জাতীয় পরিচয়পত্র বা এনআইডি নিয়ে আমার গিন্নির সচেতন মনোভাব দৃষ্টান্তমূলক। মানে মূলগতভাবে আইডির গুরুত্ব বিষয়ে আমি যতই না কেন তাঁর সঙ্গে একমত থাকি, তিনি হাতে আইডির দৃষ্টান্ত না পাওয়া পর্যন্ত দান ছাড়তে খুব একটা ইচ্ছুক ছিলেন না। ২০০৭ সালে বার দুয়েক আইডি সংগ্রহের জন্য এদিক-ওদিক আমি গেছিলাম। জরুরি অবস্থার দেশ তখন। দেশ-পরিচালকদের জরুরি মনোভাব দেখে ফিরেও এসেছিলাম। আমার বউয়ের সঙ্গে তখনো আমার পরিচয় হয়নি। গিন্নি হিসাবে তো নয়ই, সাধারণ কুশল বিনিময়েরও নয়। এর বছর খানেকের মধ্যেই আমাদের পরিচয় ঘটে, এবং অচিরেই আমরা হবুবিয়ের বিষয়ে একমত হই।
পরিচয়ের সময়ে তিনি জানতেন না যে আমার এনআইডি নাই। অচিরেই তিনি জানলেন, এবং তারপর নিয়মিতভাবে আমার আইডি বানানোর বিষয়ে লাগাতার আমাকে তাগাদা দিতে লাগলেন। এটা ঠিকই যে তিনি বিয়ের শর্ত হিসাবে আইডিলাভকে হাজির করেননি, কিন্তু আগামীর বাংলাদেশে আইডির গুরুত্ব বিষয়ে তিনি দূরদর্শী আর লক্ষ্যনিষ্ঠ ছিলেন। তাঁকে দেশের সুনাগরিক হিসাবে সাব্যস্ত করা ছাড়া আমার কোনোই উপায় থাকল না। বস্তুত, নিজের আইডির একটা ব্যবস্থা করা ছাড়াও আমার বিশেষ পথ খোলা থাকল না। তাঁর সঙ্গে পরিচয়ের কমবেশি বছর চারেকের মধ্যেই যে আমার নিজের একখানা আইডি তৈরি হলো সেটার মুখ্য কৃতিত্ব আমার স্ত্রীকেই দিতে হবে। তিনি আমার আইডি না-হওয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে আমার কর্তব্য কিছুমাত্র ভুলতে দেননি। আইডি বানানোর তৎপরতা ছাড়াও তিনি আইডির ফোটোকপি করানোর বেলাতেও অতি সজাগ। যেখানেই তাঁর আইডির কপি জমা দেয়া লাগতে পারে, সেখানেই তাঁর মজুদ থাকে। তিনি আগাম আন্দাজ করেন কবে কোথায় লাগতে পারে এবং আগাম সেগুলো ফোটোকপি করিয়ে সঙ্গে রাখেন। প্রায়শই প্রয়োজনের থেকে বেশিই করিয়ে ফেলেন।
এদফা তিনি আমাকে তিন কপি করতে বললেন। আমিও সুনাগরিক হিসাবে পাঁচ কপি করব বলে সাব্যস্ত করলাম। করোনায় নিরাপদ মধ্যবিত্ত হিসাবে নাকে খোলস ইত্যাদি পরার পর বেরোনো একটা ঝক্কি। তার মধ্যেই আরো দুচারটা মৃদু কাজ একত্রে নিয়ে বের হলাম লুঙ্গি-পরা অবস্থায়। বাসার পাশেই আরিজা টাওয়ার, মানে ৭/৮ তলার একটা মাল্টিপারপাস ভবন যার। সেখানে নিচতলা আর দোতলা হলো দোকানপাট, আর উপরের তলাগুলো মধ্যবিত্ত আবাসস্থল। আদাবরের এই এলাকায় আসার পর রিকশাওয়ালা কিংবা দোকানদারদের কখনোই জিজ্ঞাসা করা হয়নি যে এটার নাম ‘আরিচা টাওয়ার’ কেন। নিজের ডিডাকটিভ মন থেকে সাব্যস্ত করেছিলাম নিশ্চয়ই এই ভবনের মালিকের বাড়ি আরিচাতে। এরকম ভাবেই চলছিল। একদিন আচমকা চোখে পড়ে যায়, ভবনের নিচের ঢোকার পথেই খোদাই করে লেখা আছে ‘আরিজা টাওয়ার’। এরপর লোকজনকে খুব জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা হতো আরিজাকে আরিচা কেন বলেন তাঁরা। কিন্তু একটা পেঁচানো আলাপ হতে পারে ভেবে আর সেই প্রশ্নও করি না কখনো। ঝামেলাটা হলো যে, একবার আরিজা জানার পর কিছুতেই আমার মুখ থেকে আর আরিচা আসে না। আর আমি আরিজা বললে রিকশাওয়ালারাও আর চেনেন না। তবে কপালগুণে বাসা থেকে কয়েক কদম হবার কারণে এদিক থেকে কখনো আমার রিকশা নেয়া লাগে না। তাছাড়া নিচতলার দোকানগুলোর মধ্যে ‘আঙ্গিনা’ বলে একটা মনোহারী/জেনারেল স্টোর আছে। সেটারও নামডাক আছে। ফলে খুব বলার দরকার হলে সেই ডাকনামেও চালিয়ে দিই।
এদিন গিন্নির এনআইডি ফটোকপি করতে গিয়ে আসলে এসবের কিছুই ভাবার দরকার পড়েনি। আমাদের বাসা থেকে দেড়শ গজও হবে কিনা সন্দেহ। কিন্তু লুঙ্গিপরা আমার খানিক দোনোমনা ছিল ‘আরিজা টাওয়ার’-এর নিচতলার একমাত্র কম্পুটার-প্রিন্টের দোকানটি খোলা থাকবে কিনা। না-থাকলে আমার আরো দূর অবধি যেতে হবে। এমন নয় লুঙ্গির কথিত আপদ-বিপদ কাছের গন্তব্যে কম বা দূরের গন্তব্যে বেশি, কিন্তু কোনো এক কারণে অধিক দূরে লুঙ্গি পরে যাওয়ার মানসিক প্রস্তুতিটা আলাদা।
ছোটো ওই কম্পুটারের দোকানটিও মাল্টিপারপাস। সেরকমই হবার কথা। যদি আমার দেখার ভুল না থাকে তাহলে সেখানে মোটামুটি যেসব পরিষেবা দেয়া হয় তা হলো: মোবাইল ফ্লেক্সিলোড, বিকাশ লোড, খাম বা প্লাস্টিকের খাপ বিক্রি, ইমেইল করে দেয়া, ফোটোকপি, কম্পুটার ফাইল মুদ্রণ ইত্যাদি। হিসাব মতে আমার এখন ফোটোকপি/জেরক্স মেশিনের পরিষেবা নেবার কথা। কিন্তু আমি বাসা থেকে জাতীয় পরিচয়পত্রটি স্ক্যান করে পেনড্রাইভে ভরে এনেছি। ফলে পরিষেবার ক্যাটেগরি বদলে গেছে। আমি এখন কম্পুটার-মুদ্রণ পরিষেবাগ্রাহী। এখানে যে মানুষটি চেয়ারে, তথা কম্পুটারের সামনে বসে রয়েছেন তাঁকে আমি কখনো দেখে থাকলেও আমার স্পষ্ট মনে নাই। আর দুচারটা কথা বলে খায়খাতির জমানোর যে চেষ্টা আমার সাধারণভাবে থাকে, তাও কখনো ঘটেনি তা আমি নিশ্চিত। নাম জানার তো প্রশ্নই নাই। এরকম জন-পরিসরে খায়খাতির বা সান্নিধ্যের (শাস্ত্রে বলে র্যাঁপো) এসব আলাপ করতে আমি অতি উৎসাহী। কিন্তু যত বুড়া হই, ততই বেদনার সঙ্গে নিশ্চিত হতে থাকি যে এগুলো ওয়ান-টাইম গ্লাসের মতো। একবারের পর পরেরবার আবার নতুন। মুখটা পরস্পর যদি চেনা কবুল করি, সেটাই বড়জোর পাওনা।
পাড়ার দোকানীরা অবশ্য এসব ক্ষেত্রে পেশাগত দক্ষ হয়ে থাকেন। মধ্যবিত্ত চাকুরেদের সঙ্গে পরিচয়ের পর মনে-রাখা, অন্তত মুখ মনে-রাখা, এঁদের এক দুর্দান্ত দক্ষতা। তার সঙ্গে গুরুতর কিছু বিত্তান্তও মনে রেখে ফেলেন। যেমন ‘ওমুক স্যার ওইদিকের কোণার বিল্ডিংয়ের সম্ভবত ৩/৪ তলায় থাকে, সেক্রেটারিটে চাকরি করে, ওইদিনের কালা গাড়িটা হ্যার’—মোটামুটি এরকম একটা বায়োনোট মুখটার সঙ্গে তাঁরা রেখে দিতে পারেন। নামটা জেনে নেবার কারণ তৈরি হয় কম। ফলে জানেনও কম। তার মধ্যে দোকানের চরিত্রের সঙ্গেও এই দক্ষতার বিষয়টা সম্পর্কিত। ধরা যাক, জেনারেল স্টোরের মালিক/ম্যানেজারের তুলনায় ওষুধের দোকানের পরিচালক কম বায়ো জানবেন। আবার মোবাইল ফ্লেক্সিওয়ালা বায়ো না জানতে পারেন, নামটা জানার সম্ভাবনা অনেক বেশি, যেহেতু তাঁর দুয়েকবার ফোনেও ফ্লেক্সি ভরে দেবার অনুরোধ এসে থাকবার কথা। পক্ষান্তরে, পাড়ার টিমটিম করে-চলা কম্পুটার-প্রিন্টের দোকানী কারোরই কিছু না জানতে পারেন। না-জানারই সম্ভাবনা বেশি। বড়জোর তিনি খসড়াভাবে জানবেন কার বাসায় প্রিন্টার নাই, কিংবা প্রিন্টার থাকলেও কালি শেষ হয়ে গেছে। ফ্লাটবাড়ির বাসিন্দাদের কম্পুটার যেন না-থাকে এরকম কোনো অভিশাপও তিনি রাগবশত দিতে পারেন না। বস্তুত, এসব বাসিন্দাদের কম্পুটার আছে ও প্রিন্টার নাই এই বাস্তবতাটিই বরং তাঁর অস্তিত্বের হেতু।
দোকানি আমার দিকে তাকিয়ে কুশল হাসি দিলেন। কিন্তু আগে কখনো তাঁর সঙ্গে গুরুতর কোনো আলাপ হয়েছিল বলে আমার মনে পড়ে না। আমার লুঙ্গিখানির দিকে কোনোরকম আগ্রহ দেখালেন না তিনি। এরকম লুঙ্গিনিরপেক্ষ দৃকপাত তুলনামূলকভাবে কাঁচাবাজারে সুলভ। পাড়ার মনোহারী দোকানে বিরল। কম্পুটার-প্রিন্ট বা এরকম দোকানে অসম্ভবপ্রায়। আমি তাঁকে পেনড্রাইভ এগিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞাসা করলাম পোকামাকড় আছে কিনা। তিনি এবারে ঝলমল করে হাসলেন। ৫ কপি প্রিন্ট করে দিতে বললাম তাঁকে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন রঙ্গিন নাকি সাদাকালো। তিনি জিজ্ঞাসা করার আগে আমার মাথায় এই প্রশ্ন্ আসেনি। আমি সাদাকালোতে দ্বিধাহীন মনস্থিরই ছিলাম মনে পড়ে। তবে জাতীয় পরিচয়পত্র যে একটা রঙিন আইটেম সেটা আমার থেকে তাঁর নিশ্চয়ই পোক্তভাবে মনে থাকে। তিনি নিশ্চয়ই মাসে কয়েকবার এই বস্তুটি প্রিন্ট করে দেন। তবে সম্ভবত তিনি ফোটোকপি করেন বেশি। আর ফোটোকপি বা জেরক্স মেশিনের বেলায় রঙিন কালিওয়ালা মেশিন পাড়ার দোকানে তুলনামূলকভাবে কম থাকার কথা। ফলে আমি যদি গিন্নির আইডিকার্ডটি স্ক্যান না করে জ্যান্ত নিয়ে আসতাম তাহলে হয়তো এই প্রশ্ন তাঁকে করতে হতো না। তিনি প্রশ্ন করায় আমি কিছু একটা বলতে হবে বলে বললাম দুইটা রঙিন আর তিনটা সাদাকালো করে দিতে। উত্তরটা দিতে যাবার সময়ই আমার মনে পড়ল যে এটা দামের সঙ্গেও সম্পর্কিত। আমি যখন উত্তর দিচ্ছিলাম তখন কপিপ্রতি দাম খুব একটা মাথায় ছিল না। একটা গ্রহণযোগ্য উত্তর দেবার জন্যই দেয়া।
এবারে তিনি যেটা করলেন সেটা আমার জন্য এক অভূতপূর্ব আতিথেয়তা। তিনি বললেন “আপনাকে আমি ৫ কপিই রঙিন করে দিচ্ছি। আপনি আমাকে ২ কপি রঙিনের দাম দেবেন আর ৩ কপি সাদাকালোর দাম দেবেন।” এই আপ্যানের উত্তরে কী বলব বুঝতে না পেরে আমি কেবল বললাম “না না তা কেন, আমি ঠিকঠাক দামই দেব।” তিনি শুরুর হাসির আরও মোহনীয় একটা ভার্সন নিয়ে আসলেন তাঁর মুখে। “ভাল মানুষের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করতে হয় ভাই। ব্যবসাটা বড় কথা না। এই এখানে যে দোকানদারেরা আছে, আমি সবার মত না। আমি অন্যায়ের প্রতিবাদ করি, আর ভাল মানুষের কদর করি।”
আমার ধারণা আমার মুখে তখন একটা উদ্ভট হাসি, হয়তো বোকা-বোকাই। আমার মাথায় নানান আলাপ ঘুরতে লাগল। কিন্তু কোত্থেকে কী শুরু করব – আমি ভাল লোক কেন, কিংবা আমি আসলে যে ভাল লোক নই, কিংবা তিনি কীভাবে প্রমাণ পেলেন, কিংবা যদি সন্দেহাতীত ‘ভালমানুষ’ আমি হয়েই থাকি তাতেই বা প্রিন্টমূল্য কম নিতে হবে কেন! আরো মেলা প্রশ্ন। কিন্তু কোনোটাই শুরু করা সুবিধাজনক লাগল না। ভাবলাম এভাবে দেখি, রসগোল্লার দোকান হলে নিশ্চয়ই তিনি একটা মাগনা খেতে দিতেন।
(২৮ সেপ্টেম্বর, ১১ অক্টোবর ২০২০।। আদাবর, ঢাকা)
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা নভেম্বর, ২০২০ দুপুর ১২:১৫