somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

"হুমায়ূন আহমেদ-জাফর ইকবাল কেন যুদ্ধ করেননি?"

১৪ ই নভেম্বর, ২০১৮ রাত ১:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শুরুতে একটি ঘটনা বলি। সবাই মন দিয়ে পড়ুন। লেখা শেষে কেন এই ঘটনাটি বললাম, সেটা ব্যাখ্যা করবো।
মুসলিমদের ইতিহাসে খন্দকের যুদ্ধ ছিল ভয়াবহ একটি দুর্যোগের নাম। পুরো একটা মাস টান টান উত্তেজনার মধ্য দিয়ে দিন এবং রাত কেটেছে। স্নায়ুর উপর দিয়ে এমন ঝড় আর কখনই যায়নি।
কুরাইশ নেতৃত্বে পুরো আরব সমাজ তাদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতন একতাবদ্ধ হয়ে মুসলিম বিনাশে মদিনার উদ্দেশ্যে হাঁটা দেয়। প্রায় দশ হাজার সেনার এক বিশাল বাহিনী। মুসলিম জনসংখ্যা, নারী পুরুষ বৃদ্ধ ও শিশু মিলিয়ে দুই আড়াই হাজারও না। ওরা মদিনায় ঢুকে গেলে স্বমূলে ধ্বংস হয়ে যাবে ইসলাম। সবার ভরসা আল্লাহর উপর, কিন্তু আল্লাহতো আর শুধুশুধু সাহায্য করবেন না। তাঁদেরও পরিশ্রম করতে হবে। কিন্তু যদি যুদ্ধ বাঁধে, তবে অবশ্যই সবাই মারা পড়বেন - এইটা মোটামুটি নিশ্চিত। শহীদ হওয়া নিয়ে কারোর কোন টেনশন নেই - কিন্তু যদি সবাই শহীদ হয়ে যান, তবে পৃথিবীতে ইসলামকে এগিয়ে নিবেন কারা?
সালমান আল ফারিসি (রাঃ) নামের এক সাহাবী, যিনি পারস্য অঞ্চল থেকে শুধুমাত্র নবীর দেখা পেতে মদিনায় এসেছিলেন, তিনি তখন বললেন, তাঁর অঞ্চলে শত্রুকে ঠেকানোর জন্য খন্দক (পরিখা) খননের কৌশল অবলম্বন করা হয়। নবীর (সঃ) কাছে বুদ্ধিটা খুবই ভাল লাগলো। তিনি তাৎক্ষণিক নির্দেশ দিলেন সব সাহাবী যেন দা কোদাল নিয়ে মদিনার প্রবেশ পথে পরিখা খনন শুরু করেন। কয়েকদিনের মধ্যেই গভীর পরিখা খনন করতে হবে, নাহলে কুরাইশ বাহিনীর হাতে মারা পড়তে হবে।
না খেয়ে না ঘুমিয়ে দিনরাত পরিশ্রম করে সাহাবীগণ কয়েকদিনেই পরিখা খনন করে কুরাইশ বাহিনীকে ঠেকিয়ে দিতে পারলেন।
এদিকে মুসলিম নারী ও শিশুরা আশ্রয় নিয়েছিলেন এক দুর্গে। প্রতিটা যোগ্য পুরুষ তখন যুদ্ধক্ষেত্রে শহর পাহারা দিচ্ছেন। যেকোন সময়েই যেকোন কিছু ঘটে যেতে পারে। কুরাইশ বাহিনীকে ঠ্যাকাতে প্রতিটা সেনার গুরুত্ব তখন কোটি টাকারও বেশি।
কেবলমাত্র হাসান ইব্ন সাবেত (রাঃ) নামের এক পুরুষ সাহাবী ছিলেন মহিলাদের সাথে সেই দুর্গে। যুদ্ধের জন্য যোগ্য পুরুষ হওয়ার পরেও তিনি শিশু ও মহিলাদের সাথে দুর্গে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এমনকি, যখন বনু কুরাইযা গোত্রের লোকেরা গভীর রাতে নারী ও শিশুদের উপর হামলা চালায়, তখনও হাসান অস্ত্র তুলে নেননি। এমনকি, নবীর ফুপু সেল্ফ ডিফেন্সে এক আক্রমণকারীকে হত্যা করার পর যখন বলেন ন্যূনতম সাহস দেখিয়ে সেই মৃতের অস্ত্র তুলে নিয়ে আসতে, তখনও হাসান সাহস দেখাতে পারেননি।
জ্বি, হাসান ইব্ন সাবেত (রাঃ) ভীতু ছিলেন। অস্ত্রহাতে যুদ্ধকরার সাহস তাঁর ছিল না। নিজে সহ সবাই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার আশংকার সময়েও তাঁর সাহস হয়নি অস্ত্র হাতে লড়ার।
তারপরেও হাসান ইব্ন সাবেত (রাঃ) একজন গন্যমান্য সাহাবী ছিলেন। তাঁর পায়ের ধুলির যোগ্য হবারও ক্ষমতা/যোগ্যতা আমাদের কারোর নেই।
তা এই হাসান ইব্ন সাবিত কে ছিলেন?
তিনি ছিলেন আমাদের নবীর (সঃ) অফিসিয়াল কবি। যখন কুরাইশরা ইসলামের বিরুদ্ধে, নবী এবং আল্লাহর বিরুদ্ধে কবিতা লিখে প্রোপাগান্ডা চালাতো, তখন নবী (সঃ) ডাক দিতেন, "হাসান কোথায়? যাও এবং আমাদের পক্ষ থেকে ওদের জবাব দাও। জিব্রাইল তোমায় সাহায্য করবেন।"
রাসূলুল্লাহর মসজিদে তিনি জীবিতাবস্থাতেই হাসানের (রাঃ) কবিতা পাঠের জন্য আলাদা প্ল্যাটফর্ম ছিল। উমারের (রাঃ) খিলাফতে একবার হাসান (রাঃ) মসজিদে নববীতে তাঁর কবিতা পাঠ করছিলেন। উমার (রাঃ) নিজের লাঠি দিয়ে গুতো দিয়ে ভর্ৎসনা করে বলেছিলেন, "তুমি রাসূলের (সঃ) মসজিদে কবিতার আসর বসিয়েছো! সাহসতো কম না!"
হাসান (রাঃ) তখন উল্টো খলিফা উমারকে (রাঃ) ভর্ৎসনা করে বলেন, "আমি তখন থেকে এই মসজিদে কবিতা পাঠ করি যখন এই মসজিদে তোমার চেয়েও ঈমানদার একজন ব্যক্তি উপস্থিত থাকতেন। আমাকে শেখাতে এসো না।"
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হচ্ছে, এই হাসান যে ক্ষেত্রে ইসলামের কাজে এসেছেন, আবু বকর, উমার, উসমান, আলী বা অন্য যেকোন সাহাবী সেই ক্ষেত্রে কাজে আসেননি। যুদ্ধক্ষেত্রে আমাদের খালিদ বিন ওয়ালিদ ছিলেন, কিন্তু কবিতার ক্ষেত্রে খালিদ অকার্যকর ছিলেন। যার যার ক্ষেত্রে যে যে নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে কাজ করেছেন। ইসলাম এমনি এমনি সেই আরব মরু অঞ্চল থেকে কয়েক বছরের ব্যবধানে বিশ্বের সুপার পাওয়ারে পরিণত হয়নি। যে যার অবস্থান থেকে নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে কাজ করেছিলেন বলেই এমনটা ঘটেছে।
এইটা জরুরি না যে সবাইকেই তলোয়ার তুলে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। একটি আর্মির নানান ডিপার্টমেন্ট থাকে। অতি আধুনিক ইউএস মিলিটারির কথাই ধরা যাক। সাধারণ সেনা ছাড়াও থাকে ডাক্তার, থাকেন ডেন্টিস্ট। রান্নাবান্না করার জন্য রাঁধুনিও থাকেন। থাকেন নার্স। সিভিল ইঞ্জিনিয়াররাও কাজ করেন সেনাবাহিনীর জন্য। আবার কম্পিউটার সায়েন্টিস্টও কাজ করেন। মোট কথা, একটি যুদ্ধে কেবল অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করলেই সবাই দেশপ্রেমিক আর যে করলো না সে বেঈমান, রাজাকার হয়ে যায় না। অনেকেরই দেশপ্রেম থাকে, কিন্তু একই সাথে অস্ত্র হাতে মানুষ হত্যার সাহস থাকে না। কিন্তু সেজন্য তাঁর দেশপ্রেমকে ছোট করে দেখতে নেই। কেবলমাত্র ন্যারো মাইন্ডেড লোকজনই মনে করে যেহেতু ও যুদ্ধ করেনাই, কাজেই তাঁর ঈমানে/দেশপ্রেমে অভাব ছিল। কেবলমাত্র ন্যারো মাইন্ডেড লোকজনই মনে করে সে যেভাবে দুনিয়া দেখে সেটাই সহীহ, বাকি সবাই ভুল।
কথাগুলো কোন প্রসঙ্গে বললাম নিশ্চই বুঝে গেছেন।
জ্বি, বাংলাদেশে অতি নিচু মেন্টালিটির, সংকীর্ণমনা একশ্রেণীর মানুষকে পাওয়া যায় যারা কথায় কথায় অন্যকে ছোট করার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। নেগেটিভিটি এদের মনে এত বেশি যে কে জীবনে কী করলো তা বাদ দিয়ে তাঁর অতীত জীবনের কোন একটা ফাঁক খোঁজার চেষ্টা করেন যার মাধ্যমে সেই বিশাল মহিরূহকে ছোট করা যায়।
জাফর ইকবাল - হুমায়ূন আহমেদের ক্ষেত্রে এই বিষয়টা সবসময়ে চোখে পড়ে। এক শ্রেণীর লোক এদের ছোট করার জন্য সবসময়েই বলে, "তাঁরা এত দেশপ্রেমিক হলে যুদ্ধ করেন নি কেন?"
জাফর ইকবালের ক্ষেত্রে কথাটি আরও আক্রমণাত্মক। "চকির তলের বা গর্তের মুক্তিযোদ্ধা।"
এখন এই দুই ভাই অ্যামেরিকার বিলাসী জীবন ছেড়ে দেশে গিয়ে বাংলা সাহিত্য, নাটক, সিনেমা, শিক্ষা ইত্যাদিকে অন্তরীক্ষে তুলে দিল, সব অবদান তুচ্ছ হয়ে যায় কেবল একটি সত্যে - "তারা যুদ্ধ করেন নাই কেন?"
তাঁরা যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে দেশের জন্য যা করেছেন, কয়টা মুক্তিযোদ্ধা সেটা করতে পেরেছে? উল্টো এমনও মুক্তিযোদ্ধা আছে যারা ইচ্ছেমতন দেশের সম্পদ লুটেছে। এদের তালিকা করতে গেলে একটি বই ছাপা সম্ভব।
নিজের ড্রয়িংরুমে বসে পপকর্ন খেতে খেতে কম্পিউটারের টাইপরাইটারে উপরের হাসান ইব্ন সাবিত (রাঃ) বা হুমায়ূন-জাফর ইকবালদের বীরত্ব নিয়ে কটাক্ষ করা খুবই সহজ - যেটা কঠিন তা হচ্ছে তাঁরা যে যে ক্ষেত্রে ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়েছেন, তার ধূলিকণা পরিমানও করে দেখানো।
নেগেটিভ চিন্তাধারাকে আমরা সামাজিকভাবে একেবারে শিল্পের মর্যাদা দিয়েছি। কারোর ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র পজিটিভ কিছু চিন্তাই করতে পারিনা।
সাকিব আল হাসান বেচারা একবার নিজের দোকান উদ্বোধনের দিন একদল এতিম শিশুকে খাইয়েছিল - সেটাও অপরাধ হয়ে গেল। সে নাকি লোক দেখানোর জন্য কাজটা করেছে। আরে ব্যাটা, তুইও তাহলে লোকদেখানো জন্য এমন কিছু কাজ কর। অন্তত ঐসব এতিম শিশুর পেটে কিছু খাবার সেই বাহানায় যাক। আমরা সম্প্রদায় হিসেবে প্রচন্ড ছিদ্রান্বেষীতে পরিণত হয়েছি। আফসোস।
আমার সহজ সরল কথা একটাই - কারোর দোষ খোঁজার আগে ওদের ভাল গুনের সমান কিছু একটা করে দেখাও। তারপরে এসো বিষ্ঠা নিক্ষেপে। নাহলে নিজের মস্তিষ্কের ভেতরের উপাদান বের করে এনে পরিবেশ গান্দা করবেন না প্লিজ।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই নভেম্বর, ২০১৮ রাত ১:০৩
১৪টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=বেনারসী রঙে সাজিয়ে দিলাম চায়ের আসর=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫২



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনে কি পড়ে সেই স্মৃতিময় সময়, সেই লাজুক লাজুক দিন,
যেদিন তুমি আমি ভেবেছিলাম এ আমাদের সুদিন,
আহা খয়েরী চা রঙা টিপ কপালে, বউ সাজানো ক্ষণ,
এমন রঙবাহারী আসর,সাজিয়েছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজ্ঞানময় গ্রন্থ!

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪২

একটু আগে জনৈক ব্লগারের একটি পোস্টে কমেন্ট করেছিলাম, কমেন্ট করার পর দেখি বেশ বড় একটি কমেন্ট হয়ে গেছে, তাই ভাবলাম জনস্বার্থে কমেন্ট'টি পোস্ট আকারে শেয়ার করি :-P । তাছাড়া বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

অস্ট্রেলিয়ার গল্প ২০২৪-৪

লিখেছেন শায়মা, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:৪৫


চলে যাবার দিন ঘনিয়ে আসছিলো। ফুরিয়ে আসছিলো ছুটি। ছোট থেকেই দুদিনের জন্য কোথাও গেলেও ফিরে আসার সময় মানে বিদায় বেলা আমার কাছে বড়ই বেদনাদায়ক। সেদিন চ্যাটসউডের স্ট্রিট ফুড... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসের নায়িকাকে একদিন দেখতে গেলাম

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৫

যে মেয়েকে নিয়ে ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসটি লিখেছিলাম, তার নাম ভুলে গেছি। এ গল্প শেষ করার আগে তার নাম মনে পড়বে কিনা জানি না। গল্পের খাতিরে ওর নাম ‘অ’ ধরে নিচ্ছি।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

×