somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হে কবরবাসী! তোমরা কেমন আছো?

২৯ শে জুলাই, ২০১৯ রাত ১১:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার দাদা ছিলেন সরকারি অফিসার। আগেও বহুবার তাঁর কথা বলেছি, ভবিষ্যতেও বহুবার বলবো ইন শা আল্লাহ। সৎ মানুষের গল্প বারবার করতে ইচ্ছে করে।
তাঁর মাথায় গন্ডগোল ছিল। তিনি সৎ ব্যক্তি ছিলেন। সৎ থাকার মানসিকতা নিয়ে কেউ সরকারি চাকরিতে যোগ দেয়? যে চাকরিতে দশহাতে ঘুষ কামানো যায়, তিনি এক পয়সা হারাম টাকা ঘরে ঢুকতে দেননি। না তিনি তাঁর অন্যান্য কলিগদের আরামসে উৎকোচ গ্রহণ করতে দিতেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই তাঁকে দেশের বিভিন্নপ্রান্তে বদলি করা হতো। একদিকে ভালই হয়েছিল, সরকারি খরচে তিনি আরামসে পুরো দেশ ভ্রমন করেছেন। এমন চাকরি আমি পেলে মন্দ হতো না।
বর্তমান যুগ হলে হয়তো তাঁকে গুম করে ফেলা হতো। যেসব কেচ্ছাকাহিনী শুনি, আমি নিশ্চিৎ এই যুগের লোকেরা তাঁকে বাঁচতে দিত না। তিনি আক্ষরিক অর্থেই ছিলেন দুর্নীতিবাজদের গলার কাটা।
দাদাও হয়তো সেটা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই আমার বাবা যখন বিসিএস পরীক্ষা দিতে চাইলেন, তিনি কঠোর ধমক দিয়ে তাঁর কলিজা নাড়িয়ে দিলেন। কোটি কোটি টাকার লোভ সামলে কয়দিনই বা চলা যায়? আপনার সহকর্মী যখন দামী গাড়ি বাগিয়ে অফিসে আসবে, আপনি তার অফিসার হয়েও একটি পুরানো মোটরসাইকেল চালান, আপনি কতদিন নিজের মনকে শক্ত রাখতে পারবেন? মানুষ পিছলা খাবেই। খেতে বাধ্য।
তিনি শুধু বাবার বিসিএস ফর্মই ছিড়ে ক্ষান্ত হলেন না, সেই সাথে কসম খাওয়ালেন, আমাদের বংশে কেউ যেন কখনই সরকারি চাকরি না করে। না আমাদের বংশের কোন মেয়ের বিয়ে কোন সরকারি কর্মকর্তার সাথে হয়। এই নিয়েও একটি কাহিনী আছে।
আমাদের এক আত্মীয়ের (দাদার ফুপাতো বোন) বিয়ে হয়েছিল সরকারি কর্মকর্তার সাথে। বিয়ের সময়ে তাঁর বাবা নিজের জামাইকে কেবল একটাই কথা বলেছিলেন, "বাবা, আমি আমার মেয়েকে কষ্টার্জিত টাকা খাইয়ে বড় করেছি। তুমিও তাঁকে হারাম কিছু খাইও না।"
লোকটা সুন্দরী বৌয়ের পিতাকে দাঁত কেলিয়ে মিথ্যা আশ্বাস দিলেও নিজের স্বভাব ত্যাগ করতে পারেনি।
সেই মহিলা বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যেই মানসিক রোগী হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর স্বামী একটা দুইপয়সার ছিচকা চোর, এই বিষয়টা মানতে পারেননি।
আমরা কাউকে টাকা পয়সার আধিক্যের জন্য বা চাকরিতে উচ্চ পদবীর জন্য সম্মান করতে শিখিনি। কেউ মন্ত্রী, কেউ সচিব, কেউ বিশাল ব্যবসায়ী - এইসবে আমাদের কিচ্ছু যায় আসেনা। সে সৎ না অসৎ সেটাই তাঁর আসল পরিচয়। আমি খেটে খাওয়া একজন রিক্সাওয়ালাকে একজন দুর্নীতিবাজ মন্ত্রীর চাইতে বেশি সম্মান করি। যে চোর, তার পেছনে একশোটা চামচা ঘোরাফেরা করলেই বা কী যায় আসে? এই কথা বহুবার বলেছি, ভবিষ্যতেও বহুবার বলবো ইন শা আল্লাহ। এই ব্যাপারে আমরা কনসিস্ট্যান্ট।
আমার নানাও ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা, এবং ভাগ্যগুনে তিনিও সৎ ছিলেন। লোকে বলে না, উপরওয়ালা জুটি মিলিয়ে দেন? তিনি আমাদের দুই পরিবারকে মিলিয়েছেন।
দাদার বাড়ি, নানার বাড়িতে অভাব ছিল, বাপ চাচা মামারা শৈশবে প্রায়ই তাঁদের বাবাদের দুষতেন, কেন তাঁরা টাকার পাহাড় গড়েন না। একটু বাড়তি পয়সা আসলেতো জীবন অনেক সহজ হতো। জীবনে স্বচ্ছন্দ আসতো। বন্ধু মহলে ইজ্জ্ত থাকতো।
পরে সেই বাপ মামা চাচাদেরই দেখেছি নিজেদের পিতাদের নিয়ে গর্ব করতে। এই এক জিনিসই তাঁদের সন্তানদের জন্য তাঁরা রেখে যেতে পেরেছেন। তাঁদের মৃত্যুর কয়েক যুগ পরেও তাঁদের নাতি নাতনিরা পর্যন্ত গর্ব করে বলে আমাদের দাদা নানারা সৎ ছিলেন।
শৈশবের এই শিক্ষা বয়ষ্কালেও কাজে এসেছে। জীবনসঙ্গিনী নির্বাচনের সময়ে মেয়ের রূপ, বাপের ব্যাংক ব্যালেন্স ইত্যাদির চাইতেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল তাঁর পারিবারিক শিক্ষা, norms and values. আমার শ্বশুর শাশুড়িও সরকারি চাকরি করেছেন আজীবন। তাঁদেরও সম্পদের পাহাড় নেই। যা আছে তা হচ্ছে শিক্ষা। এইটাই আমাদের সবার গর্ব।
আমাদের পরিবারে চাকরির নিরাপত্তার দরকার নাই, চাকরিতে আরাম আয়েশেরও দরকার নেই। উপার্জন হালাল হতে হবে, ব্যস। টাকাপয়সা আসলে আসলো, না আসলে শোকর আলহামদুলিল্লাহ।
আমাদের ছোটবেলা থেকেই মাথায় সরকারি চাকরির ইচ্ছা তাই জাগেওনি।
আমার এক চাচা সরকারি চাকরি করে সারাজীবন অভাবে কাটিয়েছেন। তাঁর ছেলে আজকে নিজের মেধার জোরে অ্যামেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি শেষে ফেডারেল সরকারের ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশনে কাজ করে। তাঁর স্ত্রীও একই কাজ করে দেখিয়েছে। হালাল টাকা কখনই বৃথা যায় না।
একবার দাদির দিক থেকে আত্মীয় এক চাচা কাস্টমসে যোগ দিয়েছিলেন। এই আশায় যে দুনিয়া যাই করুক না কেন, তিনি ঘুষ খাবেন না। প্রথম বেতনের টাকায় তিনি বাড়ি সাজানোর জন্য একটি ফুলদানি কিনলেন। এক আত্মীয় বেড়াতে এসে একটা ডার্টি লুক্স দিয়ে হাসলেন, যার অর্থ "এখুনি চালু হয়ে গেছো? সাবাস! বহুদূর যেতে পারবে।"
চাচা পরেরদিনই সেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে কলেজে মাস্টারি শুরু করে দিলেন। নিজের পরিশ্রমের আয়েও যদি লোকে সন্দেহ করে, তাহলে সেই চাকরিরই দরকার নাই।

এই যে ডিআইজি প্রিজনস, দুদকের কর্মকর্তা বা স্বাস্থ অধিদপ্তরের কেরানিদের দুর্নীতি, সম্পদের পাহাড় ও গ্রেপ্তারের সংবাদগুলি আমাদের কাছে আসছে, এগুলি আজকের কালকের ঘটনা না। সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই আমরা দুর্নীতিবাজ। আমাদের রক্তের কোষে কোষে, রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি মিশে আছে। আমাদের সিস্টেম হচ্ছে আগাগোড়া পঁচে যাওয়া একটি সিস্টেম। আমরা ধরেই নিয়েছি এসব শোধরানো সম্ভব না।

কেন এমনটা হয় জানেন?
আমাদের শিক্ষা জীবন থেকেই এর শুরু। আমরা পড়ালেখা করতে যাই যাতে ভাল চাকরি পেতে পারি। ভাল চাকরি মানে এখনও সরকারি চাকরি। কেন? নিরাপত্তা, প্রভাব, প্রতিপত্তি, সুযোগ সুবিধা ইত্যাদি। আমাদের দেশে বিবেচনাই করা হয়, যে সরকারি চাকরি পায় না, সেই প্রাইভেটে যায়। মানে ওরা লুজার।
তাই প্রাইভেট কোম্পানির চাকরিজীবীরাও পাল্টা আঙ্গুল ছুড়ে বলেন, "তোরা চোর!"

আমরা সবাই জানি যে সরকারি চাকরিতে প্রাইভেটের মতন বেতন নেই। পার্থক্য কেমন সেটা বুঝাই।
আমার এক কাজিন বাংলাদেশে থাকতে মাসে সাড়ে তিন লাখ টাকা পেত। অ্যামেরিকান এম্বেসিতে চাকরি করতো, ডলারে বেতন ছিল তাঁর। মাসে পাঁচ হাজার ডলার পেত। তখন ডলারের মূল্য ছিল সত্তুর টাকা। এখনতো অনেক বেড়েছে। তাহলে তাঁর বেতন আরও অনেক বাড়তো। যাই হোক, সে সেই বেতনের চাকরি ছেড়ে আরও পড়াশোনা করতে আবারও অ্যামেরিকা ফেরত এসে আরও পড়াশোনা করেছে। কিছু মানুষ থাকেই পড়াশোনার জন্য পাগল। বেতনের হিসেবে তাঁদের মাপা অন্যায়। কিন্তু কথা হচ্ছে, সততা বিবেচনায় নিলে মাসে সাড়ে তিনলাখ টাকা আয় কী আমাদের প্রধানমন্ত্রীরও হয়? আমরা জানি আমাদের মন্ত্রী এমপিরা কয়েক বছরেই হাজার কোটি টাকার মালিক হন। কিন্তু বেতন ভাতা হিসেবে নিলে তারা কী এত সম্পদ গড়তে পারার কথা? না।
তাহলে এই ব্যাপারটা সুস্পষ্ট হলোতো যে সরকারি কর্মচারীদের বেতন কম?
যেহেতু আমাদের দেশের মানুষেরা ইমোশনাল, কাজেই আবেগের চোটে এদের আলগা দরদও অনেক বেশি।
"সামান্য ঘুষইতো চেয়েছে, জানোইতো ওদের বেতন কম। আহারে! বাড়তি নাহয় দিলামই টাকা। ছেলে মেয়ের সংসারে কাজে লাগবে।"
আমি সত্যি সত্যিই এমন মনোভাবের ছাগল দেখেছি। আমারই আত্মীয় বন্ধুবান্ধবের মধ্যে আছেন তাঁরা। এই লাইন পড়ে আমার উপর রাগ করবেন। কারন আমি তাঁদের ছাগল বলেছি। কিন্তু তাঁদের কারণেই যে দুর্নীতি ক্যান্সারে রূপ নিয়েছে, এইটা কী তাঁরা বুঝেনা?
এই যে সরকারি বাংলোতে/কোয়ার্টারে থাকার ব্যবস্থা, চাকর বাকর, মালি, ড্রাইভার দারোয়ান ইত্যাদি বা আরও বিভিন্ন সরকারি সুযোগ সুবিধা - এইসব যদি টাকা দিয়ে পরিশোধ করতে হতো, তাহলে এর মনিটারি ভ্যালু কত হতো জানেন? আমরা যদি এইসব সুযোগ সুবিধা তুলে নিয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের বেতনের মধ্যে ক্যাশ ভ্যালু ঢুকিয়ে দেই, তাহলে একেকজন সরকারি কর্মকর্তার বেতন লাখে লাখ টাকা ছাড়িয়ে যাবে। বুদ্ধি বিবেচনা থাকলে সহজেই বুঝতেন, একজন সরকারি কর্মকর্তার পেছনে সরকারের কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ থাকে।
প্রাইভেট এবং সরকারি ইউনিভার্সিটির উদাহরণ নিলে সহজে বুঝতে পারবেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টারে কত খরচ করতে হয় প্রতিটা ছাত্রকে? একশো? দুইশো? ধরলাম হাজার। প্রাইভেটে সেই খরচ লাখের কাছাকাছি হয় বা ছাড়িয়েও যায়। কেন? কারন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ সরকার বহন করে, প্রাইভেটে পুরোটাই প্রাইভেট।
যেমন অ্যামেরিকায় বেশিরভাগ ইউনিভার্সিটিই প্রাইভেট। এই কারনে আমাদের এখানে খরচও তেমন। সাধারণ এক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপ ছাড়া যেকোন ছাত্রের আন্ডারগ্র্যাড সেমিস্টার ফী চার-পাঁচ হাজার ডলার ছাড়িয়ে যায়। স্টুডেন্ট লোন নিয়ে পড়াশোনা করলে একজন ছাত্র পাশ করে বেরুবার পর পঞ্চাশ হাজার ডলার ঋণের বোঝা নিয়ে রাস্তায় নামে। আইভি লীগের ইউনিভার্সিটিতে বছরে পঞ্চাশ ষাট হাজার ডলার বিল আসে। এখন এটাকে গুন দিন চার দিয়ে। খরচের পরিমান আরামসে এক দুই লাখ ডলার ছাড়িয়ে যায়। এই কারণেই বিদেশে সন্তান পালন করা প্রতিটা বাবা মাকে নিজের বাচ্চাদের এডুকেশনের জন্য আলাদা করে টাকা সরিয়ে রাখতে হয়। আমরা ওদের বিয়ের খরচের মতন ফালতু বিষয় নিয়ে চিন্তা করি পরে। ওটা ওরা ওদের নিজেদের আয়ে করবে। ওদের পড়াশোনার দায়িত্ব আমাদের। সেটা ঠিকমতন করাতে পারলেই হলো। আমরা কেউ হাউকাউ করিনা কেন কলেজ টুইশন এত বেশি। কারন একটি বিশ্ববিদ্যালয় চালাতে কী পরিমান খরচ হয় সেই সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা আমাদের সবারই আছে। যতদূর জানি, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গতবছরের খরচ ছিল পাঁচ বিলিয়ন ডলার। সেই টাকাতো তুলতে হবে বাকি? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচের হিসেব কেউ রাখেন? টাকাটা আসে কোত্থেকে আইডিয়া আছে?

প্রাইভেট চাকরিতেও তাই প্রাইভেট ফার্মগুলো এই কাজটা করে। কর্মচারীদের উচ্চ বেতন দেয়, কিন্তু সুযোগ সুবিধা সরকারি চাকরির তুলনায় বলতে গেলে কিছুই থাকেনা। খাটুনির কথাতো আলাদাই থাক।
আমাদের সমস্যা এখানেই যে আমরা একই সাথে সব পেতে আগ্রহী। সরকারি চাকরিও করবো, আবার সম্পদের পাহাড়ও গড়বো। কোটিপতিও হবো, আবার পরিশ্রমও করবো না। যে হারামজাদার কাজ হচ্ছে অপরাধ দমন, সে নিজেই কোটি কোটি টাকা ঘুষ নিয়ে বসে থাকে। ক্রাইমকে ঘৃণা না করলে তুই কোন লজিকে পুলিশের চাকরিতে যোগ দিস?
আরে গাধা, তোর যদি কোটিপতি হবার এতই সাধ জাগে, তাহলে চাকরি বাদ দিয়ে ব্যবসা কর। শূন্য থেকে শুরু করে সাধারণ গরু ছাগলের খামার দিয়ে কোটিপতি হবার ঘটনা নিজের চোখের সামনে দেখেছি। নিঃস্ব অসহায় নারী নিজের বাড়ির পুকুরে কাঁকড়া চাষ করে লাখপতি হয়েছেন, এমন হাজারো ঘটনা আমাদের নিজেদের দেশেই ঘটে।
তুই মাছের খামার দে। তুই মুদির দোকান দে। তোর বিদ্যা তোর ব্যবসায় ব্যবহার কর। তুই পরিশ্রম কর। দেখবি তোর সাধারণ দোকান কিভাবে আর আট দশটা দোকান থেকে কত দ্রুত আলাদা হয়ে উঠে।
স্যাম ওয়াল্টন নামের এক লোক আরকানসাঁ রাজ্যে এক দোকান খুলেছিলেন। তাঁর মাথায় এই আইডিয়া ছিল যে একই ছাদের নিচে ক্রেতারা সবকিছু কিনতে পারবেন। তাঁদের দোকান থেকে দোকানে ছুটে বেড়াতে হবেনা। আবার সেইসব জিনিসের দ্রব্যমূল্যও কম হবে। ক্রেতার পয়সা যেন বাঁচে, সেইজন্য যা কিছু করার সবই করবেন দোকানের কর্মকর্তারা। দোকানের নাম ছিল ওয়ালমার্ট। কয়েক দশকের ব্যবধানে ওয়ালমার্ট বিশ্বের সবচেয়ে বড় রিটেইলার হয়ে গেল। লাখে লাখে কর্মচারী তাঁদের হয়ে কাজ করে। দিনে তাঁদের বিক্রির পরিমান কোটি কোটি ডলার। ওয়াল্টন পরিবারের উত্তরসূরিরা বিশ্বের সেরা দশ বিশ ধনীর তালিকায় সবসময়েই থাকেন।
বা উদাহরণ হিসেবে ম্যাকডোনাল্ডসই নিন। অর্থনৈতিক মন্দার দিনে দুই ম্যাকডোনাল্ডস ভাই চাকরি করতে গিয়ে দেখেন শহরের একজন খাদ্য বিক্রেতার আয় রুজি ভালই হচ্ছে। তাঁরা উপলব্ধি করলেন, মানুষ যতই অভাবে থাকুক না কেন, তাঁদের খাবার খেতেই হবে। তাই তাঁরা বারবিকিউর দোকান খুললেন। দোকান আর সব সাধারণ দোকানের মতই চললো। কিন্তু তাঁরা তাঁদের গবেষণা ছাড়লেন না। তাঁরা দেখলেন তাঁদের দোকানে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া পণ্য হচ্ছে হ্যামবার্গার, ফ্রেঞ্চ ফ্রাইজ এবং কোক। তাঁরা এও চিন্তা করলেন, রেস্টুরেন্টে ওয়েটারের মাধ্যমে খাবার পরিবেশন করতে গিয়ে তাঁদের অনেক সময় ব্যয় হয়। এবং মাঝে মাঝে এমনও ঘটে যে যা অর্ডার করা হয়েছে, তা না দিয়ে অন্য কোন মেনু ডেলিভার করা হয়েছে। তার উপর ধরুন প্লেট থালাবাসন ভাঙার খরচ। প্রতিদিন প্লেট, গ্লাস ইত্যাদি ভাঙছে।
তাঁরা তখন নিজেদের চালু রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে পুরো নতুন সিস্টেমে নতুন রেস্টুরেন্ট শুরু করলেন। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ডিটেইলে তাঁরা কিচেন ডিজাইন করলেন যাতে একটি বার্গার তৈরী হয়ে কাস্টমারের হাতে ডেলিভার্ড হতে তিরিশ সেকেন্ডের বেশি সময় না লাগে। কাগজের গ্লাসে কোক, কাগজের ঠোঙায় বার্গার, এমনকি কাস্টমারের বসার জন্যও ফ্যান্সি চেয়ার টেবিল নেই। যেখানে পারো, বসে খাও। খাওয়া শেষে ট্র্যাশ ক্যানে ট্র্যাশ করে দাও।
বাড়তি খরচ কমে যাওয়ায় বার্গারের দামও কমে গেল, পনেরো পয়সা মাত্র (সেই পঞ্চাশের দশকের কথা বলছি যদিও, এখনও ম্যাকডোনাল্ডসের খাবার অন্যান্য বার্গার শপের তুলনায় বেশ সস্তা)। ম্যাকডোনাল্ডস টার্গেট করলো দেশের মধ্যবিত্ত নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর কাস্টমারকে। এদের সংখ্যাই পৃথিবীতে বেশি। কোনদিনই কাস্টমারের অভাব হবেনা।
লাভ কী হলো জানেন? ম্যাকডোনাল্ডস বহু দশক ধরেই বিশ্বের একনাম্বার ফাস্টফুড রেস্টুরেন্ট। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার রেভেনিউ। দ্বিতীয় স্থানে থাকা কোন রেস্টুরেন্টই তাঁদের ধারে কাছে নেই।
আমাদের দেশেরই ফার্নিচার ব্র্যান্ড অটবি - তার মালিক (নিতুন কুন্ডু) একসময়ে ঢাকা মেডিক্যালের বারান্দায় ঘুমাতেন। বাস ভাড়া বাঁচাতে শাহবাগ পর্যন্ত হেঁটে যেতেন। কার কাছ থেকে শুনেছি এই ঘটনা? তাঁর পুত্রের কাছ থেকে স্বয়ং। নিজের পিতার স্ট্রাগলের গল্প বলার সময়ে ভদ্রলোকের চোখ গর্বে চকচক করছিল।

টাকা আয় করতে হলে সবার আগে নিজের কাজকে ভালবাসুন। তারপরে সেখানে নিজের প্রাপ্ত জ্ঞানকে ব্যবহার করুন। তারপরে অনবরত চিন্তা করুন কিভাবে সেই প্রতিষ্ঠানের উন্নতি করা যায়। ইন্টারনেটের যুগে এই কাজটি অতি সহজ হয়ে গেছে। আপনার রেস্টুরেন্টের ব্যবসা হলে ম্যাকডোনাল্ডসের যে কেস স্টাডি বললাম, সেটা নিয়ে গবেষণা করুন। সাধারণ মুদির দোকান হলে ওয়ালমার্টের কেস স্টাডি নিয়ে চিন্তা করুন। আরও আরও অনেক কেস স্টাডি খুঁজে পাবেন। ভাবুন কিভাবে এইসব গবেষণা আপনার নিজের দোকানের প্রেক্ষাপটে ফেলা যায়। আজকে ওয়ালমার্টের স্ট্র্যাটেজি অ্যামেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচি, তাঁর কস্ট ম্যানেজমেন্ট অন্যান্য যেকোন ব্যবসার জন্য মাইলফলক, কালকে হয়তো আপনার স্ট্র্যাটেজি নিয়েও শিশুদের শিক্ষা দেয়া হবে।

কোটিপতি হতে চাইলে পরিশ্রম করুন। চুরিচামারি করে টাকা আয় করতে কেন সরকারি চাকরিতে যোগ দিবেন? কেন মানুষের অভিশাপ কামাবার ধান্ধাবাজি করবেন?
সূচনা করেছিলাম আমার দাদাকে দিয়ে, উপসংহারও টানি তাঁকে দিয়েই।
দাদা কেন হারাম টাকা এড়িয়ে চলতেন জানেন? কয়েকটি কারন ছিল তাঁর। ছোটবেলায় আমার বাবা একবার তাঁকে সরাসরিই জিজ্ঞেস করেছিলেন।
"বাবা, আপনার জুনিয়র কর্মকর্তাদের দেখি গাড়ি হাঁকিয়ে অফিসে যেতে। নিজেদের আলিশান বাড়িতে থাকতে। তাদের বাড়িতে গেলে মিষ্টি, সন্দেশ পোলাও কোর্মাসহ অনেক দামি খাবার পরিবেশন করতে। আমাদের এইসব নেই কেন?"
আমাদের তখন হয় সরকারি কোয়ার্টারে, না হয় ভাড়া করা ছোট্ট বাড়িতে থাকতে হয়। দুই বেডরুমের ফ্ল্যাটে সাত আটজনের সংসার করতে হয়। বাড়িতে মেহমান আসলে চায়ের সাথে চিটাগংয়ের বিখ্যাত/কুখ্যাত বেলা বিস্কুট সার্ভ করা হয়। অতিথি যদি ভিআইপি গোছের কেউ হয়, তাহলে সুজির হালুয়া দেয়া হয়।
দাদা তখন বললেন, "তুমি শুধু তাঁদের চাকচিক্য দেখেছো, ওদের সংসারের অশান্তি দেখোনি।"
দেখা যেত সেইসব কর্মকর্তাদেরই বৌয়ের সাথে সম্পর্ক ভাল নেই। সন্তান মাদকাসক্ত। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। মাদকের ওভারডোজে অকাল মৃত। ইত্যাদি। হারাম টাকা কখনই হজম হয়না।
দাদা আরেকটা কথা বলতেন, "কাদের জন্য আমি ঘুষ খাবো? তোমাদের জন্য? আমি মারা গেলে তোমরাতো আমাকে কবরে শুইয়ে দিয়ে আসবে। অনন্তকালের জন্য সেই অন্ধকার কবরে আমি শুয়ে থাকবো। তাহলে এই গুনাহ করে আমার কী ফায়দা?"
হজরত আলী একবার তাঁর সহচরদের শিক্ষা দিতে এক গোরস্থানে গিয়ে তাঁদের শুনিয়ে কবরবাসীর উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, "তোমাদের ছেড়ে যাওয়া সম্পদ নিয়ে ওয়ারিশগণ লড়ছে। তোমাদের বিধবা স্ত্রীরা এখন অন্য লোকের স্ত্রী। তোমাদের সন্তানরা নিজেদের জীবন নিয়েই ব্যস্ত। হে কবরবাসী! তোমরা কেমন আছো?"
বাক্যটা কতটা গভীর বুঝতে পারছেন? গভীরতা বুঝতে চেষ্টা করুন। নিজের সন্তানদেরও বোঝান।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জুলাই, ২০১৯ রাত ১১:৫২
৪টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হবে আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও আমিরের ইতায়াতে ওলামা তরিকায়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:১০



সূরাঃ ১ ফাতিহা, ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
৪। আমরা আপনার ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই।

সূরাঃ ৪ নিসার ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×