সাম্প্রতিক রাফসান ঘটনা নিয়ে আমার নিজের কিছু কথা পয়েন্টাকারে বলি।
১. ওর বাপকে ও "দুই কোটি" টাকার অডি গিফ্ট করার পরে ফেসবুকে হুলুস্থূল পড়ে গিয়েছিল।
একটা ছেলে ওর মা বাবাকে গাড়ি উপহার দিতেই পারে, দেয়াটাই উচিত, কারন আমরা যদি আমাদের শরীরের চামড়া দিয়েও নিজেদের বাবা মায়ের পায়ের জুতা বানিয়ে দেই, তারপরেও ওদের প্রতি কৃতজ্ঞতার ধুল পরিমানও শোধ হবে না। সোশ্যাল মিডিয়ায় ও যে টাকা আয় করছে, তা দিয়ে বাবাকে সামান্য খুশি করলে সমস্যা কোথায়?
ঘটনাটা ভিডিও করাতেও সমস্যা দেখিনা। প্রথমত, এটি একটি বিশেষ ঘটনা, যা ওরা স্মরণীয় করে রাখতে চায়, মানুষের সাথে শেয়ার করতে চায়, ভিউ থেকে কিছু টাকা উঠে আসলে সমস্যা নেই, এবং যদি এই ভিডিও দেখে কেউ নিজের মা বাপকে একটা হাতঘড়ি, একটা শাড়িও উপহার দেয়, তাহলেওতো ভাল। এ নিয়ে নেগেটিভ হৈচৈয়ের কিছু নেই।
২. একটা ইউটিউবার কেন এত টাকা কামাচ্ছে আর এমবিবিএস ডাক্তার কামাচ্ছে না, সেটা নিয়েও কিছু লোকজন কান্নাকাটি করলো। খুবই বিরক্তিকর। প্রথমত, পড়ালেখা টাকা কমানোর জাদুমন্ত্র না। যেমন আমি পেশায় একজন একাউন্ট্যান্ট এবং ব্যবসায় রিয়েলিটর। অথচ জীবনের অধিকাংশ সময় পড়াশোনা করেছি ফিজিক্স, কেমেস্ট্রি, বায়োলজি, ইতিহাস, উচ্চতর গণিত, ক্যালকুলাস ইত্যাদি সব কঠিন কঠিন বিষয় নিয়ে। আজও প্রায়ই রাতে দুঃস্বপ্ন দেখি ফিজিক্স পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে হলে গিয়ে জানতে পেরেছি আজ কেমেস্ট্রি পরীক্ষা। আমার দুরবস্থা থেকে আমার সহপাঠীরা দাঁত ক্যালাচ্ছে। এদিকে বুকের ভিতরে হৃদপিণ্ডের তোলপাড় চলছে। এবং সেই তোলপাড়েই আমার ঘুম ভেঙে গেছে।
এখন কি আফসোস করবো, সমস্ত জীবন ঐসব পড়লাম, অথচ কাজে লাগেনি? না। জীবনের কোন জ্ঞানই ফালতু জ্ঞান না, বরং জ্ঞানই আমাদের একমাত্র সম্পদ যার অপচয় হবার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই। এখন আফসোস হয়, তখন যদি আরেকটু মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করতাম, তাহলে আরও লাভ হতো। যে শুধুই চাকরির জন্য পড়াশোনা করে, সে আসলে ব্যবসায়ী। বিনিয়োগ করছে, এবং রিটার্ন চাইছে। বিদ্যার্জন হওয়া উচিত ইবাদতের মতন, প্রতিটা নতুন বিষয় শিখলে যেন মন শিহরিত হয়। সেটা যে শুধুই পাঠ্যবইয়ে হতে হবে তাই না, কারিগরি জ্ঞানও হতে পারে। তারপরে সঠিক জায়গায় সেই বিদ্যা/জ্ঞান প্রয়োগ করলে রিটার্ন আসবেই।
এই যে ইউটিউবাররা কোটি কোটি টাকা আয় করছে, সেটাও কিন্তু একরকম বিদ্যার প্রয়োগ। ওরা জানে কিভাবে পাবলিককে এনগেজড রাখতে হয়, কিভাবে ক্যামেরার সামনে কথা বলতে হয়, কিভাবে ভিডিও এডিট করতে হয়, কিভাবে ক্লিক বেইট বানাতে হয়। নিতান্ত মূর্খ যে হিরো আলম, সেও নিজেকে পঁচিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা কামাচ্ছে। গালি খাচ্ছে? ও মাইন্ড করেনা, কারন গালিটা ও নিজের গাড়ির ভিতরে বসে শুনছে। যারা গালি দিচ্ছে, ওদেরই ভিউয়ের টাকায় গাড়িটা কিনেছে। loserটা তাহলে কে হলো?
একজন পিএইচডি শেষ করে মাইক্রোসফটে চাকরিতে ঢুকছে, যেখানে ওদের আল্টিমেট বস বিল গেইটস ছিল ইউনিভার্সিটি ড্রপআউট। তো এখানে যদি ঐ বেকুবটা কান্নাকাটি করে তাহলে কোন লাভ আছে? বিল গেইটস ইউনিভার্সিটি ড্রপ করলেও ওর প্রোডাক্ট সম্পর্কে ও ভাল জানে। এটাই ওকে সবার উপরে টেনে এনেছে। সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সাররা, অভিনয় জগতের তারকারা, এথলেটরা হয়তো পড়ালেখায় ভাল না, কিন্তু নিজেদের ফিল্ডে ওরা কিছু কাজ (পজিটিভ/নেগেটিভ) করছে বলেই ওরা আপনার আমার থেকে এগিয়ে এসেছে। যে ডাক্তার বাসে চেপে কাজে যাচ্ছে, ওকে বলেন অন্যকে হিংসা না করে নিজের ফিল্ডেই আরও বেশি পরিশ্রম করতে, তাহলে ওও সফল হবে। দেশের বেশিরভাগ ডাক্তারই নিজের গাড়িতে চেপে কাজে যায়। অন্যের টাকার দিকে তাকিয়ে কান্নাকাটি না করলে ওও পারবে।
৩. রাফসানের নিজের স্বীকারোক্তিতেই ওর আব্বা একজন ঋণখেলাপি। দুই কোটি টাকার (আসলে গাড়ির দাম অনেক কম) গাড়ি না কিনে সাড়ে তিনকোটি টাকার ঋণ শোধ করাটা বেশি জরুরি ছিল। সে বা ওর পরিবার সেটা করেনি। কৈফিয়ত দিয়েছে আদালত জানায়নি কত ফেরত দিতে হবে, তাই ওরা দেয়নি। যখন জানাবে, তখন ফেরত দিবে। খুবই হাস্যকর যুক্তি।
প্রথমত, দুনিয়ার সব আদালতই চায় বাদী/বিবাদী আদালতের বাইরেই নিজেদের ঝামেলা মিটিয়ে ফেলুক। ব্যাংক থেকে সাড়ে তিনকোটি টাকা ঋণ নিয়েছো, সামর্থ্য হবার পরে লোন পরিশোধের ইচ্ছা থাকলে ব্যাংকের সাথে বসে সহজেই সমাধান সম্ভব কত ফেরত দিলে ঋণের ঝামেলা মিটে যাবে। এ নিয়ে আদালতে টানাটানিটাই ছোটলোকি মেন্টালিটি। মানেই হচ্ছে পুরো টাকা পরিশোধের বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নাই। থাকলে আদালতের নির্দেশের জন্য কেউ অপেক্ষায় বসে থাকে না।
"বন্ধকের জমি দশ টাকা, ঋণের পরিমান এক টাকা, এখন ব্যাংক ঐ জমি কেড়ে নিচ্ছে বলে মামলা করছি" - এইগুলি ফালতু আলাপ। ব্যাংককে এখনই গিয়ে যদি বলে "ভাই আমি টাকা দিয়ে দিচ্ছি, মামলা তুলে নাও এবং জমি ছেড়ে দাও" তাহলে দেখেন ব্যাংক কি করে। টাকা পাওয়ার পরেও ওরা যদি মামলা তুলে না নেয়, জমি ফেরত না দেয়, তখন আদালতে দেখা করো।
"আদালত এখনও জানায়নি কত ফেরত দিতে হবে" - এইটাও ফালতু খোঁড়া যুক্তি। ঋণ নিয়েছো তুমি, শর্ত মর্ত সব পরিষ্কার অক্ষরে চুক্তিতে লেখা ছিল, সব হিসাবপত্র কাগজেই লেখা আছে, এখন এখানে আবার আদালতের নির্দেশের অপেক্ষা কেন?
"ঋণ নিয়েছে বাবা, ও কেন শোধ করবে?" - রাফসান এখন ফালতু কথা বলেনি, বলেছে ছাগল কিছু মুরিদ। এইসব ফাত্রামি কথাবার্তা যেসব মুরিদেরা বলে ওদের গালে উলটাহাতে একটু জোরে আদর করে দিতে ইচ্ছা করে। বাপ মা আরেকজনের টাকা ঋণ নিয়ে মেরে দিবে, সেই টাকায় ভাল এলাকায় দামি ফ্ল্যাটে থাকবে, দামি গাড়িতে ঘুরবে, দেশবিদেশে যাবে, দামি ইন্সট্রুমেন্টে শ্যুটিং করে ভিডিও বানাবে, সোশ্যাল মিডিয়া সেলিব্রেটি হবে, কোটি কোটি টাকা কামাবে, আর যখন সেই টাকা ফেরতের প্রসঙ্গ উঠবে - তখন আল্লাদি কথাবার্তা? এগুলি কারা? আসছে কোরবানির ঈদে এদেরকে ঘরে লুকিয়ে রাখবেন। নয়তো কেউ গরু ছাগল ভেবে গাবতলীর হাঁটে তুলে দিবে।
যাই হোক, সোশ্যাল মিডিয়া হোক বা যেকোন সেলিব্রেটি, সবারই সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকে। ওদেরকে কোটি কোটি মানুষ ফলো করে। ওদের প্রতিটা পদক্ষেপ মানুষের জীবনে পজিটিভ/নেগেটিভ ভূমিকা রাখে। টেন্ডুলকার জীবনেও বিড়ি সিগারেট মদের এম্বাসেডর হয়নি। শুধুমাত্র এই কারনে যে ওর বাবা ওকে শুরুতেই শিখিয়েছিলেন, কোটি কোটি মানুষ ওকে দেবতার মত ভক্তি করে। ওকে আদর্শ মানে। ওর জীবন হতে হবে সুশৃঙ্খল। শচীন আজ্ঞাবহ সন্তান ছিলেন, এই কারণেই উপরওয়ালা দুইহাত ভরে তাঁকে শুধু দিয়েছেন। আজও ক্রিকেটার শচীন টেন্ডুলকারকে দুনিয়াব্যাপী ক্রিকেটভক্ত একজন ভালমানুষ হিসেবে মনে রেখেছে।
আর আমাদের সুপার স্টার শাকিব খান নিয়মিত শিরোনাম হয় একের পর এক গোপন বিয়ে, গোপনে সন্তান জন্মদান এবং অতিরিক্ত ছ্যাচড়া দুই বৌয়ের কারনে।
খুব শীঘ্রই রাফসান আরেকটা ভিডিও বানাবে, ব্যাংক ঋণ শোধ করছে। সেটাতেও কোটি কোটি ভিউ আসবে। কিছু টাকা এতেও আয় হবে। তবে সেটা একটা ভাল কন্টেন্ট হবে। এবং তখনও দেখবেন কিছু বেয়াক্কেল কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছে "গরিব চাষির বাসার ছাদ খুলে নিয়ে যাচ্ছে ব্যাংক, আর ইউটিউবাররা ঋণ শোধ করে ফেলছে! লাইফ ইজ নট ফেয়ার এন্ড লাভলী!"