somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রাজহাঁসের মতন ডানা ঝাপটিয়ে সব অপ্রিয়তা ঝেড়ে ফেলা।

০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ভাল লাগতো বৃষ্টি দেখতে।
সিলেটের বিখ্যাত বৃষ্টি। সূর্যের চোখ রাঙ্গানি উপেক্ষা করে বর্ষার ঘোরকৃষ্ণ মেঘ আকাশ অন্ধকার করে টানা কয়েকদিন বর্ষণ চালিয়ে যেত। পাহাড়ি এলাকা হওয়ার পরেও শহরের কিছু নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যেত। আমাদের ভাগ্য ভাল ছিল, আমাদের বাড়িতে বা সামনের রাস্তায় কখনও পানি উঠতো না। পাশেই একটা ছরা (ছোট খালকে আমরা সিলেটিরা ছরা বলি) থাকায় সেটাই সব পানি বয়ে নিয়ে যেত। বর্ষাকালে ঐ ছোট্ট ছরা যে পরিমাণ পানি নিয়ে যেত, আমেরিকার বহু নদীতেও সেটা দেখিনি।
ছরার পাশে মাঠ ছিল। শীতে ক্রিকেট, বর্ষায় ফুটবল। ফুটবল খেলার প্রথম শর্তই ছিল কাদায় মাখামাখি হতে হবে। তারপরে দল বেঁধে ছরার পানিতে গোসল।
এদিকে আমি স্পষ্টই দেখছি পুরো পাড়ার ড্রেনের পানি ছরায় এসে পড়ছে। তাছাড়া এই ছরার ধারেই লোকজন নিয়মিত টয়লেট করে। ঐ পানিতে আমি গোসল করবো?
শুধুমাত্র এই কারণেই আমি পাড়ার মাঠে অন্যান্য ছেলেদের সাথে ফুটবল খেলতে যেতাম না। বাড়ির সামনের মাঠে নিজেরা নিজেরা কয়েকজন বন্ধুবান্ধব মিলে খেলতাম।
তাছাড়া একবার আমাদের ভাড়াটে সেই মাঠে খেলে ছরায় গোসলের সময়ে একটা মরা নবজাতককে ভাসতে দেখেছিল। রটনা রটলো হয়তো জ্বিন সেই বাচ্চাকে মেরে ফেলেছে। এখন মনে হয় ঢাকা শহরের ডাস্টবিনে যে কারনে মাঝে মাঝে কিছু নবজাতক পাওয়া যায়, সেই একই দুর্ভাগা পরিণতি ওরও হয়েছিল। আহারে! ছোট্ট, অবুঝ নিরপরাধ শিশু। কেয়ামতের দিন ওকে আল্লাহ প্রশ্ন করবেন, "কোন অপরাধে তোমাকে হত্যা করা হয়েছিল?" - শিশুটি কিছুই বলতে পারবে না। ফ্যালফ্যাল করে নিজের খুনির দিকে তাকিয়ে উত্তর খুঁজবে।

আমাদের বাড়ির সামনের মাঠটাই ডোবায় পরিণত হতো। গোটা বর্ষা জুড়েই সেখানে পানি জমে থাকতো আর সেই পানিতে অসংখ্য সাপ খেলা করতো। নানান জাতের সাপ। ওদের কয়টা বিষধর ছিল জানিনা, তবে সন্ধ্যায় বিনে পয়সায় সাপের খেলা দেখা হতো। শয়ে শয়ে সাপ, ডোবার পানিতে কিলবিল করতো। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। ওরা ডোবা থেকে উঠে আসতো না। ওসব সাপ নিয়ে নানান কুসংস্কার কানে আসতো। পাড়ার হিন্দুরা বলতো ঐ ডোবার নিচে গুপ্তধন আছে। বহুকাল আগে আমাদের বাড়ি এবং সামনের মাঠ সহ বিস্তীর্ণ এলাকা বিরাট পুকুর/দীঘি ছিল। সেখানেই কেউ গুপ্তধন লুকিয়ে রেখেছিল। ভরাট হয়ে যাওয়ার পর আজও সাপের দল সেই গুপ্তধনের পাহারায় আছে।
মুসলমানরা বলতো ওসব সাপ হচ্ছে জ্বিন। তাইতো মাগরেবের আগে ওদের দেখা পাওয়া যায় না। সন্ধ্যার দিকে ওরা পানিতে কিলবিল করে।
জ্বিন বা গুপ্তধনের পাহাড়াদারদের অস্তিত্ব অবশ্য এখন আর নেই। সেই জলাভূমি এক "লন্ডনী" কিনে ফেলার পর সেটা ভরাট করে ফেলে। আমাদের চোখের সামনেই আমাদের খেলার মাঠ সবজি ক্ষেতে পাল্টে যায়। আমরাও অবশ্য ততদিনে বড় হয়ে গেছি। কলেজে পড়তে শুরু করেছি। খেলার সময় তখন অনেক কমে এসেছে। এখন হয়তো সেই মাঠেই বহুতল বাড়ি উঠে গেছে।

ভাল লাগতো বৃষ্টিতে ভিজতে।
আমার বাবার ছিল ভীষণ ঠান্ডার বাতিক। এতটুকু ভিজলেই আব্বুর ঠান্ডা লেগে যেত। শীতে গরম পানি ছাড়া গোসলতো বহুদূর, হাত মুখও ধুতে পারতো না। আমরা তখনই সিদ্ধান্ত নেই এমন হওয়া যাবেনা।
আমি ছোটবেলা থেকেই ছিলাম "ওয়াটারপ্রুফ।" ঘন্টার পর ঘন্টা পাহাড়ি বৃষ্টিতে ভিজেও কোনদিন এতটুকু সর্দি হয়নি। বৃষ্টিতে সাইকেল চালাতে মজা লাগতো। মজা লাগতো রিক্সায় বসে হুড নামিয়ে দিতে। বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিয়ে যেত জামা কাপড় আর মন। মাঝে মাঝে কিছু রিক্সাওয়ালা অফেন্ডেড হত। ওর কাস্টমার ভিজে ভিজে যাচ্ছে, এইটা ওর বিজনেসের জন্য ভাল রেপুটেশন না। লোকে ভাবতে পারে ওর বুঝি "পানি-কাপড়" নেই। জোর করতো "পানি কাপড়" জড়াতে। ওকে আশ্বস্ত করতে হতো যে লাগবে না, আমি ঠিক আছি, এবং আমার ভাল লাগছে।
এমনই এক বৃষ্টির দিনে রিক্সায় ভিজতে ভিজতে যাচ্ছি। আমার বৌ, তখনকার সহপাঠী, রাস্তার অন্য দিক দিয়ে যাচ্ছিল। সে আমাকে ঐ অবস্থায় দেখে। হয়তো সেদিনই সে সিদ্ধান্ত নেয় এই ছেলেকেই সে একদিন বিয়ে করবে। কে জানে!

ভাল লাগতো বৃষ্টিতে হাঁটতে। রাস্তায় পানি জমছে কিন্তু ফুটপাথে উঠে আসছে না, এমন রাস্তায় ঝুম বৃষ্টির দিনে হাঁটার মজাই আলাদা। বেঁচে থাকার আনন্দ টের পাওয়া যায়।
কিংবা ছাদে। ঝুপ করে বৃষ্টি নেমেছে, ছাদে পানি জমে গেছে। বৃষ্টি থামার কোন লক্ষণ নেই। এই অবস্থায় ভেজার মজাই আলাদা।
কিংবা মাঠে, কাদায় মাখামাখি হয়ে ফুটবল খেলতে। ছরায় গু মাখা পানিতে গোসল না করলেই হলো।
হাঁসের দল নেমে আসতো আমাদের সাথে। বৃষ্টির দিনে ওদেরও আনন্দ। মনের আনন্দে ঝিনুক, শামুখ খেয়ে বেড়াতো। আর রাজহাঁসগুলোরতো চালচলনই ছিল রাজকীয়।
এককালে কাগজের নৌকা বানিয়ে পানিতে ভাসাতাম। বৃষ্টির ফোটায় বা পানিতে কাগজ ভিজে ন্যাৎন্যাতা হয়ে যেত। টিনের স্পিড বোট পাওয়া যেত। যার ছিল সেই ছিল বন্ধু মহলের সবচেয়ে ধনী। বাকিরা সবাই ওকে ঈর্ষা করতাম। আমি কাগজের স্পিড বোট বানাতে পারতাম। আমার আরেক বন্ধু কাগজের পালতোলা নৌকা। শৈশবের ক্রিয়েটিভিটি ছিল ভিন্ন মাত্রার।
পাড়ার বহু ছেলেকে দেখতাম গামছা বা শাড়ি দিয়ে টিলা থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল থেকে মাছ ঝরছে। সারা বছর সেইসব ড্রেন শুষ্ক থাকে। বর্ষার টিলার উপরের পানি নিচের দিকে নিয়ে আসে। কিন্তু সেই পানিতে মাছ কোত্থেকে আসতো আজও মাথায় ঢুকে না। কিন্তু নিজের চোখেই দেখেছি ওদের মাছ ধরতে। ছোট ছোট পুঁটি মাছের মতন মাছ।
বৃষ্টি আসা মানে অবধারিতভাবেই কারেন্ট চলে যাওয়া। চার্জ লাইটের আলোয় পড়তে বসা। দেয়ালে আলো ছায়ার রহস্যময় খেলা আর বাইরে বৃষ্টির কনসার্ট। বর্ষায় বাংলাদেশ কী অপার্থিব সুন্দর!

টেক্সাস খরার জন্য কুখ্যাত। টেক্সাসের অবশ্য সবকিছুই মাত্রাতিরিক্ত হয়ে থাকে। যখন গরম পড়বে, তখন অনেক গরম। ঘাস পুড়িয়ে দিবে, মাটি ফাটিয়ে দিবে। যখন শীত পড়বে, বরফ না পড়লেও একদম হাড্ডিতে গিয়ে খামচে ধরবে এমন কনকনে ঠান্ডা শীত।
আর যখন বৃষ্টি নামবে, অতি অল্প সময়েই এত বড় ফোঁটায় এত ঘন হয়ে নামবে যে যদি আমাদের ঢাকা শহরে এমন বৃষ্টি নামতো, তাহলে রাজধানী তিন হাত পানির নিচে তলিয়ে যেত।
বৃষ্টি যত ঘন হয় তত মজা। তবে এখানকার বৃষ্টির সাথে খুব বিদ্যুৎ চমক ঘটে। ভয়টা সেখানেই। যদিও বাজ পড়ার জন্য ফ্লোরিডা কুখ্যাত।
আমার বাচ্চাদের বৃষ্টিতে ভেজার কথা যখন বলি, দুইজনই তখন এমনভাবে না করলো যেন কোন তিতা ওষুধ খেতে বলছি। বড়টা বলল বৃষ্টির দিনে বাইরে বেরোতে নেই, আর ছোটজন বলল বৃষ্টির পানি অনেক ঠান্ডা হয়ে থাকে। ভিজলে অসুখ করবে, ওকে হসপিটাল যেতে হবে।
দোষটা ওদের না। ওরাই স্কুলে এইসব আজে বাজে জিনিস শিখেছে। ওদের আনন্দ হচ্ছে সুইমিং পুলে সুইম করা, বা স্প্ল্যাশ পার্টি। সেখানে পানি একটা নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় থাকে। ঠান্ডা লাগে না।
আমি বললাম আমিও ভিজবো ওদের সাথে।
তারপরেও রাজি হচ্ছিল না।
কিন্তু যেই মুহূর্তে বৃষ্টি তার প্রথম ফোঁটা দিয়ে ওদের স্পর্শ করলো, আমার ছোট ছেলে বলল, "বাবা, এতো খুবই মজার!"
বড় জন কিছু বলাবলিতে নেই। সে ততক্ষনে রাস্তায় নেমে পড়েছে। খালি পায়ে ছুটছে জমে থাকা পানির দিকে। লাফালাফি করছে। ভেজা কাদা গায়ে মাখছে। প্রকৃতির সাথে মেশায় এত আনন্দ!
আহা, আমি যদি ওদেরকে বাংলাদেশের বর্ষার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পারি! আমাদের সিলেটের বিখ্যাত বৃষ্টি। দিনের পর দিন চলা অবিরাম, অবিশ্রান্ত বারিধারা। ব্যাঙের ডাক, ডোবায় সাপের খেলা, পাড়ার ছেলেদের ছোট ছোট মাছ ধরা। কাদায় মাখামাখি হয়ে ফুটবল খেলা, কেউ রোনালদো, কেউ মেসি - ম্যারাডোনা! রাজহাঁসের মতন ডানা ঝাপটিয়ে সব অপ্রিয়তা ঝেড়ে ফেলা।
রিক্সায় হুড নামিয়ে ভিজতে ভিজতে শহর দেখা। রাস্তায় পানি জমে থাকবে, সেই পানি কেটে এগিয়ে যাবে গাড়ি, বাস, সাইকেল-রিক্সা। ঢেউ এসে আছড়ে পড়বে বাউন্ডারি দেয়ালে।
কিংবা ঝুম বৃষ্টিতে কেবলই হাঁটা। প্রিয় কারোর হাত ধরে ভিজতে ভিজতে বহুদূর হেঁটে যাওয়া।

সর্বশেষ এডিট : ০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:১৭
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দ্যা এডামেন্ট আনকম্প্রোমাইজিং লিডার : বেগম খালেদা জিয়া

লিখেছেন ডি এম শফিক তাসলিম, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৪

১৯৪৫ সালে জন্ম নেয়া এই ভদ্রমহিলা অন্য দশজন নারীর মতই সংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, বিয়ে করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম সুশাসক শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কে! ১৯৭১সালে এ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×