somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জীবন, আরো জীবন [‌সুখ কত বিশাল'-বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীরের কবিতাগ্রন্থালোচনা]

১৯ শে মে, ২০১১ সন্ধ্যা ৬:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

হোসেন শহীদ

যে বইটির আলোচনা; যাঁর লেখা বইটির আলোচনা_ তিনি নামেই খ্যাত। অবশ্য সেটা যাপিত জীবন ও কর্মের নিরন্তর সোনালি শস্যায়নে তিনি সিদ্ধিলাভ করেছেন। আর তাই এ আলোচনায় তেমন কিছু যায় আসে না। শুধু কবিতা নয়, গদ্য, শিল্পতত্ত্ব, রাজনৈতিক আলোচনা, সমাজ-প্রগতির তত্ত্বকথা সবকিছুতেই তিনি স্বতঃস্ফূর্ত ও প্রাণসঞ্চারী। এই বহুমুখী প্রতিভাধর ব্যক্তির নাম বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। কর্মগুণেই তাঁর নাম সমকালীন শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতে সমধিক পরিচিত।
উপর্যুক্ত প্রাককথন_ বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের কাব্যগ্রন্থ 'সুখ কত বিশাল' সম্পর্কে আলোচনার জন্য। সহজ-সাধারণ নামকরণেই যেমন বইটির ঘরানা-বিষয়বস্তু সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়, তেমনি কবিতাগুলোতেও নির্মেদ বর্ণনায় যাপিত জীবনের খুঁটিনাটি-তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনা-দুর্ঘটনা; ভালো-লাগা; মন্দ-লাগা উন্মোচিত।
মানুষের বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা যেন আমৃত্যু! কখনও কখনও কেউ কেউ নিজেকে নিজেই নিঃশেষ করে দিতে চায়। কিন্তু তার পরিপার্শ্বকে ঘিরে যে জগৎ; তার নিজের যে সৃষ্টি তার দিকে তাকিয়ে দ্বিধায় পড়ে; শেষ পর্যন্ত হয়ত বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষারই জয় হয়। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরও জীবনবাদী; আশাবাদী তাঁর কবিতায়। তাই তিনি লেখেন_ 'আমার ঘরবাড়ি থেকেও নেই/যত শেষের দিনগুলো কাছে আসে/চিরন্তন অভাব আমাকে ঘিরে ধরে/কেন শেষপর্যন্ত বাঁচব আমি জানি না,/মধ্যে মধ্যে নিজেকে হত্যা করার ইচ্ছা হয়/আমর গল্পের একটা শেষ আছে,/আমি নিজেকে হত্যা করি না এই ভেবে/আমার পালা কবুতরগুলি কে দেখবে।' [আমার পালা কবুতরগুলি কে দেখবে, পৃ. ১৪]
বাঙালির হাজার বছরের সেরা অর্জন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। তারও আগে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন-মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার লড়াইয়ে বাঙালির ছিল আরেক অর্জন। আর ১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে তা ৪০ বছর পরও যেন সুরক্ষিত নয়। তাই আমাদের কথাসাহিত্যে ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব; রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদলের চালচিত্র বিভিন্ন ভঙ্গিমায়, নানা ব্যঞ্জনায় উঠে এসেছে। 'সুখ কত বিশাল' বইয়েও এসব বিষয়-সংশ্লিষ্টতা চোখে পড়ার মতো। 'পাখিরা ঠোকরাচ্ছে তারা' কবিতায় তিনি লেখেন_ 'এদেশে সুযোগ পেলেই নচ্ছাররা রাজত্ব করে/নিজেদের বিশ্বাস করো, নচ্ছারদের না/এই হচ্ছে জীবনযাপনের ভালোবাসার।' _তার এ কবিতায় 'নচ্ছার'-এ যেন প্রচ্ছন্ন স্বৈরাচারই!
একইভাবে আমরা বলতে পারি, দেখেছিও ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষার জন্য আমরা যে ভালোবাসা-রক্ত দিয়েছি; তার মর্যাদাও যেন কখনো কখনো ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার এখনো নিশ্চিত হয়নি আমাদের এই প্রিয় ভূখ-ে। কবি ছোট্ট কয়েকটি শব্দে-ছত্রে এই বিষয়টিকে অত্যন্ত প্রাখর্যতায় উৎকর্ণ করেছেন : 'একুশ এক একর যন্ত্রণার ইতিহাস/বর্বররা কবে থেকে একুশ দখল করে রেখেছে/আবার প্রতিবাদের পতাকা ওড়াতে হবে/আবার গুলি খেতে হবে/আবার নির্বাসন থেকে ফিরে আসতে হবে।' [একুশ এক একর যন্ত্রণার ইতিহাস, পৃ. ১৯]
শিল্পিত প্রেম-ভালোবাসা ব্যক্তিজীবনের অনবদ্য কাব্যগাথা_ এই কাব্যে কবি-অকবি সকলেই দারুণ প্রাণময়! আদিরসের স্পর্শে বিবর্ণ-তামাটে নির্জীব কাষ্ঠেও সবুজের সতেজতা ক্রমশ ফুটে ওঠে! সাংসারিক জীবনের জরুরি এই নির্ঘণ্ট চমকৃত করে যে কাউকে! ছন্দে-আনন্দে-সৃজনে জীবনের জয়গানে মুখর হয় প্রত্যেকের আপন ভুবন! তবে সংসার-জীবনের নির্ভুল নির্ঘণ্টে বিভ্রাট দেখা দিলে সব অর্জন তামাদি হয়! বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর ব্যক্তির সংসার-নির্ঘণ্টের বিচ্ছেদটাকে ফুটিয়ে তুলেছেন অতুলনীয়ভাবে : 'সারাজীবন কেউ একসঙ্গে থাকে না/কেউ মরে যায়/কেউ দূরে সরে যায়/কেউ অন্য কোথাও অন্য কারো সঙ্গে,/তখন পাখিদের সঙ্গে/একা বসে চা খাও' _[তোমার উরুতে রাত, পৃ. ২১]।
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর লেখালেখির বাইরে শিক্ষকতা করেছেন দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঘুরেছেন অর্ধেক পৃথিবী। তার কবিতা সম্পর্কে 'সুখ কত বিশাল' কাব্যগ্রন্থের প্রথম ফ্ল্যাপে লেখা হয়েছে : 'যে কবিতা স্রোতের মতো চলতে থাকে নির্জনে, যে কবিতা গির্জার ঘণ্টার মতো ঢং ঢং বাজে, যে কবতা (হবে কবিতা) বনের ঘাসের মতো জেগে থাকে বাতাসের সাথে, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর সেধরনের কবিতাই লেখেন। তাঁর কবিতা কোলাহল তৈরি করে না, অন্তরের মাঝখানে গিয়ে জায়গা দখল করে নেয়। জীবন, আরো জীবন, আশা এবং রাজনৈতিক প্রত্যয় এসবই হলো তাঁর সৃষ্টির মায়াময় পদ্মপাতা।' ফ্ল্যাপের এই বক্তব্য শতভাগ সমর্থনযোগ্য। সত্যি কথা বলতে 'সুখ কত বিশাল' আদতেই জীবন, আরো জীবন।
বইটির প্রচ্ছদ ও ছাপার মান গতানুগতিকতার বাইরে যেতে পারেনি। সেটা মেনেও নেওয়া যায়। কিন্তুবেশ কিছু বানান বিভ্রাট [কবতা] পীড়াদায়ক। তবে এসবের বাইরে কবিতা-পাঠকদের কাছে কবিতাগুলো তার নিজ গুণে সুখপাঠ্য হবে এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়। গ্রন্থভুক্ত সব কবিতা সম্পর্কে আলোকপাত করার ক্ষেত্র এটি নয়, কিন্তু লোভ সামলানো মুশকিল। তাই আগ্রহী-কৌতূহলী পাঠকদের জন্য অন্তত বাকি কবিতাগুলোর শিরোনাম এই স্বল্প পরিসরে উল্লেখ করছি। শিরোনাম পাঠেও যে এক ধরনের আনন্দ আছে তা নিশ্চয় বোদ্ধা পাঠকরা স্বীকার করবেন! এক পলকে শিরোনামগুলো দেখে নেওয়া যাক_ তুমি তালিকা চেয়েছ, এ হচ্ছে গিফট, এই বাস্তবতা দয়া করে না, এখানে মাটির নিচে, তোমার জন্য আমি বিলাপ করব, তারাগুলি সিংহের মতো জ্বলছে আকাশে, হেমন্তের আলোর ভেতর, প্রিয়তমা কোথায় আছে, আমার চোখে হেমন্তের শিশির, আর গাইতেন এলোমেলো, সুখ কত বিশাল, হয়ত ফসল দ্বিগুণ হবে, ঈশ্বরের মুখ আমি দেখেছি, আমরা পাহাড়ের মাথায় টাউনটি ছেড়ে, সারা পৃথিবী জুড়ে, আমরা কিছুই ভুলিনি, দরজা পর্যন্ত যেতে পারবে, আমাদের দুজনের সম্পর্ক, সুখ কি এখনো সম্ভব, এমন বৃষ্টি, আমি ভাবি, তোমার কাছে আসতে চাই, তুমি ভালোবাসা চাও, তোমার আঙ্গুল যখন মোহন হয়, যে রাষ্ট্রে বসবাস করি, হাঁটতে হাঁটতে আমি এক গোরস্থানে, দিনযাপন, আমি কি একা।
'সুখ কত বিশাল' কাব্যগ্রন্থের শেষ কবিতা 'শেষ পাথরটা তোমাকে দেব ভেবেছি'র শেষ স্তবকের আগের স্তবকে আছে_ 'শেষপর্যন্ত ভালবাসাটা থাকে,/বাকিটা গিলে খায় দিনকাল আর দিনযাপন।' সত্যিই সংসার সমুদ্রের সব মিথ্যে; ব্যস্ততা-সময়ের প্রয়োজন কিংবা অনিবার্য কারণে সবকিছুই নিঃশেষ হয়, শুধু টিকে থাকে ভালোবাসাটাই! _কবির কবিতার এই স্তবকের সঙ্গে মিলিয়ে এই কবিতাগ্রন্থটি সম্পর্কে বলা যায়_ শেষপর্যন্ত কবিতাই থাকে,...।

সুখ কত বিশাল বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর প্রচ্ছদ : ধ্রুব এষ প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০১১ প্রকাশক : খেয়া প্রকাশনী, ঢাকা দাম : ৬০ টাকা।

[বি. দ্র. : লেখাটি আজকের সংবাদ সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে]
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে মে, ২০১১ সন্ধ্যা ৭:০২
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=আকাশে তাকিয়ে ডাকি আল্লাহকে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০১


জীবনে দুঃখ... আসলে নেমে
শান্তি গেলে থেমে;
আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে হই উর্ধ্বমুখী,
আল্লাহকে বলি সব খুলে, কমে যায় কষ্টের ঝুঁকি।

আমি আল্লাহকে বলি আকাশে চেয়ে,
জীবন নাজেহাল প্রভু দুনিয়ায় কিঞ্চিত কষ্ট পেয়ে;
দূর করে দাও সব... ...বাকিটুকু পড়ুন

"ছাত্র-জনতার বেপ্লবের" ১৮ মাস পরে, আপনার ভাবনাচিন্তা ঠিক আগের মতোই আছে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৭



২০২৪ সালের পহেলা জুলাই "ছাত্র-জনতার বেপ্লব শুরু হয়, "৩৬শে জুলাই" উহা বাংলাদেশে "নতুন বাংলাদেশ" আনে; তখন আপনি ইহাকে ব্যাখ্যা করেছেন, ইহার উপর পোষ্ট লিখেছেন, কমেন্ট করেছেন; আপনার... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

টাঙ্গাইল শাড়িঃ অবশেষে মিললো ইউনস্কর স্বীকৃতি

লিখেছেন কিরকুট, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৫৭



চারিদিকে যে পরিমান দুঃসংবাদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এর মধ্যে নতুন এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা হলো বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের তাতের শাড়ি এর জন্য, ইউনেস্কো এই প্রাচীন হ্যান্ডলুম বুননের শিল্পকে Intangible Cultural... ...বাকিটুকু পড়ুন

×