এক
ফেসবুক বা কারও কাছে শুনেছিলাম- ৮ জুন বিকালে বুয়েটে আলোচনা সভা হবে। আরেকজন জানালো- প্রথম আলোর মতিউর রহমান অতিথি হিসাবে যাচ্ছেন বুয়েটে। ৭জুন থেকে সারারাত কাজ ছিল, কাজ শেষে ৮ জুন বাসায় ফিরতে ফিরতে প্রায় দুপুর। এর মধ্যে শোনা গেল, এই আলোচনা সভার আয়োজক বুয়েট কর্তৃপক্ষ, সভাপতিত্ব করবেন বুয়েট ভিসি। ফেরার পথে মোবাইলে বন্ধু ও বুয়েটের সন্ত্রাসবিরোধী ছাত্র ঐক্যের ব্যানারে গড়ে ওঠা আন্দোলনের সহকর্মীর সাথে কথা হলো। বন্ধুটি একটিভলি কোন রাজনীতির সাথে যুক্ত না থাকলেও বুয়েটে ছাত্র ফ্রন্টরে পছন্দই করতো, যদিও মানসিকভাবে আওয়ামি লীগ ঘেষা। তাকে বললাম,-
:জানিস তো বুয়েট কর্তৃপক্ষ আজকে নিজেই কর্মসূচী হাতে নিয়েছে!
:অবাক হইনি, দেখতে হবে না- কোন সরকার ক্ষমতায় আছে!
:তোর কি মনে হয়? বুয়েট প্রশাসনের এই উদ্যোগকে কি চোখে দেখা উচিৎ?
:আমার তো খারাপ মনে হয় না।
:আমার মেলা আপত্তি আছে,
:কেন?
:আমাদের ঐ সময়ের আন্দোলন কিন্তু একটা পর্যায়ে বুয়েট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধেই ছিল।
:এখন তো সেই প্রশাসন নাই।
:ব্যক্তি চেঞ্জ হলেই কি প্রশাসন চেঞ্জ হয়? ছাত্রদের একটা দাবি কি তারা বাস্তবায়ন করেছে? অন্যায়ভাবে আন্দোলনকারী ছাত্রদের উপর দেয়া শাস্তি কি প্রত্যাহার করেছে? সবচেয়ে নীরিহ যে দাবি ছাত্রী হলের নাম "সাবেকুন নাহার সনি হল" করেছে?
......
বাসায় এসে প্রথম আলো উল্টাই। দেখি- বুয়েট কর্তৃপক্ষ অডিটরিয়ামে প্রোগ্রাম করছে, এবং চোখ বড় বড় করে দেখলাম- ৮ জুন তারা "সন্ত্রাসমুক্ত শিক্ষাঙ্গন" দিবস পালন করছে!!!
দুই
"সন্ত্রাসমুক্ত শিক্ষাঙ্গন" আসলে কি? কেন? কিভাবে? ৮ জুন কিভাবে সন্ত্রাসমুক্ত শিক্ষাঙ্গন হয়? কোনভাবেই মাথাতে আসছে না। ২০০২ সালের ৮ জুন- জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের দুই দল সন্ত্রাসীর বন্দুকযুদ্ধের মাঝে পড়ে সাবেকুন নাহার সনি মারা যায়। সন্ত্রাসের কবলে নীরিহ ছাত্রীর খুন হওয়ার দিনটি কি করে সন্ত্রাসমুক্ত দিবস হতে পারে- মাথাতে আসে না!!!!
তিন
সংক্ষেপে ইতিহাস বা প্রেক্ষাপটটা একটু বলে নেই। বুয়েটে ছাত্রদল বা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বরাবরই কেন্দ্রের তুলনায় ভেড়া-বাছুর. . টাইপের ছিল। বুয়েট, এর আশেপাশের অঞ্চল, পলাশী বাজার প্রভৃতির চাঁদাবাজি- টেণ্ডারবাজী সবই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাডারেরা নিয়ন্ত্রণ করতো, এটাই স্বাভাবিক ছিল। ঘটনা প্যাচ খেয়ে যায় তখনই- যখন বুয়েট ছাত্রদল সভাপতি মোকাম্মেল হায়াত খান মুকি- চট্টগ্রামের সাকা চৌধুরীর বলে ও তৎকালীন কেন্দ্রীয় ছাত্রদল সভাপতি পিন্টুর ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে, কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হওয়ায় এবং সম্ভবত পরবর্তী সাধারণ সম্পাদক হওয়ার খায়েশ থেকে নিজেরে অনেক শক্তিশালী ভাবা আরম্ভ করে এবং নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী প্রস্তুত করে- শক্তিমত্তার জানান দেয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। সেখান থেকেই- এতদিন ধরে সূর্যসেন হলের ছাত্রদল ক্যাডার টগরের হাত থেকে বুয়েটের টেণ্ডার রাজত্ব হস্তগত করাটা ফরয কাজ হয়ে দাঁড়ায়। সেরকমই একটা টেণ্ডারকে সামনে রেখে তাদের শক্তি পরীক্ষা হয়ে যায় ৮ জুন, তার মাঝে পড়ে অকালে প্রাণ হারায় সনি।
চার
বাংলাদেশে সন্ত্রাসীদের হাতে প্রাণ দেয়া নীরিহ মানুষের সংখ্যা নেহাত কম নয়। সন্ত্রাসের কবলে খুন হওয়ার দিনগুলো আমাদের কাছে এক একটা কালো দিবস। সে হিসাবে সাধারণভাবে এটা আরেকটা কালো দিন হিসাবেই গণ্য হওয়ার কথা- যদি না ঐ ৮ জুন রাত থেকেই বুয়েটের ছাত্ররা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াই সংগ্রামে নামতো। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন-লড়াই-সংগ্রাম ৮ জুন শুরু হয়, দুই আড়াই হাজার ছাত্রের মিছিল রশীদ হলে এসে মুকির দুই সহযোগী গান ফাইটার শরীফ-সায়হামকে ঘেরাও করে এবং পুলিশ এসে ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করে দিয়ে তাদের পালানোর সুযোগ করে দেয়। কিন্তু ছাত্ররা অনড়- দাবি- হল রেইড দিয়ে খুনীদের পাকড়াও করতেই হবে, না হলে এক পাও নড়বে না। অবশেষে হল রেইড করতে বাধ্য হয় প্রশাসন। এভাবেই শুরু।
পরদিন- সকাল থেকেই চলতে থাকে মিছিল- ডিএসডব্লিউ-ভিসি বরাবর স্মারকলিপি পেশ, ইত্যাদই- এই আন্দোলনে ভয় পেয়ে বুয়েট কর্তৃপক্ষ আন্দোলন বন্ধ করতে বুয়েট বন্ধ ঘোষণা করে ও হল ভ্যাকেন্ট করে দেয়। এখান থেকেই ও এভাবেই শুরু বুয়েট প্রশাসনের সন্ত্রাস বিরোধী আন্দোলনের বিপরীতে অবস্থান নেয়া এবং এই প্রক্রিয়ায় সন্ত্রাসীদের রক্ষার
প্রচেষ্টা। ছাত্রারা দমে না- বন্ধের মধ্যেই প্রেস ক্লাব পর্যন্ত মিছিল- প্রেস ক্লাবে প্রেস কনফারেন্স, মানব বন্ধন, সংহতি সমাবেশ এসব চলতে থাকে- দাবি: সনি হত্যার বিচার চাই। উল্টোদিকে, বুয়েট কর্তৃপক্ষ একটা নামকা ওয়াস্তে তদন্ত কমিটি গঠন করে- যার উদ্দেশ্যই দেখা যায়- ৮ জুন রাতে কারা মিছিল করেছে- কারা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে এসব বের করা। ফলে দেখা যায়- মুকি-শরীফ-সায়হাম এদের বিরুদ্ধে নামকা ওয়াস্তে শাস্তির বিধান দেয়ার পাশাপাশি আন্দোলনরত ছাত্রদের একই সাথে নানা মেয়াদে শাস্তি দেয়া হতে থাকে। উদ্দেশ্য শাস্তির ভয়ে যাতে আন্দোলন আর দানা বাঁধতে না পারে। তারপরেই ২ মাস পরে বুয়েট খুলে দেয়া হয়।
কিন্তু এর মধ্যেও ছাত্ররা লড়াই চালিয়ে যায়। গড়ে উঠে "সন্ত্রাস বিরোধী ছাত্র ঐক্য"। ৮ দফা দাবিনামা তৈরি হয়। বুয়েট কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে মুকি-টগর গং এর বিরুদ্ধে মামলা করা সহ দাবি উঠে আন্দোলনকারী ছাত্রদের অন্যায় শাস্তি প্রত্যাহার করতে হবে। দাবি উঠে ৮ জুনকে "সন্ত্রাসবিরোধী দিবস" হিসাবে ঘোষণা দিতে হবে। ছাত্রী হলের নামকরণ করতে হবে "সাবেকুন নাহার সনি হল"। ছাত্ররা আমরণ অনশনে বসে। এক পর্যায়ে রাষ্ট্রশক্তি ও বুয়েট কর্তৃপক্ষ এবং জাতীয়তাবাদী ঠেঙ্গারে বাহিনী এক হয়ে ত্রিমুখী আক্রমণ করে অনশনকারীদের বুয়েট থেকে, শহীদ মিনার থেকে, শাহবাগ থেকে, প্রেক্লাব থেকে, ঢাকার রাজপথ থেকে উৎখাত করে। বুয়েট আবার বন্ধ ঘোষণা করা হয়, হল ভ্যাকেন্ট হয়।
পাঁচ
বুয়েট কর্তৃপক্ষ কি মামলা করেছিল?
না।
আন্দোলনকারীদের কি অন্যায় শাস্তি প্রত্যাহার করা হয়েছিল?
না।
সনির নামে হলের নামকরণ হয়েছিল?
না।
৬১-এর অধ্যাদেশ বাতিল করা হয়েছিল?
না।
আসলে কোন দাবিই মানা হয়নি।
তাহলে কি পুরো আন্দোলনটাই ব্যর্থ?
না।
আমরা চুপ করে থাকি নি- এটাই সবচেয়ে বড় সফলতা। এতে যারা সন্তুষ্ট হননা- তাদের বলি- এই আন্দোলনের কারণেই মুকি-টগরের ফাসীর রায় হয়েছে। এই আন্দোলনের কারণেই মুকি-টগর রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হতে পারেনি, আরেক পিন্টু বা জয়নাল হাজারি বা হাজী সেলিম হয়নি। এই আন্দোলনের কারণেই বুয়েট কর্তৃপক্ষের আসল চেহারা সকলের সামনে উন্মোচিত হয়েছে।
ছয়
ফেসবুকে অনেককেই একটা ডকুমেন্টারির লিংক দিতে দেখলাম। ডকুমেন্টারিটার ঘটনাকাল ১ সেপ্টেম্বর থেকে ৮ সেপ্টেম্বর, সনি হত্যার বিচার সহ ৮ দফা দাবিতে অনশন কর্মসূচির উপর ডকুমেন্টারি। ওটার লিংক সেপ্টেম্বরে না দিয়ে জুনেই কেন দেয়া হচ্ছে? ভেবে দেখলাম- সমস্ত আন্দোলন-লড়াই সংগ্রামের মূল তো এই ৮ জুন। সেপ্টেম্বরের আনশনের ডকুমেন্টারির লিংকও তাই জুন মাসেই বেশি প্রাসঙ্গিক। আমিও ফেসবুকে লিংক দিলাম। এখানেও দিচ্ছি:
পার্ট-১
পার্ট-২
পার্ট-৩
সাত
২০০২ সালে বুয়েট কর্তৃপক্ষ সন্ত্রাসীদের পক্ষে এবং ছাত্রদের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছিল, কারণ সে সময়ে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় ছিল এবং সন্ত্রাসীরা ছাত্রদলের ক্যাডার ছিল। আজ, বুয়েট কর্তৃপক্ষ "সন্ত্রাসমুক্ত শিক্ষাঙ্গন দিবস" পালন করে- কারণ এখন আওয়ামি লীগ সরকার ক্ষমতায় এবং এই দিনটি স্মরণ করার মধ্য দিয়ে ছাত্রদল তথা বিএনপিকে একহাত দেখে নেয়া সম্ভব।
চরিত্রগত দিক থেকে বুয়েট কর্তৃপক্ষ একই বিন্দুতে অবস্থান করছে- এতটুকু নড়ন চড়ন হয়নি। এবং এক বিন্দু নড়ন চড়ন সম্ভবও নয়, যতদিন সরকারের কাছে নতজানু হওয়ার অনুমোদন দেয়া বুয়েট ব্লু বুক- '৬১ এর কালো অধ্যাদেশ বাতিল করা হচ্ছে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



