somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কীভাবে ‘ঐতিহ্য’রা হারিয়ে যায়? মায়াকান্না নয়, পলিটিক্যাল-ইকনমিক ভাবে শিখুন

০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০২০ বিকাল ৩:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আজ আমরা ঐতিহ্য নিয়ে ভাবব, বন্ধুগণ। ঐতিহ্য প্রসঙ্গ এলেই আপনাদের অনেকের যেমন কান্নামাখা গলাভেজা জাতীয়তাবোধ জাগরুক হয়, সেটা মেহেরবানি করে খানিকক্ষণের জন্য অব্যাহতি দিন। নাহলে এই হারিয়ে যাওয়া বিষয়ক আজকের বোঝাবুঝিতে ভেজাল বাধবে। তবে আমাদের আলোচ্য বিষয় খাদ্যবস্তু বিধায় জাতীয়তাবোধের সঙ্গে আপনাদের লোভও জাগতে পারে।

ধরা যাক রুমালি রুটি, কিংবা বাঙ্গির হালুয়া। না ধরুন, বাখরখানি; এটাই ফাইনাল। বাখরখানি অবশ্য আপনার অত্যন্ত নরম ডেলিকেট হাতে ধরতে হবে। এটা ‘পুরান ঢাকা’র ‘ঐতিহ্য’ ইত্যাদি নিয়ে নানান কথা আপনি বলতেই পারেন। তবে সবচেয়ে ভাল হয় খাবার সময় এসব আলোচনা না-করা। এটা খুবই নাজুক ও ডেলিকেট বস্তু। আপনার আলাপের সময় আধচিবানো বাখরখানি ধুলিময় হয়ে আপনার প্রিয়তম, কিংবা বসের মুখে গিয়ে পড়তে পারে।

তো, এটা এখনো ‘বিলুপ্ত’ ঐতিহ্য নয়। তবে ধারণা বা আশঙ্কা করা যেতে পারে এর অবলোপের। এই বস্তুটার পরতে পরতে লেয়ারে লেয়ারে এমন কেয়ার থাকে, ধরলেই বুঝতে পারবেন যে এর কারিগরের নিষ্ঠার সঙ্গে তা শিখতে হয়। কারিগরের ওস্তাদ থাকেন, তাঁর ওস্তাদ থাকেন, তাঁরও ওস্তাদ থেকেছিলেন। পরম্পরা যাকে বলে, ঐতিহ্যের ক্ষেত্রে যা অতীব প্রাসঙ্গিক। এর আটা-ময়দাও, আন্দাজ করা যায় বিশেষ পদ্ধতিতে প্রক্রিয়াজাত করা লাগে। এর চুলাও যে কোনো চুলা নয় যে টু-বার্নার একটা জায়গামতো লাগিয়ে নিলেন।

তো এই লেয়ারসম্পন্ন কেয়ারজাত বস্তুটা তো বানাতে হবে! ধরা যাক একটি কারখানাতে ২টা চুলায় ৪ জন কারিগর ২৪ ঘণ্টায় ২০০০ বাখরখানি বানানো যায়। এটা কাল্পনিক সংখ্যা মাত্র। অন্য সময়ে আমরা গিয়ে জেনে আসতে পারব।

কারিগরের বেতন ও মালিকের আয় বিষয়ক একটা আলাপ আমাদের এখন করা লাগতে পারে। যদি আমরা ধরে নিই যে বাখরখানি-কারিগর ব্যাংকের সেকন্ড অফিসারের থেকে কিংবা কলেজের প্রভাষকের থেকে কিংবা টিভির উপস্থাপকের থেকে কম বেতন পান, তাহলে আমাদের সেই ধরে-নেয়া একদম ঠিক আছে। কিন্তু, যদি আমরা ধরে নিই, বাখরখানি-কারিগর বাড়ির সামনে সালামপ্রহরীর চাইতে বেশি বেতন পান, তাহলে আমাদের ঠিক হবার সম্ভাবনা বেশ কম থাকতে পারে।

একইভাবে, যদি মালিকদের আলাপও করি! ধরুন দুইচুলার বাখরখানির কারখানা মালিক তিনচাকার একটা রিকশার মালিকের তুলনায় বেশি আয় করেন ধরে নিলে অবশ্যই আমরা সঠিক হতেও পারি। কিন্তু তিনি দুই ভবন বিশিষ্ট গার্মেন্ট কারখানার মালিকের থেকেও বেশি আয় করেন ধরে নিলে আমাদের ভুল হবার সম্ভাবনাই বেশি, তা তিনি যতই না কেন (বাখরখানি) শিল্পপতি হয়ে থাকুন।

মোটের উপর, তার ওই ২০০০ বাখরখানি হলো গিয়ে, ভাঙাটাঙা সমেত, চারজন কারিগর, দুইটা চুলার কাঠ, কারখানার ভাড়া ও নিজের মালিকগিরি সামলানোর, দৈনিক রসদ। এখন প্রথমত, আপনি যতই ৫টাকায় একখানা বাখরখানি কিনতে ইচ্ছুক থাকুক না কেন, দিনে ২০০০ বাখরখানি তিনি কিছুতেই দশ হাজার টাকায় খালাস করতে পারেন না। দ্বিতীয়ত, তা তিনি পারলেও তাঁর কর্মচারিকে (তথা ঐতিহ্যের সম্মানিত কারিগরকে) ব্যাংকের ক্যাশিয়ার কিংবা কলেজের লাইব্রেরিয়ান কিংবা এমনকি লেগুনার ড্রাইভারের মতো সমান তালে বেতন দিতে পারবেন না।

তো এভাবে চলতে চলতে, কারিগর যদি ২০২৪ সালে কারোর বাড়ির সামনে গিয়ে সালাম দেবার চাকরিটা নিয়ে নেন, তখন ঐতিহ্য খোয়ানোর জন্য সেই বাড়ির মালিক বা এই চুলার মালিক কিংবা সালামওয়ালা সাবেক বাখরখানিওয়ালা কাউকেই আপনি দায়ী করতে পারবেন না। আপনি বড়জোর একটা মায়াকান্নামূলক বিলাপ বা রচনা লিখতে পারবেন। অবশ্যই ঐতিহ্য বিষয়ক।

তারপর বর্তমানের ওই কারিগর যখন ভবিষ্যতে উর্দি-পরে সালাম দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, বা ধরুন লন্ড্রির ইস্ত্রি চালাচ্ছেন, তখন তাঁর কাছে ‘ঐতিহ্যে’র লোভে কেউ বাখরখানি বানানো শিখতে যাবারও উপায় থাকে না।

তাছাড়া তিনি তখন ওই বিদ্যা আর নিজেও ঘোষণা দিতে না-চাইতে পারেন। তারও কিছুকাল পরে তিনি নিজেও ভুলে যেতে পারেন। আর বাখরখানিবিদ্যাধারীর ইস্তিরি চালানো দেখে আপনিও হয়তো আর বাখরখানি বানাতে শিখতে না চাইতে পারেন।

এভাবে ‘ঐতিহ্য’ হারিয়ে যেতে পারে। এই পর্যন্ত পাঠ করে যদি লুপ্তিসম্ভাবনাময় বাখরখানি ঐতিহ্যের জন্য আপনার মনভার হয়, এখন আপনি কাঁদতে পারেন অবশ্যই। তবে সত্যি সত্যিই বাখরখানি মুখে পুরে সেটা করবেন না। ওটা আসলেই খুব ডেলিকেট।

(আদাবর, ১০ আগস্ট ২০২০।। সাম্প্রতিক ব্লগে ১০.০৮.২০ প্রকাশিত।। সহজ সমাজপাঠ)
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০২০ বিকাল ৩:০৯
৭টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×