জিলাপি বলতে আগে আমি মুচমুচে জিলাপিই বুঝতাম। শহরের দোকানে যেসব জিলাপি ভাজা হয়ে থাকে আরকি। অবশ্য শহর নিয়েও বোঝাবুঝির ব্যাপার আছে। অনেকে অনেকদিন ধরে ঢাকা কিংবা বড়জোর চট্টগ্রাম বা খুলনা-রাজশাহীকে শহর ভাবতে ভাবতে ভুলে গিয়ে থাকেন যে ছোটশহরও শহরই। তবে এমন মানুষও আছেন যাঁরা অন্তত মফস্বল যে শহরই সেটা মনে রাখেন। তো সেসব শহরে মিষ্টির ‘প্রচলিত বনেদী’ দোকানে জিলাপি অত সুলভ নাও হতে পারে। ফলে শহরে জিলাপি সকল সময়েই অল্প জায়গায় পাওয়া যাবে।
একবার জাফর কাকা বললেন তাঁর সঙ্গে ঝাউবাড়িয়া যেতে। মানে নেমন্তন্ন করলেন। তখন আমি নাইন বা টেনে পড়ি। তখন আমাকে নেমন্তন্ন করা মানে হলো মায়ের কাছে অনুমতিও নেয়া। জাফর কাকা আমাদের বাড়িওয়ালা ছিলেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি ছিল ঝাউবাড়িয়া। মানে অবশ্যই শহরে, মানে ছোটশহরে, একখানা বাড়ি ছিল। তা না হলে তো আমরা ভাড়াটে থাকতাম না। মা অনুমতি দিলেন। বাড়িওয়ালার বাৎসল্যে মানা করেন নাই। হিসাব মতে আমার তখন একখানা নামকাওয়াস্তে সাইকেল থাকার কথা। কিন্তু সেই সাইকেলে গেছিলাম কিনা মনে নেই। যদি তিনি তাঁর সাইকেলে নিয়ে গিয়ে থাকেন, এতদিন পর ভদ্রলোকের কষ্ট মনে করে খারাপ লাগছে। ৫/৬ কিলোমিটার রাস্তা হয় কাদা নাহয় ধুলা। মেহেরপুর থেকে গ্রামগুলোতে যাবার রাস্তা তখন তাই। শুকনা থাকলে হাঁটুধুলা, বৃষ্টি পড়লে হাঁটুকাদা। হাঁটু একটু বেশি বলা হলো যদিও।
তারপর গেলাম গিয়ে মেলাতে। পরদিন সকালবেলা উঠে সাইকেল চালিয়ে, বা কাকার সাইকেলে চেপে। আমার জীবনে ওটা মহা এক ঐতিহাসিক দিন। এই প্রথম কোনো ‘গ্রামীণ মেলা’তে গেছিলাম আমি আমার জীবনে। ওটা ছিল মহররমের মেলা। তো, মেলার কোনো স্পষ্ট দৃশ্য মনে পড়ে না। কেবল মনে পড়ে আমি অনেক ঘুরেছি কাকার সঙ্গে। জাফর কাকার আম্মার রান্নায় দুপুরের খাবার খেয়েছি সম্ভবত। আর মেলাতে বিকেল সন্ধ্যার আলো পড়ে যাবার একটা অস্পষ্ট স্মৃতিও মনে পড়ে। কিন্তু মূলত জিলাপি। মাটিতে গর্ত করে বানানো চুলাতে বসে গ্রামের দোকানি জিলাপি ভাজছেন, আর আমি খাচ্ছি। অবশ্যই কাকার সৌজন্যে। গুড়ের জিলাপি। আর জিলাপিটা ভাজার পরও টাটকাতেও নরম থাকে। এটা আরেক কৌশলের জিলাপি। ঠাণ্ডা হবার পর পোতায়ে যাওয়া তো সকল খাবারেরই বৈশিষ্ট্য। এটা টাটকাও পোতানো। ঢাকার গাব্দাগোব্দা যে জিলাপিগুলোকে ‘শাহী’ জিলাপি বলে, সেটা তখন এমনিতেও চিনি না। সম্ভবত কাকা বলছিলেন ওই জিলাপিগুলো এরকম নরম হবার কারণে জিলাপি খাওয়ার প্রতিযোগিতার জন্য ওই জিলাপি সেরা। প্রতিযোগিতার জন্য নরম বানানো, নাকি নরম পাওয়া গেছে বলে প্রতিযোগিতা তা আমি জানি না অবশ্য।
তো আমার জীবনে অনেকগুলো প্রথম। প্রথম গ্রামীণ মেলা, প্রথম গুড়ের জিলাপি, প্রথম নরম জিলাপি, প্রথম মহররম, সম্ভবত বাড়িওয়ালার সঙ্গে প্রথম কোনো সফরও।
মেহেরপুর থাকতে আমি কয়েকবার জিজ্ঞাসা করেছি লোকজনকে মেলাটা আর হয় কিনা তা নিয়ে। তবে সেসবও তো কবেকার কথা। আমি মেহেরপুর ছেড়েছিও মোটামুটি ৩৪ বছর, আর পাকাপাকি ছেড়েছি ১৭ বছর। কিন্তু বিষয়টা কেবল মেলাটা থাকা বা না-থাকার নয়। বাংলাদেশের “গ্রামীণ মেলা”গুলো এখন নানান শিল্পপণ্য বিক্রিবাট্টার একটা অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। তবে সেসব আলাপ আরেক প্রসঙ্গ। আজকে একটা রচনাতেই সব সেরে ফেলা যাবে না। ভাবছিলাম মহররম বা আশুরার কথা।
সেই কোন সুদূর ঝাউবাড়িয়াতে, কোন সাবেক কালে যে দিবস-স্মারকটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল, সেই স্মারকটির বাংলাদেশে কী অবস্থা! ঢাকাতে কী অবস্থা! ঢাকার আশুরার শোভাযাত্রাটি গত কয়েক বছরে নানান কারণে মলিন বা ক্ষীণকায় হয়েছে। কখনো নিরাপত্তার কারণে শোভাযাত্রাতে বিভিন্ন উপকরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কখনো “তাঁদের” উপর হামলা হতে পারে এই আশঙ্কায় কমিয়ে ফেলতে বলা হয়েছে। কখনো “তাঁদের” উপর বোমা হামলা সত্যি সত্যি হয়ে গেছে। এসব খবর কমবেশি লোকে পান, পত্রিকায় যেহেতু এসেছে। কিন্তু আশুরার শোভাযাত্রা আর যাত্রীদের উপর নানান ধরনের প্রকাশ্য ও নীরব আক্রমণের নানান খুঁটিনাটি আমরা জানি না। আশুরা যাঁদের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান “তাঁরা”ই ভাল বলতে পারবেন বাংলাদেশে নিজ-নিজ উৎসব/অনুষ্ঠান/দিবস পালনে “তাঁদের” বান্ধব-পরিবেশ বোধ হয়, নাকি নির্বান্ধব।
ধানের বৈচিত্র্য কমে যাচ্ছে, পাখির বৈচিত্র্য কমে যাচ্ছে। এসব নিয়ে লোকে আক্ষেপও করে থাকেন। খুবই ন্যায্য সেই আক্ষেপ। মানুষের বৈচিত্র্যও কি বাংলাদেশ সুলভ থাকছে? কিংবা সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য! তাছাড়া বাংলাদেশের দৃশ্যমান শিয়ারা মুখ্যত গরিব। অপেক্ষাকৃত বড়লোক শিয়ারা সম্ভবত নিজ পরিচয় “লুপ্ত” করেছেন; বা হয়তো “গুপ্ত”। গুড়ের জিলাপির মতো!
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে আগস্ট, ২০২০ দুপুর ১:১১