মানুষ যখন নামে মানুষের স্তর থেকে লাথি খেয়ে
আপনারা কোথায় ছিলেন ? - সৈয়দ শামসুল হক।
কলিংবেলের টুংটাং শব্দে ঘুমের কালো ভারি পর্দাটা সরে গেলে বিরক্ত হই, ঘুম ভেঙ্গেছে বলে নয় - সকাল ৯ টা বলে।
দরজা খুলি।
কালো সানগ্লাসে ঢাকা গোলাকার একটি মুখ, ঠোটের কোণে একটু হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে।
ভিক্ষে চায়।
- নাই ! রাগের বাঘ খুব গর্জন করে বেরুতে চাইছিল, অনেক কষ্টে তাকে দমিয়ে বলি।তাতে স্বর লঘু হলেও ঝাঁজ ঠিকই বেরোয়।
- শোনেন! এত সকালে দরজায় ধাক্কা দেবেন না। বেল বাজাবেন না। রাতে দেরি করে ঘুমাই। আসলে - দেরি করে আসবেন।
ভিখারিণীর নিরব হাসিমাখা ঠোঁট টা কেবল আরেকটু বিস্তৃত হল। তারপর আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল।
দরজা লাগিয়ে নিজের রুমে আসতেই মনে একটা জোরালো ধাক্কা।
আবার দরজা খুললাম। কেউ নেই।
ভিখারিণী! আসলেই কি? !!
ভিক্ষার অনুনয় নেই, বলল ও না চাই। কেবল হাসল। কেন ?
সেই শুরু।
প্রতিরাতে ঘুমাতে গেলে - সানগ্লাস পরা গোলাকার মুখটা। মুচকি হাসি। নীরব। পরপর কয়েকদিন টানা এভাবে। অসহ্য ঠেকে।
কি আছে ঐ হাসিতে? না বললাম, মহিলা হাসল।ওখানেই ত দফারফা শেষ হবার কথা।তাহলে? দিন নেই রাত নেই ঘুম নষ্ট হচ্ছে কেন?
বেশ অবাক হচ্ছি। ভিখারিণীর ব্যাপারটা ভাবার মত গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। এমন ও নয় যে আমি কারো সাথে দুর্ব্যবহার করি না। ভিক্ষুকদের না বলাটাও অভ্যাসে আছে। অথচ অবচেতন মন এসব ভেবে যাচ্ছে। শুধু তাই নয় ভিখারিণী বিষয়ক চিন্তাভাবনাগুলো মনে ক্রমশ বাসা বাধছে।
আমার চিন্তাগোলক কেবল ভিখারিনীর হাসিতে আবর্তিত হচ্ছে। সে কে, কোথায় থাকে, কেমন থাকে তা নিয়ে মোটেও ভাবছি না। কেবল ভাবছি - এ হাসি কেমন হাসি! ভিখারিণীর গোলাকার মুখটা ভারি মিষ্টি, যখন ঠোঁটটা এধার হতে ওধার বিস্তৃত হয়েছিল, মুখের সাথে মিলিয়ে হাসিটা একটা কোমল শান্ত মিষ্ট অবয়বে আপনাতে দাঁড়ানোর কথা ছিল। অথচ হাসিটা ব্যাখ্যাতিত এক দুর্জ্ঞেয় রহস্যাবরণে মোড়া, দুঠোঁটের ফাঁকহীন লেগে থাকা ঘনিষ্ঠ হাসিতে কেবল জীবনবেদনা সঞ্চিত কংক্রিট দেখতে পেয়েছিলাম। সেটা জমাট - নিবিড় -শক্তিশালী, তার উদ্ধত উপস্থিতিতে মিষ্টতার ঠাই পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু হাস্যবহির কেবল একটা অধ্যায় বুঝতে পেরেছি বাকিরা দুর্বোধ্য বলে আমার কাছে অপাঠ্য সেটাও উপলব্ধিতে টের পেলাম। জীবনসমুদ্রে কিভাবে কতটুকু অবগাহন করলে আপনাতেই এমন একটা হাসি বেরিয়ে আসে? আমার মনে হল - প্রখর রোদে কাপড় শুকাতে দিলে কাপড়ের ভেজাটা কিছুক্ষণ পর যেভাবে হারিয়ে ঝরঝরে শুকনো হয়ে যায় ,মহিলার সমস্ত জীবনীশক্তি ও এভাবে শুকিয়ে খরখরে হয়ে গেছে। মহিলার হাসিতে তাই লালা নাই। হয়ত কখনো আসার সম্ভাবনা ও নাই । আমি শিউরে উঠলাম। এ কারণেই হাসিটা মনের মর্মে নিরবে কিন্তু প্রচণ্ড শক্তিতে আঘাত হেনেছে। ধসে দিয়েছে হাওয়াই ভিতে গড়া আমার শিক্ষিত (!) অহংকারী মানস।
আচ্ছা - আমি যদি ২ টাকাও তখন ভিখারিনীকে দিয়ে দিতাম তাহলে কি এত যন্ত্রণা পোহাতে হত? না বোধ হয়। না কেন?
মোটেও পোহাতে হত না। নিজেকে তিরস্কৃত করলাম। এখন তুমি শাস্তি ভোগ কর। তিলে তিলে। যা হচ্ছে ঠিকই হচ্ছে। এ শাস্তি আমার পাওয়া উচিত। কোটি কোটি লোক ক্ষুধার জ্বালায় প্রভাতের প্রথম প্রহরে আপনা আপনি উঠে আর আমার ৯ টায় ও সকাল হয় না! মানুষ কতটা অসহায় হলে ভোর হতেই মানুষের দরজায় দরজায় ভিগ মাগতে আসে! এই মহিলা খুব অসহায় বলে আমার মনের আসল অনুভূতিটা বেরিয়ে আসতে পেরেছে। অভিনয় করতে হয়নি। খুব সকালে ডাকাত এসে যদি আমার সব কেড়ে নিত - ভয়ে তাদের হুজুর হুজুর করতাম। কিংবা আমার সমগোত্রীয় কেউ - বিরক্ত হলেও মুখে হাসি ফুটিয়ে বসতে বলতাম। আমার চেয়ে উচুগোত্রের কেউ হলে ত মোহেসাবিতে নেমে যেতাম।
এই ২ টাকা, ৫টাকা,১০ দিয়ে এতদিনকার আত্মতৃপ্তি লাভের সত্ত্বাটায় ভিখারিণী মিসাইল দেগে অণু - পরমাণুতে ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়েছে । -এই তাহলে আমি! ৫- ১০টাকা ফেলে মহাযজ্ঞ করে ফেলা করিতকর্মা বাহাদুর! অন্য অনেকের মত আমিও এভাবে ছিটে-ফোঁটা ঢেলে মানুষের প্রতি মানুষের দায়সারা দায়িত্ব পালন করে বিরাট কিছু করছি ভেবে গৌরব অনুভব করি। তার ও যে কত বাছ - বিচার! লুলা, কানা, বোবা কিনা দেখো, ব্লাফ খাচ্ছ কিনা লক্ষ্য রাখো। ট্রেজারি হতে এমনিই বেরোবে, এত সহজ!
ভাবি ভাবি আর দিনে রাতে অনুতাপে দগ্ধ হই। আরেকবার যদি দেখা পেতাম! মনের দুঃসহ যন্ত্রণা হতে মুক্তি পাবার উপায়টা বের করতাম।আমার মন বলল -ভিখারিনী আর কখনো আমার দরজায় টোকা দেবে না। আর কখনো প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ হবে না।এই শঙ্কায় ভোরে উঠা শুরু করি।
দিনের পর দিন ঘরের দরজার সামনে বার বার আসা - যাওয়া চলে। দরজায় একটু খুটখাট শব্দ কি হাল্কা পায়ের আওয়াজ.... ওমনি দৌড়ে যাই। কিন্তু কই ভিখারিণী? মনের অস্থিরতা লক্ষ্যহীন এদিক - অদিক দৌড়ে। শান্তি একদম উবে যায়। রাতে বার বার বলি- হে আল্লাহ! আরেকবার ভিখারিনীকে দেখাও। আমাকে মানুষের মত ব্যবহার করার একটা সুযোগ দাও।কিন্তু হায় !বুকে অসীম যন্ত্রণার ঘূর্ণন চলতেই থাকে।
অবশেষে একদিন দোয়া কবুল হয়। এক সকালে ভিখারিণী দরজা ধাক্কায়। দরজা খোলার পর আমিও ধাক্কা খাই। আকাঙ্খিত সেই গোলাকার মুখটা, কিন্তু সানগ্লাস?
আমার প্রশ্ন চিতার গতিতে বেরোয়।
- ওইটা বেচে দিছি , বাপ !
- বেচে দিছেন! শুনে অবাক হই। এইরকম একটা পুরনো সানগ্লাস বেচলে কয় টাকা ?
- আপনি বেচে দিছেন ? ! কয় টাকা ? আচ্ছা থাক, আপনার সানগ্লাস টা কি পাওয়ারি ?
- না!
- তাহলে কেন দিতেন?
- চউখ লাল , বাপ ! পলাপাইনে ডরায় , ওরা ডরাইলে ভিক্ষা পাওন যায় না। পলাপাইনের মায়েরা আর দরজা খুলে না।
আমি মহিলার চোখের দিকে ভালভাবে তাকাই। হ্যা, চোখের সাদা জমিনটা এত লাল - ভিক্ষা না জোটার জন্য বিনাদ্বিধায় ওদের কাঠ গড়ায় দাঁড় করানো যায়।
এতদিন পর ভিখারিনীকে পেয়ে আমার উৎফুল্ল দ্রবীভূত মন কি করবে ভেবে পায় না।
ভাত খাবেন ? - আমি জিজ্ঞেস করি ।
না বাবা !
আমি ভিখারিনীকে প্রথমে ২০ টাকা , তারপর আবার ২০ টাকা আবার ২০ টাকা , একটু পর আরো ১০ টাকা হাতে দেই। মনে হচ্ছে হাতে থাকা সব টাকা ভিখারিনীকে তুলে দিলেও আমার প্রায়শ্চিত্ত হবে না। হঠাৎ ভিখারিনীর চোখে জল দেখি।
- আপনি কাঁদছেন?
- ও কিছু না বাপ! চোখ থিকা আপনা আপনি ই পানি যায়।
- ডাক্তার দেখান না?
- ডাক্তার! যেন অন্য দুনিয়া থেকে ভেসে আসছে মহিলার কণ্ঠস্বর - ডাক্তার দেখাই ত বাপ ! ভিক্ষা কইরা কইরা ডাক্তার দেখাই । আমার মাইয়ার মাথা ভরা ঘা, পুঁজ যায়, রক্ত যায়, মাথার বিষে হারারাইত চিক্কুর দিয়া কান্দে, ওষুধ দিছে ডাক্তারে, প্রতি ট্যাবলেট ৮০ টেকা।
- আপনার মেয়ের জামাই কই?
- নাই! ক্যান্সারে মইরা গেছে। এই বেটার লেইগাই ত স্বামীর ভিটা বেচছি।
- আপনার মা বাবা ভাই ?
- নাই। কিছু নাই ,আমার বাপের ভিটা নদী খাইছে, ডিম চুরি করছিল আমার ভাই, তারে সমাজে খাইছে ।
- আপনার ছেলে?
- গেলবছর ট্রাকে নিয়া গেছে।
প্রথমে আমার সন্নিগ্ধ মধ্যবিত্ত মন ভাবল - ও বোধ হয় সহানুভূতি পাবার জন্য মিথ্যে বলছে। কিন্তু ভিখারিণীর চোখে চোখ পড়তেই বুঝে ফেলি সব, হারিয়ে ফেলি ভাষা,অস্পষ্ট দেখি তাকে, হয়ত সেও আমাকে, দরজার পাঠাতন হাতড়ে ধরে ত্বরিত ভারসম্য ঠেকিয়ে সে মেঝেতে বসে পড়ে। তারপর আমার দিকে চেয়ে -সে চোখে বেদনা নেই, অভিমান নেই , জীবনের প্রতি আশাহীন অভিব্যক্তিহীন নিস্পলক একজোড়া চোখ।
বুকের পাজর হতে যেন গলগল করে বেরিয়ে আসছে ব্যথা-
'' জন্মের পর থিকা আমার চাইরপাশটা খালি মরা মরা, দেইখাই যাইতেছি। ছোটবেলায় মা গেছে, বিয়া দিবার পর বাপ। সংসারের সাত বছরে জামাই, দশ বছরে মাইয়া, হের তিন বছর পরে আরেক মাইয়া।'' ভিখারিনী এরপর থামে, দম নেয়, তারপর শান্ত কোমল অদ্ভুত এক স্বরে প্রশ্ন করে -
আমি ক্যান বাইচ্চা আছি জানো তুমি ?
বুকটা কামড় খেলো তৎক্ষণাৎ, মাথাটা নিচু আর চোখটা দীনতায়। সমগ্র জীবন ব্যয় করেও এর উত্তর কি আমার জানা হবে?- কি প্রশ্নটা! আমার চোখের সামনে তখন ভেসে উঠল বাংলাদেশ নামের একটা মাঠ, সেটা ভিখারিণীর মত লাখ লাখ মানুষে ছেয়ে আছে। সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা আমাদের মত নাকউঁচু শিক্ষিত গৌড়জনদের মনোঅস্তিত্বে ওরা ব্রাত্য ,গৃহে বাস করা টিকটিকির মত, তাই আমাদের চিন্তা অনুভবে ওদের জন্য এক ইঞ্ছিও জায়গা নেই। এত সুন্দর, বর্ণিল , মনোহর,এত উপভোগ্য জীবনের মনোরম দিকগুলার স্বাদ কেন গুটিয়েকের জন্য তোলা থাকবে? কেন লাখো লাখো মানুষ অসহনীয় কষ্টের ঘানি জীবনভর টেনে যাবে? এমন অজস্র সুখহীন আশাহীন গন্তব্যহীন অথচ নিঠুর নির্মম নিয়তির চাবুক খাওয়া দগদগা জীবন অর্থহীন ঘানি টেনে চলে কেন, এর উত্তর ও সমাধান আমাদের, আমাদের নামক ভণ্ড শিক্ষিত গৌড়জনদের নাগালে থাকলেও এই অসামান্য অনাচারকে হৃদয়ের নীরব স্বীকৃতি দিয়ে মুখে শুভ্র সুন্দর সভ্যতার, সাম্যতার গুণগান গেয়ে যাব।
জানিনা কতক্ষণ ভাবনার তলিয়ে ছিলাম। সম্বিত ফিরে পেতে দেখি-
ভিখারিণী নেই, মেঝেতে পড়ে আছে টাকা, ভিখারিনীকে দেয়া আমার টাকা।
পুনশ্চ -
আর- ভিখারিণীর দেখা মেলেনি । অফিসের কাছে বাসা নেবার প্রয়োজন হওয়া সত্ত্বেও অনেকদিন বাসাটা ধরে রেখেছিলাম । কেবল আরেকবার দেখবার আশায়। একসময় হার মানতে হল।
শেষবারের মত বাসার দরজায় তালা লাগাবার খুট শব্দে ভিখারিণীর সাথে আমার ঝুলে থাকা সম্পর্কটা ছিন্ন হয়ে গেল , দরজার পাঠাতন আর মেঝেতে ভিখারিণীর অদৃশ্য উপস্থিতি অনুভব করে বিষণ্ণ অনুভূতিতে ছেয়ে গেল হৃদয় -
দিন এই বাসাতে এক ভিখারীণি নামের হতভাগিনী পা রেখেছিল, যে বুকের সবটুকু বেদনা এই দরজার চৌকাঠে উপুড় করে দিয়েছিল, যাকে আর দেখিনি, হয়ত আর দেখবনা, অন্ন - বস্ত্র - বাসস্থান - চিকিৎসা ও শিক্ষাবিহীন বাংলার লাখে লাখে ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষের কোন কাতারে হয়ত অপার বেদনা নিয়ে আমার ভিখারিনী মিশে গেছে। ওদের কেউ নেই, ওদের কেউ থাকেনা, ওরা কেবল বেঁচে থাকার প্রয়োজনে বেঁচে থাকে।
অথচ কি অফুরান সম্ভাবনা নিয়েই না জন্মায় - এই পৃথিবীর প্রতিটা মানুষ!
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ১০:৫৫