি-বাড়ি সব গুড়াগুড়া হয়ে মিশে গেছে মাটির সাথে। গাড়ি হারানোর বেদনায় ময়না চিত্কার করে কান্না শুরু করে দেয়। আর ঘর হারানোর বেদনায় নির্বাক ময়নার মা মেয়ের গাড়ি নিয়ে বিলাপ সহ্য করতে পারে না; সমস্ত আক্রোশ নিয়ে পাষাণ মা মেয়ের গালে মারে বিরাশি মণ ওজনের এক থাপড়। মা যেন ঘরহারা, অত্যাচারিত, প্রতিবাদী কোন মানুষ আর মেয়ে যেন রাজউকের কর্মকর্তা, র্যাব-পুলিশ-মিলিটারি।
মেয়ে যেন এই সরকার!
তিনঃ
ডকু তৈরির নেশা ও সমাজকে পাল্টে দেয়ার স্বপ্ন বুকে নিয়ে একদল তরুন ফুটেজ সংগ্রহ করছিল বিভিন্ন বস্তিতে গিয়ে, রাস্তায়, ফুটপাতে। এক ছুটির সকালে গিয়ে হাজির হলাম তাদের সাথে। তাদের ক্যামেরায় ও সামনাসামনি দেখলাম বাস্তুহারা, কর্মহারা বস্তিবাসীকে-হকারকে। ঘুরতে ঘুরতেই যাই সংসদ ভবনের সামনে। দেখি একটি টকটকে লাল গাড়ি দাঁড়িয়ে, গাড়ির অদূরে এক সৌম ভদ্রলোক, পাশে এক ভদ্রমহিলা আর কিছুদূরে ফুটফুটে একটি বালিকা- সেও লাল টুকটুকে একটা ফ্রক পরিহিত। এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করছে আর তার গর্বিত ও তৃপ্ত পিতামাতা লাল-বালিকাকে মাঝে-মধ্যে মৃদুমন্দ শাসন করছে। কি মনে করে যেন আমাদের টিমটি ওনার সাক্ষাত্কার নিতে চাইলো। ওনাকে এহেন অসময়ে ডিস্টার্ব করার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে অত্যন্ত পোলাইটলি রিকুয়েস্ট করায় ভদ্রলোক রাজি হলেন ক্যামেরার সামনে কিছু বলতে। বলাই বাহুল্য, ওনাকে বস্তি উচ্ছেদ- হকার উচ্ছেদ নিয়ে বলতে বলা হয়েছিল। ভদ্রলোকও জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করেন।
:এই ঢাকাকে দেখেন, এটাকে কি মনে হয় একটা রাজধানী শহর? চারদিকে নোংরা আবর্জনা, টোটালি পোলুটেড আ সিটি দিস ইজ!
:হু উইল কাম টু ইনভেস্ট ইন সাচ এ পলুটেড সিটি?
:রাস্তায় চলাচলের কোন উপায় আছে? কেন রাস্তা দখল করে, ফুটপাথ দখল করে হকাররা ব্যবসা করবে?
:একটা রাজধানী শহরে কখনো বস্তি থাকতে পারে? বস্তিগুলোতে কি না হয়? ঢাকা শহরের সকল অপরাধের মূল ঐ বস্তিগুলো, জানেন বোধ হয়?
:বর্তমান তত্বাবধায়ক সরকার অবশ্যই করেক্ট এবং সাহসী ডিসিশন নিয়েছে এবং সে অনুযায়ি কাজ করছে। উই মাস্ট অ্যাপ্রিসিয়েট দেম।
:কিন্তু মানবিক দিকটাও আমাদের দেখা উচিত, পুনর্বাসনের বিষয়টিও আমাদের মাথায় থাকা উচিত। দ্যা গভরমেন্ট উইল ডু দিস। একবারে হবে না, তাদেরকে সময় দিতে হবে।
আমরা পঞ্চমুখ হয়ে বলি, আপনি তো দেশকে নিয়ে অনেক ভাবেন!
:না আসলে বেশি ভাবতাম না। ব্যবসার কাজেই এত ব্যস্ত থাকতে হয়!
:তবে ঐ মেয়েটি হবার পর থেকে সব পাল্টে গেল। ইনফ্যাক্ট ভাবতে বাধ্য হয়েছি। আপনারাই বলুন, কোথায় আমরা ওদেরকে নিয়ে এসেছি? ওদের ভবিষ্যতটাই বা কি? এখানে শ্বাস নেয়ার মত জায়গাও কি আমরা ওদের দিতে পারছি?
লাল-বালিকার দিকে চোখ যায়। লাল গাড়ির দিকে চোখ যায়।
মিনিট ১৫ আগে কথা হয়েছিল সর্বসান্ত এক মেয়ের সাথে। ফার্মগেটের কাছে ফুটপাথে পান-বিড়ি বেচতো, থাকতো কাওরান বাজার বস্তিতে। মনে পড়ে যায় তার কথা।
:আমরায় কোন দোষডা করছি? আমরা চোরে না ডাকাত যে আমাগো প্যাডে এমন লাত্থিডা মারলো?
:আমরায় থাকুম কোনহানে? কাম করবার না দিলে আমরায় খামু কি?
:আওমিলিগ দ্যাকছি। বিএনপি দ্যাকছি। অহন দ্যকতাছি ফকিরুদ্দিনের সরকার। গরীবের কথা কোন হালায় ভাবেনা, হগ্গোলি বড়লোকগো লাইগ্যা।
:পুনরবাসন দিব হুনছিলাম। কোই আমাগো কেডাও তো পায় নাই? ওগুলান বুজি না, আমাগো থাকার লাইগ্যা জায়গা দ্যান আর খাওনের লাইগ্যা কাম দ্যান।
এই মেয়েটিও বোধ হয় লাল কামিজ পরাছিল, টুকটুকে লাল।
আমাদের লাল-বালিকারা আজ কোথায় কেমন আছে জানিনা।
প্রথম প্রকাশ: ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০০৭ দুপুর ১:১৬ সামহোয়ারইনব্লগ- মাদারি নিক থেকে
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মার্চ, ২০০৯ বিকাল ৪:০২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



